বীমার দুর্নীতিকে দুদকের তফসিলে আনতে কাজ চলছে: মঈদুল ইসলাম, মহাপরিচালক (লিগ্যাল)

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তফসিলে রাখা হলেও বীমা কোম্পানিকে রাখা হয়নি। বীমাখাতকে দুদকের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন সংশোধন প্রয়োজন। বীমার দুর্নীতিকে দুদকের তফসিলে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি। এসব কথা বলেছেন দুদক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো. মঈদুল ইসলাম।

এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি খাতের ছোট কর্মচারী, বড় কর্মকর্তা, ছোট ব্যবসায়ী, বড় শিল্পপতি, সব স্তরেই অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্যণীয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অনেকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। দুদক যে কারো অবৈধ সম্পদের খোঁজ করতে পারে। দুদক তাই আইনের ২৬(২) ধারায় বীমাখাতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

বীমাখাতের প্রভাবশালী অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পক্ষে আলাপচারিতায় অংশ নেন সাঈদ আহমেদ।

জনাব মো. মঈদুল ইসলাম। জেলা ও দায়রা জজ। ২৭ বছর কর্মকালের বর্তমান পর্যায়ে প্রেষণে আছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (লিগ্যাল) পদে। সাম্প্রতিক তার কিছু আইনী মতামত দুদকের কার্যপদ্ধতিতে নতুন মাত্রা এনে দেয়। সংশোধিত আইনের আলোকে অনুসন্ধান পর্যায়ে ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ’কে গ্রেফতার, ভিআইপি আসামিদের বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত, দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের উদ্যোগ নেন। এছাড়া দুর্নীতি মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তিতে তিনি সুপ্রিম কোর্টকে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানান। ‘অর্থঋণ আদালত আইনের টুকিটাকি’, ‘পারিবারিক বিষয়াদি আইন প্রসঙ্গ’, ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-কার্যবিধান’সহ বেশকিছু গ্রন্থের প্রণেতা মো. মঈদুল ইসলাম। দেশী-বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত বহু আর্টিকেল পাঠক সমাদৃত হয়েছে। লালসালুর বেষ্টনির বাইরে এসে বিচার বিভাগীয় এ কর্মকর্তা ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র সঙ্গে  কথা বলেন খোলামেলা।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা । দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে এ সংস্থা অপরিহার্য। দুদকের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম সাধারণ মানুষের মাঝে নতুন  করে আস্থার সৃষ্টি করেছে। বাড়িয়ে দিয়েছে প্রত্যাশাও। কিন্তু আইনের ফ্রেমে থেকে দুদকের পক্ষে জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ কতটা সম্ভব ?

মঈদুল ইসলাম: আপনি আইনের ফ্রেমের কথা বলেছেন। যদি দুদক আইনের কথা বলেন, তাহলে বলব, এই আইনের দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। কখনও ছিল না। ২০০৪ সালে কমিশন গঠন হবার পর থেকে এ পর্যন্ত দুদকের কাজ করতে এই আইন কখনই বাধা হয়নি। কমিশন আইনগতভাবে পুরোপুরি স্বাধীন। অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা করা বা তদন্ত করা বা চার্জসীট দেয়া কোন ব্যাপারেই কমিশনকে কারো মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় না। এসব বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। তবে, স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ব্যক্তি চরিত্রের দৃঢ়তা এবং সেই সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি সহনের সংস্কৃতি থেকে, অতি দরদের মানসিকতা থেকে সবাইকে বের হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিক জাগরণ প্রয়োজন। দুর্নীতবাজদের ক্ষমতাহীন করতে হবে সব রকমভাবে।

আইনি কাঠামোর মধ্যে আর একটি আছে বিচার। আমাদের দেশের বিচারে দীর্ঘসূত্রিতার একটি বাধা রয়েছে। এখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অপরাধীরা উচ্চ আদালতে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের পর্যায়েই যায়। দু’চার বছর কিম্বা তারও বেশি সময় অনুসন্ধান/তদন্ত/মামলা আটকে থাকে। শেষ পর্যন্ত শুনানীতে দুদক জয়ী হলেও লাভ খুব একটা হয় না। কারণ, সময় অনেক কিছুই ধ্বংস করে দেয়। এই সুযোগুলো অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরাই নেন। আর, দুর্নীতির অপরাধীরা সকলেই বিত্তবান। যদি এ সুযোগ সীমিত পর্যায়ে থাকত কিম্বা যদি এগুলো শুরুতেই বা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যেত তাহলে অবস্থার উন্নতি হত। সবাই এখন অবশ্য দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আশা করি একদিন এরও উন্নতি হবে। এসব শর্ত পূরণ হলে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আরোও অনেকখানিই অগ্রগতি হবে।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ মামলায় দুদক বিচারে হেরে যায়। কারণ কি ? সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি মামলার বিচারিক চিত্রটি কি ? বাধা কোথায় ? 

