জাতীয় বীমা দিবস ২০২২ এর ভাবনা
ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন: বাংলাদেশে বীমা দিবস ২০২২ পালিত হচ্ছে। জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অর্জন। দিবসটির সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি জড়িত। কেননা ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার সেই স্মৃতি ও অবদানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারের জাতীয় বীমা দিবস (১ মার্চ) ঘোষণা করা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
একইসাথে এটাও বলা দরকার যে, এই বীমায় চাকরি করার নেপথ্যে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ রচনার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেজন্য একথা বলতে দ্বিধা নেই, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সংগ্রামে বীমার সম্পৃক্ততাকে চির ভাস্মর করে রাখার নিমিত্তে ১ মার্চ বীমা দিবস পালন সরকারের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বাস্তব সম্মত, যুগান্তকারী ও উচ্চ চিন্তার পরিচায়ক। দিবস পালনের সাথে এই খাতের উন্নয়ন এবং জাতীয়ভাবে বীমা খাতকে সর্বজন গ্রহনযোগ্য করার বিষয়টি একান্তই কাংখিত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিগত দু’বার ২০২০, ২০২১ বীমা দিবস পালনে বীমা খাতের অগ্রগতির জন্য বিশাল কাজে দিয়েছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বীমা দিবস পালনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকারী-বেসরকারী কোম্পানি ও সংস্থাগুলো আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা দিয়ে বীমা দিবস উদযাপনকে সার্থক করার চেষ্টা করা হয়। সরকারীভাবে ঢাকা ও প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দিবসটি পালনে র্যালী ও আলোচনাসভা আয়োজন করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। ব্যানার ফেষ্টুন ও পোষ্টার দিয়ে মনোজ্ঞভাবে অফিস ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে দর্শনীয় করে তোলার মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এসবের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বীমার ‘ইমেজ’ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালিত হচ্ছে।
এ কথা সকলেই আমরা জানি ও বলে থাকি যে, বাংলাদেশে বীমা খাতের উন্নয়নের বড় বাধা বীমার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা ও এ খাতের ইমেজ সংকট। এর জন্য সরকারী বেসরকারী অবহেলা যেমন দায়ী, তেমনি এ খাতের কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনেকাংশে দায়ী। অবশ্য বীমা আইন ২০১০, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০ এবং বীমা নীতি ২০১৪ প্রণীত এবং জারী হওয়ার পর বীমা খাতের উন্নতি হয়।
এ বিশাল খাতের তদারকি, আইনের প্রয়োগ করার জন্য কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। এর মধ্যে কোম্পানি সমূহের বিশাল আকারের দুর্নীতির খবর যখন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার বার ছড়িয়ে পড়ছে, তখন যেটুকু উন্নতি হচ্ছে, তার চাইতে বেশি খারাপ ধারণা তৈরী হচ্ছে। অপর দিকে এ খাতের জনশক্তির সংখ্যা এখন লাইফ ও নন লাইফ মিলিয়ে ২০ লাখের কাছাকাছি হতে পারে। দুঃখ্যজনক হলেও সত্য যে, কোন সঠিক হিসাব নেই। এ খাতের জনশক্তির চাকরির নীতিমালা, নিয়োগ, পদোন্নতি, কোম্পানি পরিবর্তন সহ অনিয়ম, অবহেলা, এখাতের চাকরিজীবীদের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের নিকট অনেকটা তলানীতে রয়েছে। অথচ এরা জাতীয় জীবনে অনেক অবদান রাখছে। এই জনশক্তিই প্রিমিয়াম যোদ্ধা। এদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আইন ও বিধির সঠিক প্রয়োগ দরকার। তাহলে বীমা খাতের ইমেজ সংকট দূর হতে পারে।
দায়-দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে নির্ধারণ করে আইনের আত্ততার আনা জরুরি। অপর দিকে সকল ক্ষেত্রে আইনের অবকাঠামোর মধ্যে পরিচালনা আবশ্যক। তাতে চরম ঘাটতি রয়েছে। নন-লাইফে বীমা দাবী পরিশোধে এবং লাইফে মেয়াদ পূর্তি সহ সকল দাবী পরিশোধের স্বচ্ছতা ও জবাব দিহীতার জন্য সংশ্রিষ্ট সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি। এ বিষয়টি কারো একার পক্ষে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বীমাকে তার অইন ও বিধির মধ্যে পরিচালনা করার মাধ্যমেই এটা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সকল স্তরে আইন মেনে চলার ও প্রভাবমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনও অধরা রয়ে গেছে।
বীমা খাতের জন্য সরকারী দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের সুফল অদূর ভবিষ্যতে পাবে। এর মধ্যে পেনশন বীমা চালু করা, এচ্যুয়ারি তৈরী করা, শিক্ষিত যুবকদের সম্পৃক্ত করা, নতুন নতুন প্রোডাক্ট/ পরিকল্প তৈরী করায় সরকার মনোযোগ দিয়েছে। এজন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই। সাথে সাথে এক্ষেত্রে নতুন প্রোডাক্ট ডিজাইন করার ক্ষেত্রে চাহিদা, প্রযোজ্যতা ও উপকারীতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে বীমার বিশেষ করে লাইফের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার তুলানায় বীমা গ্রহীতার হার (পেনিট্রেমন) বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের কয়েকটি সেক্টর বীমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেমন-
* জনসংখ্যার বড় অংশকে বীমার আওতায় আনা দরকার।
* কৃষি ও কৃষককে বীমার আওতায় আনার ব্যবস্থা করা জরুরি।
* স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
* ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য জীবন বীমা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
* পাসর্পোট ইস্যু করার ক্ষেত্রে জীবন বীমা বাধতামূলক করা প্রয়োজন।
* শিল্প ও কল কারখানা এবং গার্মেন্টস সেক্টরকে জীবন বীমার আওতায় আনা প্রয়োজন।
এসব পলিসি ডিজাইন করার ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধানী জরিপের মাধ্যমে তা করতে হবে। যদি তা বাস্তবায়ন করা যায় তা হলে বাংলাদেশে বীমা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে।
এবার আসি ইসলামী বীমার কথায়। বাংলাদেশের বীমা কোম্পানির সংখ্যা তিন ডিজিটে পৌঁছতে বেশি বাকী নেই। শতকরা প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলমান হওয়ায় ইসলামের সকল বিষয়ে বেশি আগ্রহী। সুদমুক্ত অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত হতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়ে চলেছে। কিন্তু ইসলামী বীমা এক সময় নতুন ধারণায় বিবেচিত ছিল। দুই দশক অতিবাহিত হওয়ার পর এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ইসলামী বীমা অনেকটাই জনগণের ধারণা প্রসূত বিষয়। ফলে প্রচলিত বীমা ও ইসলামী বীমার পার্থক্য মানুষ বাহ্যিক ও কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বুঝেন। সে কারণে ইসলামী বীমার জন্য যারা কোম্পানি ও প্রোডাক্ট নিয়ে জনগণের নিকট যাচ্ছে তাদের অবশ্যই কতগুলো বিষয়ে আন্তরিক পূর্ণ অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করা দরকার।
স্কলারগদের নির্দেশনা ও শরিআহ পরিপালনে অবশ্যই প্রয়োজনীয় কার্যক্রমগুলো পালন করে ইসলামী বীমা চালাতে হবে। রিবা, ঘারার ও মাইসির মুক্ত বীমা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে কোনরূপ ছাড় দেয়া মারাত্মক অপরাধের শামিল। অথচ আমাদের দেশের নন-লাইফ ও লাইফের সকল কোম্পানিতে পূর্ণাঙ্গ বা উইং/ উইন্ডো করে ইসলামী বীমার নাম করে পরিচালনা হচ্ছে। সরকারী পর্যায়ও তা এখন আর অজানা ও অচেনা বিষয় নয়।
অথচ ইসলামী বীমার জন্য নির্দিষ্ট কোন বিধিমালা না থাকার ফলে ইসলামী বীমা একটি গড্ডালিকা প্রবাহে চলে যাচ্ছে। যা খুবই দুঃখ জনক। প্রকারান্তরে আমরা নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করে চলেছি। ইসলামী অনুশাসন মেনে ইসলামী বীমা পরিচালিত হলে জনগণের আমানত লাভসহ ফেরত দেয়া, বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। তা থেকে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ফলে ইহকালীন কল্যাণ তো হচ্ছেই না, পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে- সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামী বীমার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আশির দশক থেকে কাজ চলছে। অথচ দেশে ব্যাংকিং সেক্টর বেসরকারী পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সম্পৃক্ততা লক্ষ্যণীয়। ইসলামী বীমার ক্ষেত্রে সমানতালে জনপ্রিয়তা থাকলেও কার্যক্রম ও কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থাপনা চরমভবে অবহেলার শামিল। প্রচলিত বীমার টেকনিক্যাল বিষয় ও শরিআর সমন্বয় করার মতো অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির এখানে প্রচণ্ড অভাব। কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবী। তা না হলে সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন ইসলামী বীমা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জনপ্রিয়তা হারাবে। মানুষ বলতে শুরু করবে ইসলামী বীমার নামে এসব কি হচ্ছে! ইতিমধ্যে এ ধরনের আলাপ আলোচনা হয়ে চলেছে।
২০২২ সালের বীমা দিবসে বাংলাদেশের দেশ, ও জাতি ও ইসলামের স্বার্থে প্রচলিত বীমা ব্যবস্থা ও ইসলামী বীমার উপর কিছু কথা এখানে পেশ করলাম। উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে তা সামন্যতম কাজে লাগলেও এ লেখা স্বার্থক হবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করছি এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।