জীবন বীমার মাধ্যমে জীবনকে সুরক্ষিত রাখতে চাই

এস এম জিয়াউল হক, এফএলএমআই: একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তার পড়াশোনা শেষ করার পরে, চাকরির বাজারে যোগদান করে অথবা একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করে। কিন্তু তার সঞ্চয়ের জন্য পোর্টফোলিও মিশ্রণের শিক্ষা কোথাও শিখে না। অতীত অভিজ্ঞতার ধারা অনুসরণ করে, ছোট বা বড় সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য টাকা ব্যাংকে জমা করে, আয়কর রেয়াতের জন্য সঞ্চয়পত্র কিনে, দীর্ঘমেয়াদী আয়ের জন্য ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে, নিজস্ব আবাসনের উদ্দেশ্যে বা ভাড়া আয়ের জন্য ফ্ল্যাট কিনে, কখনও কখনও দ্রুত আয়ের লক্ষ্যে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে অথবা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি মুনাফা পেতে অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। এমনকি কখনও কখনও তার সুরক্ষার প্রয়োজন না জেনেও বীমা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগকারীদের একটি ছোট অংশ অধিক মুনাফা পেলেও বেশিরভাগই তাদের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ হারিয়ে ফেলে।

পোর্টফোলিও মিশ্রণ হলো একটি পোর্টফোলিওর মধ্যে থাকা সমস্ত সম্পদের মিশ্রণ, যেমন স্টক, বন্ড, আমানত, সুরক্ষা, নগদ টাকা এবং আবাসন খাতের বা অন্যান্য সম্পদের সংমিশ্রণ। একটি সম্পদ শ্রেণীর মধ্যে, সম্পদগুলো আরও মিশ্রিত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পোর্টফোলিওতে স্টকের বড় বিনিয়োগ, মাঝারী বিনিয়োগ বা ছোট বিনিয়োগ হতে পারে। বিনিয়োগে পোর্টপোলিও মিশ্রন বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওর গঠন বুঝতে সাহায্য করে এবং একটি বৈচিত্র্যময় সম্পদের মিশ্রন বিনিয়োগের ঝুঁকি কমায়। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে, আবাসন খাতে, স্টক বা অন্যান্য নগদ রিটার্নে স্বল্প-মেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী আমানত রাখতে বেশি পছন্দ করে। জীবন বীমা কোম্পানিতে তাদের বিনিয়োগ সাধারনত ফিন্যান্সিয়াল এসোসিয়েটদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অন্যান্য পোর্টফোলিওতে উচ্চ লাভের পাশাপাশি ঝুঁকির মাত্রাও বেশি, কিন্তু শুধুমাত্র বীমাই সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। আমরা বীমাকে একটি সঞ্চয় চুক্তির পাশাপাশি একটি সুরক্ষার মাধ্যম হিসাবেও দেখতে পারি। জীবন বীমা কভারেজের মাধ্যমে জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পোর্টফোলিও মিশ্রনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা এবং শিক্ষিত করা খুবই প্রয়োজন।

জীবন বীমা (বিশেষ করে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে) একটি বীমা পলিসি যা বীমা গ্রাহক ও বীমাকারীর মধ্যে একটি চুক্তি, যেখানে বীমাগ্রাহক বীমার মেয়াদপূর্তিতে বীমা অংকের পুরো টাকা প্রাপ্ত হবেন অথবা পলিসি সচল থাকা সাপেক্ষে মেয়াদকালের যে কোন সময় গ্রাহকের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু হলে বীমা অংকের পুরো টাকা মনোনীতককে পরিশোধ করা হবে এই প্রতিশ্রতি দেয়। চুক্তির উপর নির্ভর করে, দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা গুরুতর অসুস্থতার সময়েও অর্থ প্রদান করা হয়। বীমায় স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষার জন্য পলিসির চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বীমাগ্রহিতা যে সুবিধা পায় তার জন্য বীমাকারীকে নিয়মিতভাবে বা এক কালীন মেয়াদে প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়। আধুনিক জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান সম্পদ-ব্যবস্থাপনা শিল্পের সাথে সাদৃশ্য বহন করে এবং জীবন বীমাকারীরা তাদের  বীমা প্রকল্পের মধ্যে পেনশনকে অন্তর্ভূক্ত করেছে যা সাধারণত অ্যানুয়িটি হিসাবে পরিচিত।