মঈদুল ইসলাম: এখন এ অবস্থার অনেকখানিই উন্নতি করা গেছে। বর্তমান চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, মামলা মনিটর করা হচ্ছে, এখন বিচারিক আদালতে আমাদের সাজার হার ৬০% এর কাছাকাছি। সারাদেশে অন্যান্য ফৌজদারী মামলার তুলনায় আমরা বরং গর্বই করতে পারি এখন।

তবে শতভাগ সাজার দায়িত্ব তো অস্বীকার করা যাবে না। মামলায় হেরে যাবার কয়েকটি কারণ থাকে। প্রথমতঃ মামলার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। মামলায় জিততে হলে যেটি থাকতে হয় তা হল সাক্ষ্য-প্রমাণ। অপরাধীরা যতদুর সম্ভব সাক্ষ্য-প্রমাণ না রাখারই চেষ্টা করে। তারপরেও কথা আছে না- সব অপরাধীই তার অপরাধকর্মের চিহ্ন রেখে যায়। সেই চিহ্ন ধরে সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে আনা হল দক্ষ তদন্তকারীর কাজ। তেমন দক্ষ তদন্তকারীর অপর্যাপ্ততা তো রয়েছেই। এখন অবশ্য দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রমাণযোগ্য করেই মামলা করার দিকে নজর দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আরোও কিছু উন্নতি আগামীতে নিশ্চয় দেখা যাবে।

দ্বিতীয়তঃ বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। যে কথা আগেই বলেছি। সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে মামলা করা হলেও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তার অনেকগুলোই প্রমাণযোগ্য থাকে না। অনেক সাক্ষী মারা যায়, চাকরি হতে অবসর নিয়ে চলে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তার জিম্মায় যেসব কাগজপত্র থাকে তা আর প্রমাণ করা যায় না। এই রকম অনেক সমস্যায় পড়ে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না মামলায়।

তৃতীয় কারণ বলতে পারেন আইনজীবীর দক্ষতা। দক্ষতার অভাবটি এখানেও আছে। দক্ষ আইনজীবী যথেষ্ট আছে এ কথা কেউই বলতে পারবেন না। আমরা কিছু আইনজীবী পরিবর্তন করেছি, চেষ্টা করছি আমাদের দক্ষ আইনজীবীর সংখা বাড়াতে। কাজের মান অনুযায়ী পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শেষ কারণ অবশ্যই বিচারক। এখানেও উন্নত করার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না।সাধারণতঃ নব পদোন্নতিপ্রাপ্ত দায়রা জজরাই স্পেশাল জজ হিসেবে নিযুক্ত হন। দুর্নীতির মামলাগুলো বিশেষ ধরণের মামলা, এর জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু আইন। কিন্তু, এই সব বিশেষ আইনের বিশেষত্ব সম্পর্কে অনেকরই ধারণা পরিস্কার নয়। এখানে বিচারকদের ধ্যান ধারণারও পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণেরও। আমরা এসব বিষয় নিয়েও ভাবছি। বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিউটে বিশেষ জজদের আরোও কার্যকর প্রশিক্ষণ দরকার। এইসব কিছুর সুসমন্বয় হলে মামলায় ভাল ফল পাওয়া যাবে।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: দুদকের সাম্প্রতিক কিছু ধরপাকড়ে বিশেষত ব্যাংক-বীমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাহলে দুদক কি নিজেকে উন্নয়ন ও  শিল্প-বাণিজ্য বিরোধী ভূমিকায় দাঁড় করাতে চায় ?

