ব্যাংকাস্যুরেন্সের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ
মো. নূর-উল-আলম এফসিএস: ব্যাংকাস্যুরেন্স জগতে বাংলাদেশ নবীনতম সদস্য। এদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নতুন হলেও বহির্বিশ্বে বহু বছর পূর্বেই এর প্রচলন বা আবির্ভাব ঘটে। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথম বীমা পণ্য বিক্রয় হয় ১৮৬০ সালে, যখন বেলজিয়াম এর সিজিইআর সঞ্চয় ব্যাংক বন্ধকী-সংযুক্ত বীমা বিক্রি শুরু করে। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থা প্রথম চালু হয় ফ্রান্সে ১৯৭০ এর দশকে।
ব্যাংকাস্যুরেন্সের বাজার বিশ্বব্যাপী, এটি বীমা কোম্পানিগুলোর বীমা, বিশেষ করে জীবন বীমা, পণ্য বিক্রির জন্য একটি কার্যকর মাধ্যম। এ ব্যবস্থা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে খুব দ্রত জনপ্রিয়তা লাভ করছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের সবচাইতে বড় ব্যাংকাস্যুরেন্সের বাজার হলো পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো বিশেষ করে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি।
গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইএমএআরসি গ্রুপ বলছে যে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকাস্যুরেন্স বাজার ২০২১ সালে ১.২৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যে পৌঁছেছে। আইএমএআরসি আরও মত প্রকাশ করছে যে এটি বার্ষিক প্রায় ছয় শতাংশ হারে বেড়ে ২০২৭ সাল নাগাদ ১.৮০২ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যে পৌঁছাবে। তারা মনে করে অচিরেই ক্রমবর্ধমান বয়োবৃদ্ধ জনসংখ্যার প্রয়োজনে সকল দেশে বেশি বেশি স্বাস্থ্য এবং জীবন বীমার পাশাপাশি অবসর গ্রহণের পরিকল্পনারও বেশি প্রয়োজন হবে। যা ব্যাংকাস্যুরেন্সের বাজারকে কেবল সম্প্রসারিতই করবে।
ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধিত হবে নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তির সংযোজন এবং নতুন ব্যাংকিং মডেলে অভিযোজনের মধ্য দিয়ে! নিশ্চিতভাবেই, বর্তমান ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জগুলি ঐতিহ্যগত ব্যাংকাস্যুরেন্সের উপর উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করবে। যখন ইন্স্যুরর্টেক এর মতো নতুন বিপণন মাধ্যম আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে তখন শুধুমাত্র মানুষের সাহায্যে সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, কভারেজ এবং অনান্য সেবা প্রদান করা কঠিন হবে। নতুন ডিজিটাল বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, ব্যাংকগুলিকে তাদের শাখা মডেলকে তথাকথিত 'ফিজিটাল' এ রূপান্তর করতে হবে- যা হবে অনলাইন এবং অফলাইন গ্রাহক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। ব্যাংকাস্যুরেন্স এই নতুন অভিজ্ঞতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে গ্রাহকের চাহিদা এবং পছন্দগুলির উপর ভিত্তি করে আরও নতুন নতুন বীমা পণ্য এবং প্রাসঙ্গিক অফারগুলি কি হতে পারে তা নিয়ে গবেষণা অপরিহার্য।
অন্তত তিনটি মূল অনুঘটক 'অ্যানালগ' ব্যাংকাস্যুরেন্স শিশুকে আরও ডিজিটালভাবে আরো পরিণত হতে বাধ্য করবে, সে গুলো হলো:
১। নানাবিধ কারনে ব্যাংকগুলোকে শীঘ্রই তাদের আয়ের খাত বাড়ানো অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
২। গ্রাহকরা এখন হাতের নাগালেই সকল তথ্য পেতে পছন্দ করে এবং নির্ঝঞ্ঝাট আর্থিক লেনদেনের নিশ্চয়তা চায়।
৩। ব্যাংকগুলোর বিশাল গ্রাহক তথ্যভান্ডারের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা।
ডিজিটাল ব্যাংকাস্যুরেন্স উদাহরণ স্বরূপ একটি ব্যাংকিং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে একটি ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে একটি বীমা কোম্পানির বীমা পণ্যগুলোর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থাকবে যাতে করে গ্রাহক সহজেই বীমা সেবা গ্রহন করতে পারেন।
ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং গ্রাহক সবার জন্য লাভজনক। একটি ডিজিটাল ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থা ব্যাংকগুলিকে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করবে, তামাদি বীমা পলিসির সংখ্যা ব্যাপকহারে কমিয়ে দিবে এবং ব্যাংকগুলির জন্য একটি নতুন আয়ের পথ তৈরি করতে সাহায্য করবে। এক্ষেত্র বড় চ্যালেঞ্জ হবে এটি একটি ব্যাংকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাথে একটি বীমাকারীর পলিসি ইস্যুসহ গ্রাহক সেবা প্রদান করার পুরানো প্রযুক্তিকে একীভূত করা; যা সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হবে । ইন্স্যুর্টেক এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
অপরপক্ষে, একটি ডিজিটাল ব্যাংকাস্যুরেন্স বিতরণ ব্যবস্থা বীমাকারীদের আরও বেশী গ্রাহকদের কাছে তাদের বীমা পণ্য বিক্রি করতে সাহায্য করবে। এতে করে গ্রাহকবান্ধব নতুন নতুন বীমা পণ্যর উদ্ভাবন হবে। যা তাকে আরও ভাল বীমা ঝুঁকি নির্বাচন, প্রশমন এবং প্রতিরোধের দিকে পরিচালিত করবে।
উপরন্তু, প্রযুক্তি চালিত ব্যাংকাস্যুরেন্স সলিউশন গ্রাহকদের একটি উন্নত ডিজিটাল অভিজ্ঞতা প্রদান করবে; ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ করবে এবং দিবে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা। গ্রাহকরা একটি বোতাম টিপেই সঠিক সময়ে সঠিক কভারেজ কিনতে পারবেন এবং তারা নিশ্চিন্ত মনে জানেন যে বীমা দাবিও তারা সহজ উপায়ে সহজেই পাবেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেষোক্তিটি হলো ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থা থেকে ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং গ্রাহক তথা সার্বিক অর্থনীতির লাভবান হবার সবচেয়ে বড় বাধা। তাই বীমা দাবি পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে গ্যারান্টর তথা 'জামিনদার' হিসেবে বিবেচনা করে পলিসি তৈরী না করলে ব্যাংকাস্যুরেন্স ব্যবস্থা থেকে কাঙ্খিত ফল লাভ করা কখনও সম্ভব নয়।