জীবন বীমা চুক্তি দুটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত, ক) সুরক্ষার উদ্দেশ্য পলিসি, যেখানে একটি নিদিষ্ট ঘটনার জন্য সুবিধা প্রদান করা হয় এবং থোক বরাদ্দ করা করা হয়। সুরক্ষা পলিসির সাধারণ রূপ হল মেয়াদী বীমা এবং স্বাস্থ্য বীমা। খ) বিনিয়োগের উদ্দেশ্য পলিসি, এই পলিসি গুলোর মূল উদ্দেশ্য হল নিয়মিত বা এক কালীন প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি করা যেমন সমগ্র জীবন, এনডোমেন্ট, সার্বজনীন ও পরিবর্তনশীল জীবন বীমা পলিসি। বাংলাদেশে মাসিক সঞ্চয়ী বীমা, তিন কিস্তি বীমা, পাঁচ কিস্তি বীমা, এক কালীন বীমা, পেনশন বীমা, শিশু শিক্ষা নিরাপত্তা বীমা ইত্যাদি এবং কিছু স্বাস্থ্য বীমা যেমন অক্ষমতা সুরক্ষা, প্রিমিয়াম মওকুফ সুবিধা ইত্যাদি সহযোগি বীমা আওতাধীন সুরক্ষা বেশি বিক্রি হয়।

স্থায়ী জীবন বীমা হলো এক ধরনের জীবন বীমা যেখানে বীমাকৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট জীবনকালকে বীমা সুরক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্থায়ী বীমা পলিসিতে মেয়াদপূর্তির তারিখ পর্যন্ত নগদ মূল্য জমা হয়। বীমাগ্রাহক টাকা উত্তোলন করে, নগদ মূল্য থেকে ধার করে, পলিসি সমর্পণ করে এবং সমর্পণ মূল্য গ্রহন করে নগদ মূল্য থেকে টাকা গ্রহন করতে পারে। ইনভেস্টোপিডিয়ার রেফারেন্স থেকে, জীবন বীমা পরিকল্পনার প্রাথমিক প্রকারগুলো নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো।

এনডোমেন্ট পরিকল্প:

এনডোমেন্ট পলিসি হলো একটি জীবন বীমা চুক্তি যেখানে বীমাগ্রাহকের মৃত্যুতে অথবা বীমার মেয়াদপূর্তিতে বীমা অংকের পুরো টাকা প্রদান করা হয়। এ জাতীয় বীমা পলিসিসমূহ বীমাগ্রাহকের বয়সের উপর নির্ভর করে সাধারনত দশ, পনের বা বিশ বছর মেয়াদী হয়ে থাকে। কিছু পলিসি গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রেও অর্থ প্রদান করে। পলিসিসমূহ ট্র্যাডিশনালি মুনাফাসহ অথবা ইউনিট লিংকড (মুনাফার তহবিলের সাথে সংযুক্ত) হয়ে থাকে। বীমাগ্রাহক বীমা চালু রাখতে অনিচ্ছুক বা অসামর্থ হলে উক্ত বীমা সমর্পণ করতে পারবেন কিন্তু কতদিন বীমা চালু রাখতে হবে বা কত টাকা জমা করতে হবে তা বীমা কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত হবে।

সার্বজনীন জীবন বীমা পরিকল্প:

সার্বজনীন জীবন বীমা অপেক্ষাকৃত নতুন বীমা পন্য, যেখানে স্থায়ী বীমা কভারেজের সাথে প্রিমিয়াম প্রদানে নমনীয়তা রয়েছে এবং নগদ মূল্যের বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সার্বজনীন জীবন বীমা পলিসি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মুনাফা-সংবেদনশীল (ট্র্যাডিশনাল স্থায়ী সার্বজনীন জীবন বীমা নামেও পরিচিত), পরিবর্তনশীল সার্বজনীন জীবন বীমা, নিশ্চিত মৃত্যু সুবিধা এবং ইক্যুইটি-সূচকযুক্ত সার্বজনীন জীবন বীমা পলিসি। সার্বজনীন জীবন বীমা পলিসির নগদ মূল্য রয়েছে। পরিশোধিত প্রিমিয়াম নগদ মূল্য বৃদ্ধি করে, প্রশাসনিক ও অন্যান্য খরচ নগদ মূল্য হ্রাস করে। সার্বজনীন জীবন বীমা পলিসি সমগ্র জীবন বীমা পলিসির অসুবিধাগুলিকে দূর করে যেখানে প্রিমিয়াম এবং মৃত্যু সুবিধা নিদিষ্ট। সার্বজনীন জীবন বীমায় প্রিমিয়াম এবং মৃত্যু সুবিধা নমনীয়। সার্বজনীন জীবন বীমায় নিশ্চিত মৃত্যু সুবিধার ব্যতিক্রম বাদে কম নিশ্চয়তার সুবিধাগুলোতে অধিক নমনীয়তা রয়েছে।

