বীমা কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক: ক্ষমতা ও পারিশ্রমিকহীন কাগুজে বাঘ (পর্ব-১)

মো. নূর-উল-আলম, এসিএস: সহজ ভাষায় বলতে হয় সংখ্যালঘু শেয়ারমালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই কোম্পানি আইন এবং কোম্পানি পরিচালনা সংক্রান্ত সকল বিধি-বিধানের সূত্রপাত। স্বতন্ত্র পরিচালক তেমনই একটি যুগান্তকারী ধারণা। কিন্তু, বাংলাদেশে বীমা কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দ কতটুকু স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা তথা সংখ্যালঘু শেয়ারমালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারেন তা বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

আলোচ্য প্রবন্ধে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিধি-বিধানে বর্ণিত স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দের যোগ্যতা, নির্বাচন প্রক্রিয়া, তাদের নিয়োগ এবং তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের আলোকে তাদের ক্ষমতার অনুশীলন তথা পরিচালনা পর্ষদে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালকবৃন্দের ওপর অর্পিত ক্ষমতার যথাযথ অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ এবং তাদের কার্যকর নিরপেক্ষতা বৃদ্ধির উপায়সমূহ তুলে ধরা হলো।

বাজার ব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে সাথে মূলধনের প্রয়োজনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা এবং পরিচালন পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে। বহুবিদ কারণে যৌথমূলধনী কোম্পানি ব্যবসায় সংগঠনের এই বিবর্তনের সর্বশেষ এবং জনপ্রিয়তম সংযোজন। সীমিত দায়, সহজে মালিকানা হস্তান্তরযোগ্যতা এবং চিরন্তন অস্তিত্ব এর অন্যতম প্রধান কারণগুলোর কয়েকটি মাত্র। যৌথমূলধনী কোম্পানির অসংখ্য লোকের মালিকানা থাকলেও সবাই কোম্পানি পরিচালনার সুযোগ পান না।

প্রতিবছর অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল শেয়ার মালিকের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সকল প্রতিনিধি তথা পরিচালক বা ডিরেক্টর তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত পর্ষদসভায় গৃহীত যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যৌথভাবে কোম্পানির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তার আগেই তারা পরিচালনা পর্ষদ সভা পরিচালনার জন্য তাদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। বীমা আইন অনুযায়ী একজন ভাইস-চেয়ারম্যানও নির্বাচিত করতে হয়।

পরিচালনা পর্ষদ সভা প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় না; বিরতি দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বীমা আইন ২০১০ অনুযায়ী দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য যোগ্য কাউকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়। তিনি নিয়মিত অফিস করেন, বেতন পান এবং তার কাজের জন্য তাকে পরিচালনা পর্ষদের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। তিনি বেতনভুক্ত এবং পদমর্যদা অনুযায়ী নন-ভোটিং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে বিবেচিত হন।

বীমা কোম্পানির অন্যান্য পরিচালকবৃন্দ তথা নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরা শুধুমাত্র পর্ষদ সভায় উপস্থিত থাকার জন্য ‘ফি’ প্রাপ্য হন। সাধারণভাবে, এছাড়া পরিচালকবৃন্দ অন্যকোন প্রকাশ্য অথবা গোপন অর্থিক সুবিধা বা অফিস অব প্রফিট গ্রহণ করতে পারেন না। এটি হলো যৌথমূলধনী কোম্পানি হিসেবে বীমা কোম্পানি পরিচালনায় পারিতোষিক বিষয়ক প্রচলিত নিয়ম।

কিন্তু যেহেতু পরিচালকরা প্রত্যক্ষভাবে বীমা কোম্পানি পরিচালনায় বিভিন্ন আর্থিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেন তাদের পক্ষে সহজেই বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা অসম্ভব নয়। যা সম্পূর্ণভাবে সংখ্যালঘু শেয়ারমালিক তথা বিনিয়োগকারীর স্বার্থ বিরোধী। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইউএসএ, ইউকে এবং অস্ট্রেলিয়ার মত উন্নত দেশগুলোতে অনেক তালিকাভুক্ত পাবলিক কোম্পানিতে সংগঠিত বিভিন্ন আর্থিক কেলেংকারী প্রকাশ্যে আসার পর, কোম্পানিগুলোর পরিচালনগত ব্যাপক ত্রুটি জনগণের সামনে ধরা পড়ে।