মঈদুল ইসলাম: না, এ কথাটি মোটেও সত্য না। এক্ষেত্রে কোন নির্দোষ মানুষকে ধরার অভিযোগ নেই, বরং উল্টোটা আছে - প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। দুদকের এই ভূমিকায় উন্নয়ন বা শিল্প-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবার কোন কারণই নেই। ব্যাংক ঋণের নামে যে লুটপাটের অবাধ সংস্কৃতি চালু রয়েছে দুদক শুধু তার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। সত্যিকারের জামানত দিয়ে যারা ঋণ দেয়া নেয়া করেছে সেখানে দুদক যায়নি, এইসব খেলাপীদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত আইন রয়েছে। যারা জাল-জালিয়াতি করে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ লুটপাট করেছেন কেবল তাদের বিরুদ্ধেই দুদকের ব্যবস্থা নেবার সুযোগ আছে এবং তাই নেয়া হয়েছে। আতঙ্কিত হলে তারাই হবেন, নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তাদের ওপরেই পড়েছে। এটা তো দুদকের সফলতা, যা উন্নয়ন ও সত্যিকারের শিল্প-বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। বিরূপ রটনা যদি থাকে তবে তা এইসব লুটপাটকারীদেরই, তারা দুদককে এক্ষেত্রে নিরস্ত্র করতে চায়। কিন্তু এখানে কোন ছাড় দেয়া চলবে না।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: সম্প্রতি আইন সংশোধনের ফলে ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি ও আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের এখতিয়ার দুদকের কাছ থেকে পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থায় স্থানান্তর হয়েছে। পুলিশের প্রতি অনাস্থা থেকেই কিন্তু মানুষ দুদকের কাছ থেকে এসবের প্রতিকার চেয়েছিল। এর ফলে ব্যক্তিপর্যায়ের অনেক প্রতারণা মামলারই এখন আর কোনো অভিভাবক নেই। নীতিগত অবস্থান থেকেই অভিযোগ কিংবা মামলাগুলোর ওপর দুদকের কি কোনো মনিটরিং আছে ?

মঈদুল ইসলাম: এক্ষেত্রে ধারণাটা প্রথমে পরিষ্কার করা দরকার। ব্যক্তি, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা জালিয়াতি সম্পূর্ণই দুদকের কাছ থেকে চলে যায়নি। যদি সরকারী সম্পত্তি নিয়ে কেউ প্রতারণা, জালিয়াতি করেন তাহলে তা দুদকের এখতিয়ারে রয়েছে। যদি সরকারী কর্মকর্ত-কর্মচারী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের দায়িত্ব পালনকালে কোন প্রতারণা জালিয়াতি করেন তাহলে তাও দুদকের এখতিয়ারে আছে। বাদ দেয়া হয়েছে কেবল ব্যক্তিগত প্রকৃতির বিরোধগুলো। আত্মসাতের ক্ষেত্রেও কেবল ব্যক্তিগত প্রকৃতিরগুলোই বাদ দেয়া হয়েছে। এইগুলো পুলিশের কাজ। আগেও তাই ছিল। ২০১৩ সালের নভেম্বরে এগুলো ঢালাওভাবে দুদকের তফসিলে ঢুকে পড়েছিল। দুদকের কাজ হবে বাছাই করা, বড় বড় দুর্নীতি নিয়ে- যেগুলো দুদক ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। সব ফৌজদারী অপরাধ দুদকের কাছে দিলে তো পুলিশের কাজ থাকে না। আর তাহলে দুদককেও পুলিশের মত থানায় থানায় ছড়িয়ে দিতে হবে। তার ফলে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান শিথিল হয়ে পড়বে। কমিশনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। পুলিশের ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে দূর করা প্রয়োজন। পুলিশের পৃথক একটি তদন্ত বিভাগের কথা এবং তার দায়বদ্ধতা আদালতের কাছে থাকার কথা অনেক আগে থেকেই উঠেছে। সেটি করা প্রয়োজন। তাহলে পুলিশের প্রতিও আস্থা আসবে। পুলিশের কাছ থেকে দুদকে এনে দেয়াটা তো কোন সমাধান হতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় চলে আসে- যা আপনারা খেয়াল করছেন না, তাহল মানিলন্ডারিং। মানিলন্ডারিং এর অপরাধ ২০০৭ সাল থেকে দুদকের কাছে দেয়া হয়। ২০১৫ সালের শেষ দিকে এর বেশিরভাগ অংশ পুলিশের কাছে, কিছু অংশ কাস্টমস ও অন্যদের কাছে চলে গেছে। মানিলন্ডারিং-এর মামলায় দুদকের বেশ কিছু সফলতা আছে। অন্যদের কাছে কী অবস্থা? সন্ত্রাসী অর্থায়নের অপরাধ ২০০৯ সাল থেকে পুলিশের কাছে আছে, তা থাকাই প্রযোজন। কিন্তু এরকম মামলার কথা খুব একটা শোনা যায় না।

ইন্সুরেন্সনিউজবিডি:  অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার পুলিশের হাতে চলে যাওয়ার পরও বীমাখাতের বেশ কিছু অনুসন্ধান দুদক করছে। বিশেষ করে ১৭টি বীমা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের প্রায় পৌনে ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। এটির সর্বশেষ অবস্থা কি ?

