বাংলাদেশের বীমা শিল্প ও এলআইসি
শিপন ভূঁইয়া: বীমার ক্রমোন্নতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সর্বপ্রথম নৌ-বীমার মাধ্যমে বীমা ব্যবস্থার প্রসার লাভ করে। পরবর্তীকালে ১৬৬৬ সালে লন্ডনে এবং ১৮৬১ সালে টালি স্টেটের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ফলে সর্বপ্রথম ব্রিটেনে আগুনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৮৬৫ সালে অগ্নিবীমার প্রচলন হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে Hand in Hand নামক জীবন বীমার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে প্রথম জীবন বীমার প্রবর্তন করা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন আমলে কতিপয় ইউরোপীয় উদ্যোক্তা কলকাতায় ১৮১৮ সালে "The Orient Life Insurance Co" নামক একটি জীবন বীমা সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বীমা ব্যবসার সূচনা করেন। তারপর জীবন বীমার ওপর ১৮৭০-৭১ সালের দিকে Bombay Mutual Life Assurance Society, Oriental Govt. Security Life Assurance Co. Ltd ইত্যাদি অনেক জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান শুরু হতে থাকে।
ভারতীয় উপমহাদেশে Clauson Commitee-র প্রতিবেদন অনুসারে ১৯২৮ সালে The Indian Insurance Companies Act. নামে একটি বীমা আইন প্রণয়ন করা হয় এবং তা ১৯৩৮ সালে সংশোধিত, পরিমার্জিত ও সংযোজিত হয়ে পুনরায় চালু হয়। ১৯৪৭ সালে পাক ভারত বিভক্তির পরে তৎকালীন পাকিস্তানে উক্ত আইন কার্যকর থাকলে ও ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে এর কিছু অংশ সংশোধন করা হয়। ১৯৫৭ সালে ভারতে বীমা ব্যবসায় জাতীয়করণ করা হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের বীমা কোম্পানিগুলো বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীমার ক্ষেএে একটি নতুন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ Bangladesh Insurance (Emergency Provision) Order, 1972 জারি করা হয়। এ Act এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের বীমা আইন হিসাবে ১৯৩৮ সালের বীমা আইনটিকে মূলভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশ নং (৯৫) অনুযায়ী দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়। উক্ত আদেশে দেশের ৭৫ টি বীমা প্রতিষ্ঠান কে প্রথমে ৫ টি সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতঃপর ১৯৭৩ সালের ১৪ মে বীমা করপোরেশন অধ্যাদেশ ১৯৭৩ (Insurance Corporation Ordinance 1973) মাধ্যমে উক্ত পাচঁটি বীমা সংস্থাকে দুটি সংস্থার অধীনে আনা হয়। একটি হলো জীবন বীমা কর্পোরেশন এবং অন্যটি হলো সাধারন বীমা করপোরেশন।
বীমা কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। বর্তমানে সাধারন বীমা ৪৬টি কোম্পানি এবং জীবন বীমা ৩৩ টি কোম্পানি রয়েছে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমা শিল্পের পেনিট্রেশন ০.৫৬ এবং ঘনত্ব (মাথাপিছু প্রিমিয়াম) মাএ ৯ মার্কিন ডলার অথচ উন্নত দেশের পেনিট্রেশন ৪% এর অধিক এবং ঘনত্ব ৩০০০ মার্কিন ডলারের অধিক। বাংলাদেশে দুই কোটি জনগনকে লাইফ বীমার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
বীমা শিল্পের গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ও বীমা আইন ২০১০ প্রণয়ন এবং ২০১৪ সালে জাতীয় বীমা নীতি প্রণয়ন করেন। সরকার ১ মার্চ কে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বীমা খাতের উন্নয়নের জন্য সরকারের ১১৮.৫০ কোটি টাকা এবং বিশ্বব্যাংক এর ৫১৩.৫০ কোটি টাকা মোট ৬৩২ কোটি টাকার অর্থায়নে Bangladesh Insurance Sector Development Project (BISDP) প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়েছে যা ২০২২ সালে শেষ হবে।
২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফরে আসলে বাংলাদেশে এলআইসির নিবন্ধনের সম্মতিপএ তুলে দেওয়া হয়। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়। এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড লাইসেন্স গ্রহণের পর ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর বীমা ব্যবসায়ের কার্যক্রম শুরু করেন।
এলআইসি বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম ও একমাএ জীবন বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রধান উদ্যোক্তা ভারতের লাইফ ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এলআইসি) ও এনডিআই ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া। এলআইসি একটি আর্ন্তজাতিক বীমা কোম্পানি। এটি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি যা ১৯৫৬ সালে গঠিত হয়। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের ১৬ টি দেশে ভারতভিত্তিক এই কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম রয়েছে। এলআইসির গ্রাহক সংখ্যা ৪০ কোটি। এলআইসির লাইফ ফান্ড ৩৬ লক্ষ কোটি টাকা। এলআইসি বাংলাদেশের স্থানীয় দুই স্পন্সর হচ্ছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্ট্রাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড।
"Everything is sweetened by risk" অর্থাৎ সব কিছুই ঝুঁকি দ্বারা স্বাদসিক্ত হয়ে আছে। জীবন বীমা সঞ্চয় ও আর্থিক ঝুঁকি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সচেতন মানুষদের উচিৎ নিজের ভবিষ্যত ঝুঁকিমুক্ত রাখা ও পরিবারের জন্য সঠিকভাবে বীমা পরিকল্পনা করা।
লেখক: রিজিওনাল হেড, এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড।