বাংলাদেশের বীমা শিল্প: বিশ্বে অনগ্রসরতমদের অন্যতম

মো. নূর-উল-আলম: অর্থনীতির আকার অনুসারে বাজার অর্থনীতির দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম এবং ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩১তম। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি উদিয়মান অর্থনীতির দেশের অন্যতম একটি। আইএমএফ’র মতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে দ্বিতীয় দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ।

অথচ বীমা শিল্পে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান অনগ্রসরতম দেশের তালিকায়। জীবন ও সাধারণ বীমা মিলিয়ে এখনো বাংলাদেশের বীমা বাজারের পরিসর তেমন বড় নয়। বিশ্বের মধ্যে বীমা শিল্পে আমাদের অবস্থান ৭৬তম। বলতে গেলে, বৈশ্বিক বীমা শিল্পের তুলনায় বাংলাদেশের বীমা শিল্প খুবই নগণ্য যা দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মাত্র। এখানে মাথাপিছু বীমা ব্যয় কেবল ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। জিডিপি অনুপাতে বীমা প্রিমিয়াম রয়ে গেছে মাত্র দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে দশমিক ৭ শতাংশ জীবন বীমা এবং বাকি দশমিক ২ শতাংশ সাধারণ বীমা। 

উচ্চ কমিশনের বিনিময়ে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, কম পুনর্বীমা, দেরিতে দাবি নিষ্পত্তি, অন্যায্য প্রভাব, খুবই দুর্বল জনশক্তির মান, পরিচালন দুর্বলতা, ব্যাংকারদের কমিশন বাণিজ্য, সার্ভেয়ারদের মনগড়া সার্ভে এবং বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এ খাত অগ্রসর হতে পারছে না । প্রবাসী শ্রমিক-রেমিট্যান্স প্রেরণকারী থেকে কৃষিজীবীসহ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো বীমার আওতার বাইরে রয়ে গেছে।

অধিকন্তু ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে বর্তমানে ৭৮টি নিবন্ধিত বীমা কোম্পানি বীমা ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মধ্যে ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানি। অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরো দু’টি বীমা কোম্পানি। পার্শ্ববর্তী বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতেও এত সংখ্যক বীমা কোম্পানি নেই। ভারতে বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৬০টি। 

বাংলাদেশের বাজারের আকৃতি অনুযায়ী নিবন্ধিত বীমা কোম্পানির এ সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। অধিকন্তু সাধারণ বীমার ৩৬ শতাংশই শীর্ষ চার কোম্পানি বা করপোরেশনের দখলে। এবং জীবনবীমা নিয়ন্ত্রিত হয় বিদেশী কোম্পানি মেটলাইফ আলিকো দ্বারা।  অধিকাংশ কোম্পানিই এখনো টিকে থাকার লড়াই করছে ।  সাধারণ বীমার বাজার শাখা-চালিত । অন্যদিকে জীবন বীমা এজেন্ট-চালিত ।  কিছু জীবনবীমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় নিজেদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রবর্তিত অধিকাংশ শাখা এখন প্রায় নিভু নিভু। 

এটা নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট ও অসংগঠিত কোম্পানির পরিচালনা ক্রমেই কঠিন হবে। বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ কিংবা অন্য একই ধরনের দেশে যা ঘটছে, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের বীমা খাতের আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

একটা দেশে বীমা খাত কতটা শক্তিশালী তা বুঝতে পেনেট্রেশন রেট আমাদের সাহায্য করে। অনুরুপভাবে বাংলাদেশের বীমা শিল্প উন্নয়নের মাত্রার  নির্দেশক হল এখাতের পেনেট্রেশন রেট বা প্রভাব হার  ।একটি নির্দির্ষ্ট বছরের মোট অবলিখনকৃত প্রিমিয়াম এবং জিডিপির তুলনা করলে পেনেট্রেশন রেট বা প্রভাব হার পাওয়া যায়।

লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বীমা মার্কেট লয়েড সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বাংলাদেশকে সাধারণ বীমা শিল্পে সবচেয়ে কম বীমাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটিই বীমা বিষয়ক সাম্পতিকতম কোন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন। লয়েডের এর আগের সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালে। লয়েডের মতে বাংলাদেশের এমন অবস্থান কারণ প্রতিবছর দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তার জিডিপির দশমিক ৮ শতাংশ হারায়।

সাধারণ বীমা পেনেট্রেশন রেট (%)

দেশ

২০১৮

২০১২

নেদারল্যান্ড

৭.৭

৯.৫

দক্ষিণ কোরিয়া

৪.৬

যুক্তরাষ্ট্র

৪.৩

৪.১

ভারত

০.৯

০.৭

ভিয়েটনাম

০.৮

০.৯

ফিলিপাইন

০.৬

০.৪

ইন্দোনেশিয়া 

০.৫

০.৬

বাংলাদেশ

০.২

০.২

 

লয়েড আরো মতপ্রকাশ করেছে যে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে বাংলাদেশ। অথচ এ বিষয়ে দেশটির কোন প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না এবং ফান্ড রিকভারি বা তহবিল পুনঃরুদ্ধার সামর্থ্যের দিক থেকেও বাংলাদেশ সবচেইতে পিছিয়ে।

লয়েডের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আন্ডার ইন্স্যুরেন্স বা বীমা ঘাটতির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের  বীমা পলিসিগুলো বীমাকৃত সম্পদের মূল্যের চাইতে কম ঝুঁকি বহন করে। প্রতিবেদনটিতে ৪৩টি দেশের সাধারণ বীমা শিল্পের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে আরো তুলে ধরা হয়েছে আন্ডার ইন্স্যুরেন্স বা বীমা ঘাটতির একটি তুলনামুলক চিত্র, যেখানে বাংলাদেশের আন্ডার ইন্স্যুরেন্সের পরিমাণ সবচাইতে বেশি যার পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা বাংলাদেশের জিডিপির ২.১% বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। 

লয়েডের মতে বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাতে বীমা প্রিমিয়াম মাত্র ৮ ডলার। তার মূল কারণ অধিকাংশ নাগরিক এখনও রয়ে গেছে বীমার আওতার বাইরে। নাগরিকদের এই বীমা অনাগ্রহের কারণ অর্থিক সামর্থ্যহীনতা নয় বরং এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান স্বল্পতা এবং আস্থাহীনতা।

পৃথিবীর অনেক দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা সেবার প্রচলন করে সুফল পেয়েছে। ব্যাংকান্স্যুরেন্স (ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কোনো বীমা প্রডাক্ট বিক্রি) বিষয়ে করেছে আইন এবং নীতিমালা। অথচ বাংলাদেশে ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকলেও তাদের এখনো ব্যাংকান্স্যুরেন্স বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়নি। ব্যাংকান্স্যুরেন্স বীমা শিল্পের প্রতি জনগণের অনাগ্রহ এবং আস্থাহীনতা অনেকাংশে লাগব করবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: মো. নূর-উল-আলম, এসিএস, এমবিএ, এমএ (ইং), এলএলবি

ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড 

ইমেইল: csnoor.bd@gmail.com 

মোবাইল: ০১৬১০ ১২৩২২৩