মঈদুল ইসলাম: না, বীমা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আসে তা দুদকের তফসিলে পড়ছে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধগুলো দুদকের তফসিলে রাখা হলেও সেখানে বীমা কোম্পানীকে রাখা হয়নি। আবার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায়ও এগুলো পড়ছে না। তাই দুদকের তফসিলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে বীমাকেও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন। বীমাখাতের দুর্নীতিকে দুদকের তফসিলের আওতায় আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অহরহ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই  দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে। মনগড়া খাতে ব্যয় দেখিয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে।  প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা এ অর্থ হাতিয়ে নামে-বেনামে গড়ে তোলেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। বৃহৎ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্পদ অনুসন্ধানই এর প্রমাণ। ১৭ কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পদ বিবরণী চাওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল। এটির অগ্রগতি কি ?

মঈদুল ইসলাম: দুর্নীতি এখন বোধ হয় কিছু মানুষের সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে এখানে। সমান্যতম সততাও দেখাতে চাইছেন না তারা। যার যেখানে যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সবটুকু লাগাতে চাইছেন দুর্নীতির কাজে। ছোট কর্মচারী, বড় কর্মকর্তা, ছোট ব্যবসায়ী, বড় শিল্পপতি, সব স্তরেই এই অবস্থা। দুর্নীতি করে অনেকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। দুদক যে কারো অবৈধ সম্পদের খোঁজ করতে পারে, বীমা ব্যবসায়ীদেরটাও পারে। এই এখতিয়ার বলে দুদক নিজস্ব আইনের ২৬(২) ধারায় বীমাখাতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। দুদকের একাজে আয়কর বিভাগ সহযোগী হতে পারত। কিন্তু, দুঃখের বিষয় আয়কর আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আয়কর বিভাগ যা মেনে নিয়েছে তা নিয়ে আর প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু, আয়কর বিভাগের মেনে নেবার মধ্যেও যদি ফাঁকি থাকে? একজন কর্মচারী বা কর্মকর্তা- তার নিজের কোন বাড়ী, গাড়ি নেই; তার স্ত্রী ভুষিমালের, রাখিমালের ব্যবসা করে বাড়ী, গাড়ীর মালিক! তাহলে তিনি কোথা থেকে মাল কিনলেন, কোথায়, কবে, কার কাছে বিক্রী করলেন তার হিসাবটা তো পরীক্ষা করতে হয়। সে হিসাব আয়কর বিভাগেও দেননি। কারো সম্পদের উৎস যদি হয় কেবলই প্রতি বছর লাখ টাকা নগদ দান গ্রহণ– যার কোন দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণ নেই, তাহলে? আর যদি কেউ উৎসই না দেখান? সংবিধানে আছে, অনুচ্ছেদ ২০(২), কেউ অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে পারবে না এমন ব্যবস্থা রাষ্ট্র করবে। সবার সম্পদের উৎস বৈধ আয়ের হতে হবে। আয়কর বিভাগের শুভঙ্করী থেকে বের হতে হবে। এ প্রসঙ্গে ট্রুথ কমিশনের মার্জনার কথা স্মরণ করুন, দুর্নীতিবাজদেরও ট্রুথ কমিশনে মার্জনা নেবার আইন করা হয়েছিল, অনেকেই মার্জনা নিয়েছিলেন। কিন্তু, আপিল বিভাগ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েছে ওই মার্জনা বৈধ নয়। তাদের আবার বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুতরাং, আয়করের মেনে নেয়ায় শেষ কথা হতে পারে না।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: বীমা প্রতিষ্ঠান (লাইফ-ননলাইফ),  বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বর্তমান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বহুমাত্রিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এর দুয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে দুদকে। আইডিআরএ’র সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তিও দেয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও তাকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এটি কি দুদকের আইনগত সীমাবদ্ধতা নাকি অনুসন্ধানের দুর্বলতা ?