ইউনিট-সংযুক্ত বীমা পরিকল্প:

ইউনিট-সংযুক্ত বীমা পরিকল্পগুলো অন্যান্য বীমা পরিকল্প যা মিউচুয়াল ফান্ড এবং মেয়াদী বীমা পরিকল্পের সমন্বয়ে গঠিত। বিনিয়োগকারীরা ইউনিটের উপর ভিত্তি করে মুনাফা পায় না বরং নির্বাচিত তহবিলের আয়ের উপর ভিত্তি করে রিটার্ন পান।

স্বল্পমেয়াদী বীমা পরিকল্প:

একটি নিদিষ্ট মেয়াদের জন্য জীবন বীমা কভারেজ প্রদান করে। এ ধরনের পলিসিতে নগদ মূল্য জমা হয় না এবং তুলনামূলকভাবে স্থায়ী বীমা পলিসির চেয়ে কম ব্যয়বহুল এবং মৃত্যু সুবিধা প্রদান করে কিন্তু বয়সের সাথে সাথে প্রিমিয়াম বৃদ্ধি পায়। বীমাগ্রাহক বর্ধিত স্বল্প মেয়াদী প্রিমিয়াম বা বীমা চাহিদা কমানোর জন্য সঞ্চয় করতে পারেন।

জীবন বীমা পলিসি ক্রয়ের সময় প্রয়োজনীয় কভারেজের পরিমাণের পাশাপাশি খরচও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বীমা প্রিমিয়াম বয়স, সামগ্রিক স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। সবচেয়ে কম খরচে জীবন বীমা পলিসির মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব জীবন বীমা পলিসি ক্রয় করতে হবে কেননা বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বীমা পলিসির প্রিমিয়ামও বৃদ্ধি পাবে। মানুষের বয়স বাড়লে বা তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে জীবন বীমার প্রিমিয়াম হার সাধারণত বৃদ্ধি পায়। কিছু ক্ষেত্রে অসুস্থতা বা স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারনে অনেকে কভারেজের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। আপনি বীমা পলিসি কেনার জন্য যত বেশি সময় ব্যয় করবেন বীমা পলিসির প্রিমিয়াম তত বেশি বেড়ে যাবে। যদিও সাশ্রয়ী মূল্যে পলিসি কেনা গুরুত্বপূর্ণ, তবে কভারেজের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি বিনিময়ে কী পাচ্ছেন তাও বিবেচনা করতে হবে।

জীবন বীমা পলিসিগুলো কিছুটা সংবেদনশীল মনে হতে পারে, তাই বীমার বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধাসমূহ সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেওয়া উচিত। প্রথমে আপনার আর্থিক চাহিদা এবং লক্ষ্যগুলি মূল্যায়ন করুন এবং সেই চাহিদাগুলি এবং সুরক্ষাগুলি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আপনার জন্য কোন ধরনের বীমা সুবিধা সবচেয়ে ভাল তা নির্ধারণ করুন। নিশ্চিত করুন যে আপনি সঠিক কভারেজ (যেমন মেয়াদী বনাম স্থায়ী) এবং সঠিক সুবিধার পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। তারপর আপনার চাহিদা মেটাতে পারে এমন বীমা কোম্পানির কাছ থেকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের কভারেজ সন্ধান করুন। প্রথমে আপনার কি পরিমান কভারেজ প্রয়োজন তা নির্ধারন করুন। কভারেজের সঠিক পরিমাণে পৌঁছানোর জন্য বেশ কিছু নিয়ম আছে। একটি পলিসি কেনার আগে পোর্টফোলিও মিশ্রনের যাচাই বাছাই করেছেন তা নিশ্চিত করুন, বীমা চুক্তিটি সাবধানে পড়ুন এবং সমস্ত বিধানগুলো বুঝে নিন। স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে সঞ্চয়, আয়, স্বাস্থ্য, শিশু শিক্ষা এবং অবসর পরিকল্পনার জন্য সুরক্ষা পেতে বিনিয়োগকারীকে পোর্টফোলিও মিশ্রন পদ্ধতির মাধ্যমে তার জীবন ও স্বাস্থের সুরক্ষা করা উচিত যা জীবন বীমার অধীনে একজন বিনিয়োগকারীর জীবনকে আকর্ষণীয় করতে পারে।

লেখক: মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড