কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব প্রসঙ্গে
এ কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই: আমার জানা মতে পৃথিবীর কোন দেশে কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা বাধ্যতামূলক নয়। পক্ষান্তরে আইন করে এই সমস্ত দেশে তৃতীয় পক্ষ (থার্ড পার্টি) মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ প্রণয়নের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের মৃত্যু ও শারীরিক অনিষ্ঠতা এবং সম্পত্তির ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা আন্তর্জাতিক বীমা চর্চার সাথে সামঞ্জস্য বা সঙ্গতিপূর্ণ।
কিন্তু পরবর্তীতে এক অজানা বা রহস্যজনক কারণে আইনটি বাতিল করা হয় এবং সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ প্রবর্তন করা হয়।
এই আইনে অ্যাক্ট অনলি পলিসির মাধ্যমে কেবলমাত্র তৃতীয় পক্ষের মৃত্যুর ঝুঁকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক বীমা বাজারে বিরল বা অস্থিত্বহীন।
এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কার্যত তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বহুলাংশে সংকুচিত করা হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের মৃত্যুর হার, শারীরিক অনিষ্ঠতার (বডিলি ইনজুরি) তুলনায় অনেক অংশে কম।
কোন প্রকার বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই বীমা কর্তৃপক্ষ আশ্চর্যজনকভাবে ২০২০ সালে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তথা থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল ঘোষণা করে।
কর্তৃপক্ষের এই অযাচিত সিদ্ধান্তের ফলে মোটর বীমার ক্ষেত্রে এক বিশাল শূন্যতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় এবং দেশের তৃতীয় পক্ষ মোটর বীমার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে লোপ পায়।
পরিণতি স্বরূপ কোন প্রকার মোটর বীমা ছাড়াই অসংখ্য মোটরগাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে শুরু করে, যা এক অকল্পনীয় ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। এর ফলে তৃতীয়পক্ষ কোন প্রকার বীমা ছাড়া সম্পূর্ণ অসহায় এবং মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, কর্তৃপক্ষের এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত এক স্বার্থান্বেষী মহল কতৃক প্রণোদিত এবং প্রভাবিত, যারা নিজেদের স্বার্থে কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করতে উৎসাহী।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এই ধরনের হঠকারি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট মহলে রীতিমতো বিস্ময়, ক্ষোভ এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বীমা কর্তৃপক্ষের এই ধরনের আচরণ সুস্পষ্টভাবে তাদের কাজে গাফিলতি এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় বহন করে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তৃতীয় পক্ষ (থার্টি পার্টি) মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করার পিছনে যুক্তি এবং কারণ রয়েছে।
প্রথমত: কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা সাধারণত ব্যয়বহুল এবং ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতা বা সামর্থের ঊর্ধ্বে হতে পারে।
দ্বিতীয়ত: দেশে অসংখ্য গাড়ি রয়েছে যা অত্যন্ত পুরাতন এবং কার্যত রাস্তায় ব্যবহারের অযোগ্য বা অনুপযুক্ত।
আন্তর্জাতিক বাজারে সাধারণত ১০ বছরের অধিক পুরাতন গাড়ি কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমার জন্য বিবেচনা করা হয় না।
এই মান অনুযায়ী দেশে আনুমানিক অর্ধেকের বেশি গাড়ি কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমার বহির্ভুত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অধিকাংশ মোটর বীমার ক্রেতার স্বার্থের কথা চিন্তা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ স্বার্থান্বেষী মহলের সকল প্রকার চাপ প্রতিরোধ করে মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে তৃতীয় পক্ষ মোটর বীমা পুনঃপ্রবর্তন করবে এমনটাই তাদের কাছে প্রত্যাশা, যা সকল প্রকার জল্পনা-কল্পনার ইতি টানতে সক্ষম।
কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করার প্রচেষ্ঠা কেবল অযৌক্তিকই নয় বরং স্বার্থপরতার ইঙ্গিত বহন করে। এ ধরনের অযৌক্তিক আবদার বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করার প্রশ্নই উঠে না।
বীমা গ্রাহকের উপর জোরপূর্বক কোন সিদ্ধান্ত (যা আন্তর্জাতিক বীমা চর্চার পরিপন্থি) চাপিয়ে দেয়া মোটেই সমীচীন হবে না।
আশা করি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এ ব্যাপারে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্পণ্য বা দ্বিধাবোধ করবে না।