মঈদুল ইসলাম: এর উত্তর বোধ হয় একটু আগেই দেয়া হয়ে গেছে।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: দুর্নীতি দমন দুদকের আইনগত প্রধান প্রতিশ্রুতি হলেও সম্প্রতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এতে দুর্নীতি দমন কিংবা জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি না ?

মঈদুল ইসলাম: এখন যে কাজটা হচ্ছে তাকে ঠিক প্রতিরোধ বলা যাবে না, এটি বরং প্রচারণা, সচেতনা সৃষ্টির প্রয়াস। প্রতিরোধ হল সেটা যেখানে অপরাধ সংঘটনের প্রচষ্টাকালে, পরিকল্পনাকালে হস্তক্ষেপ করা হবে। দুদক আইনের তফসিলে দুর্নীতির প্রচেষ্টা এবং পরিকল্পনাও অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনাকালেও গ্রেফতার করে মামলা করা যাবে। কিন্তু, এখন পর্যন্ত কোন প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা চিহ্নিত হয়নি, কোন মামলা হয়নি। সেদিকে খেয়ালও করা হচ্ছে না। এদিকে নজর দেয়া দরকার। প্রচারণার, সচেতনা সৃষ্টির প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু, তা মূল কাজকে যেন ব্যহত না করে। দুদকের আইন আরোপিত দায়িত্ব হচ্ছে দুর্নীতির অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত করে প্রসিকিউট করা, বিচারে সোপর্দ করা। এ কাজটিতে আর কারো এখতিয়ারই নেই, করতেই পারবে না। এখন দুদক যদি কোনটা প্রসিকিউট করতে না পারে, তাহলে সেটা আর কারো করার সুযোগ নেই। অনুসন্ধান করার, তদন্ত করার লোকবল যা দুদকের আছে তা তো যথেষ্ট নয়। এই লোকেরাই প্রচারণার কাজে ব্যস্ত থাকলে তো অনুসন্ধান, তদন্ত কাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।  কিন্তু, প্রচারণার, সচেতনা সৃষ্টির কাজ তো বাদও দেয়া যাবে না। এজন্যই এই প্রচারণার পৃথক লোকবল দরকার, না হলে এনজিওদের সহযোগী হিসেবে নেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।।

ইন্সুরেন্সনিউজবিডি: দুর্নীতির মামলা আমলে নেয়ার পরবর্তী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির একটি সময়সীমা বেধে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। এ উদ্যোগের ফলে দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তিতে কোনো সুফল এসেছে কি না ?

মঈদুল ইসলাম: এ সময়সীমা সুপ্রীম কোর্ট বেঁধে দেননি, এটা আইনেই বাঁধা আছে। এটা অনুসরণ করার তাগিদ দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট। দুর্নীতির মামলা বিচারের জন্যই স্পেশাল জজ আদালত সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু, ২০০৩ সালের পর থেকে এসব আদালতে অন্যান্য মামলাও আসছে। অন্য মামলার ভিড়ে দুর্নীতির অপেক্ষাকৃত ঝামেলার মামলাগুলো চাপা পড়ে যায়। আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সুপ্রীম কোর্ট তা অনুধাবন করে স্পোশাল জজদের প্রতি এ তাগিদ দিয়েছেন। এর ফলে অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে, স্পেশাল জজ সাহেবরা সচেতন হয়েছেন, সচেষ্ট হয়েছেন। এ বছর বেশি সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হবে, আশা করছি।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: দুদক আইনে একটি নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিটের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন কিছু উদ্যোগও নিয়েছিল বলে জানি। এটির অগ্রগতি কি ?

মঈদুল ইসলাম: হ্যাঁ । নিজস্ব স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিটের কথা আইনে আছে, এবং তা না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত আইনজীবী দ্বারা মামলা পরিচালনার ব্যবস্থাও আছে। আমরা এখনও অস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট তৈরির কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু, অর্গানোগ্রামে প্রসিকিউটরের পদ আছে মাত্র ১০টি। আমার মামলা বিচারের আদালত আছে ৬৪ জেলায় ৬৪টি, ৬ মহানগরে আরোও ৬টি, ১৯টি বৃহত্তর জেলায় আরোও ১৯টি এবং ঢাকায় আরোও ১০টি- এই ৯৯টি। এরপর প্রত্যেক অতিরিক্ত দায়রা জজ, প্রত্যেক যুগ্ম দায়রা জজও স্পেশাল জজ হিসেবে কাজ করতে পারেন। এরপর সুপ্রীম কোর্টে আছে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ। মাত্র ১০ জন প্রসিকিউটর দিয়ে কাজ চালান কতটা অসম্ভব বুঝুন ! এর পরে আছে প্রসিকিউটরদের যোগ্যতা, বেতন, প্রমোশন ইত্যাদি বিষয়ের নীতিমালা নির্ধারণ। কাজটা খুব একটা সহজ নয়। সরকার অনেকদিন থেকে ভাবলেও এখনও পর্যন্ত এ সার্ভিস তৈরী করে উঠতে পারেনি।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি: দুদকের অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচারে আইনগত কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কি না ? করণীয় কি ?