ফলে দাবি উঠে ‘করপোরেটগভর্নেন্স’ বা কোম্পানি তথা প্রতিষ্ঠানিক সুশাসনের। তখন প্রথমবারের মত পর্ষদ সভায় সংযোজিত হয় একধরনের নতুন পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক। যিনি একাধারে একজন নন-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং নন-শেয়ারহোল্ডিং ডিরেক্টর। এর একমাত্র কারণ ছিল নন-এক্সিকিউটিভ স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতা প্রদানের মধ্যদিয়ে ফাইন্যানশিয়াল রিপোর্টিং, অডিট এবং রেমুনারেশন কমিটিতে তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। যাতে কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থ তথা সকল বিনিয়োগকারী বিশেষ করে সংখ্যালঘু শেয়ারমালিকদের স্বার্থে তারা সব ধরনের কনফ্লিক্ট  অব ইন্টারেস্ট অথবা যে কোন ধরণের অনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় উন্নতদেশসমূহ ইতোমধ্যেই স্বতন্ত্র পরিচালকদের ক্ষমতায়নের জন্য নতুন নতুন চিন্তা এবং গবেষনার ফল পেতে শুরু করেছে। অথচ আমরা রয়ে গেছি সেই তিমিরেই; সংখ্যাগুরুদের দ্বারা পরিচালিত বীমা কোম্পানির যুগেই! বরং বর্তমানে আইনের মারপ্যাঁচে সংখ্যাগুরুরা আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে! কারণ, আমাদের দেশে বীমা কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালকরা ‘পর্ষদ সভা’য় সংখ্যাগুরুদের ঈশারায় কাজ করেন। যা প্রকারান্তে সংখ্যাগুরুদের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করেছে। বিষয়টি বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

স্বতন্ত্র পরিচালক শব্দটির সাথে বাংলাদেশের পরিচয় ২০০৬ সালে যখন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (BSEC) পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) প্রণয়ন করে। এতে প্রথমবারের মত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য কম্প্লাই বেসিসে পর্ষদসভার ১/১০ ভাগ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান রাখা হয়।

২০১২ সালের রিভাইজড করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) এ সেটি ১/৫ ভাগ নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালে করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (CGG) প্রতিস্থাপিত করে করপোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) প্রণয়নকরা হয়। সেটিতেও পর্ষদসভার ১/৫ ভাগ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান রাখা হয়। বীমা আইন ২০১০ এর ধারা-৭৬ অনুযায়ী ‘পর্ষদ সভা’র ১/১০ বা বিশজনে দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্বতন্ত্র পরিচালক ধারণাটি আমাদের দেশে দেড় দশকের বেশি পুরোনো। কিন্ত যে উদ্দেশ্যে বীমা কোম্পানিসমূহে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে সে লক্ষ্য কতটুকু পুরণ হচ্ছে, সে প্রশ্ন এসেই যায়। স্বতন্ত্র পরিচালকরা আদৌ যথাযথভাবে বীমা কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে অবদান রাখতে পারছেন কি-না সেটিও ভাববার সময় এসেছে।    

আমাদের এখানে যদিও তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের বিধান রয়েছে কিন্তু নিয়মের ফাঁকগলে তারা আবার সংখ্যাগুরুদের পছন্দেই নির্বাচিত হন। ফলে সংখ্যাগুরুদের সামনে তারা কখনোই সংখ্যালগু তথা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কাজ করতে পারেন না। তাদের নাম সর্বস্ব ভূমিকার কারণে সংখ্যাগুরুরা বরং এখন আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং পরিচালনা পর্ষদ হয়ে পড়ছে আরো বেশি একপেশে।

বীমা আইন, ২০১০ বীমা কোম্পানিতে ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ এর সংখ্যা নির্দিষ্ট করেছে কিন্তু তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিষয়ে নিরব রয়েছে। ফলে অধিকাংশ অতালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানি ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন মান বজায় রাখেনি। অপরদিকে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানিগুলো করপোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) খণ্ডিতভাবে অনুসরণ করে এ বিষয়ে দায় সারছে।

কেননা, এ বিষয়ে ২০১৮ সালে করপোরেট গভর্নেন্স কোড (CGC) পর্যালোচনা করে দেখা যায়- কোডের ১(২) এবং ১(৩) নং শর্তে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংজ্ঞা, আনুপাতিক সংখ্যা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ক পূর্বশর্ত বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু নির্দষ্ট বিষয়ে ১০ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা শর্ত হিসেবে বেধে দেয়া হয়েছে। ১(৩)(ঘ) শর্তে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে উপরোক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত শিথিল যোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে। (চলবে....)

লেখক: সহযোগী সদস্য, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (ICSB)

ইমেইল: csnoor.bd@gmail.com

সেল নং: +৮৮০ ১৬১০ ১২৩২২৩