মঈদুল ইসলাম: এসব বিষয়ে আইনগত সীমাবদ্ধতা যা আছে তার চেয়ে বেশি আছে প্রয়াগে। যারা প্রয়োগ করেন তাদের মন, মানসিকতা আর বিচার-বিবেচনায়। অনুসন্ধান, তদন্ত যারা করেন তারা প্রয়োজন, অপ্রয়োজন বিবেচনা না করেই নোটিশ হাঁকান। বিষয়টি চলে যায় উচ্চ আদালতে; আর সেখানে গেলে বেশ কয়েক বছর লেগে যায় নিষ্পত্তি হতে। যদিও শেষ পর্যন্ত এসবের বেশির ভাগ আমাদের পক্ষেই আসে কিন্তু, যে সময় চলে যায় তাতে অনেক কিছুই চলে যায়। ফলাফল হয় শূন্য। এই সময় ক্ষেপণই একটি বড় সমস্যা, বড় সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই কেবল নোটিশ দেয়া, উচ্চ আদালতে গেলেও যেন তা প্রথমেই বাছাই করে নেয়া হয়, আর যেটা নেয়া হবে সেটা যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এই মানসিকতায় সচেষ্ট হতে হবে সবাইকে।

সামাজিক, রাজনৈতিক আবহের পারিপার্শ্বিকতার কথা শুরুতেই বলেছি। বিচারের বিষয়েও কিছু কথা এর আগেই বলেছি। বিচারে আর একটি সমস্যা আমরা পাই, তাহল তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে অপরাধী দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থ আত্মাসাৎ করেছে, প্রচুর অবৈধ সম্পদ করেছে কিন্তু, চার্জসীট দেবার আগেই অপরাধী মারা যায়, কিম্বা চার্জসীট দেবার পরে বিচারের রায় হবার আগে মারা যায়, তখন মৃত মানুষের তদন্ত, বিচার, সবই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু, সাথে সাথে দুর্নীতিলব্ধ বিপুল পরিমাণ সম্পদও ছাড়া পেয়ে যায়। বিচার হলে এ সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়ে রাষ্ট্রের হত। রাষ্ট্র, তথা জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে, লাভবান হচ্ছে দুর্নীতিবাজের ওয়ারিশরা। এটি বন্ধ হওয়া দরকার, ওই সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান দরকার।

আরেকটি বিষয়- দুদককে এখন ৬৪ জেলায় মামলা সামলাতে হয়। অথচ মামলার সংখ্যা বেশি নয়, সাড়ে তিন হাজারের মত- হাতে গোনা দু'চারটি কোর্টের মত মামলা! যদি ঢাকার ১০টি বিশেষ আদালতকে সব মামলা গ্রহণের ও বিচারের এখতিয়ার দেয়া যেত, কিংবা, বড়জোর প্রতিটি বিভাগের বিশেষ আদালতে- আমি প্রশাসনিক বিভাগের কথা বলছি, সব মামলা গ্রহণের ও বিচারের এখতিয়ার দেয়া যেত- এসব আদালতে অন্যকোন মামলা না দিয়ে, তাহলে মামলাগুলো দ্রুত ও কার্যকর নিষ্পত্তি হত। তেমনি, সেই সাথে দুটি বা তিনটি পৃথক আপীল আদালত করা যেত- মামলার মাঝপথে যাবার সুযোগ বন্ধ করে বা সীমিত করে এবং এসব বিষয়ও এসব আপীল আদালতের এখতিয়ারে দিয়ে, তাহলে দুর্নীতির মামলাগুলোর কার্যকর বিচার করা যেত- সাজার হার বাড়বে, সাজা কার্যকরও করা যাবে।