বিশ্ব অর্থনীতি কি বীমাহীন ভবিষ্যতের পথে

রাজ কিরণ দাস: বৈশ্বিক অর্থনীতির গভীর কাঠামোর ভেতর একটি স্তম্ভ নীরবে কিন্তু শক্তিশালীভাবে কাজ করে চলে- বীমা শিল্প। এই শিল্পকে আধুনিক সভ্যতার ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু বলা হয় শুধু তার আর্থিক সক্ষমতার কারণে নয়, বরং দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্যের সুরক্ষায় এর সর্বব্যাপী ভূমিকার জন্য। তবুও প্রশ্ন সামনে আসে যে, যদি এই শিল্প কোনও কারণে ভেঙে পড়ে, তখন পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা কেমন হবে?
বীমা শিল্প আসলে কেবল ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি নয়; এটি বিশ্বের আর্থিক প্রবাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা, বন্ড মার্কেটের কার্যকারিতা, এমনকি অবসরকালীন তহবিলের নিরাপত্তাও অনেকাংশে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এই ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা দ্রুত ভেঙে পড়বে, বাজারে অনিশ্চয়তা ছড়াবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। আস্থা হারানো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সবচেয়ে বড় শত্রু- এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন হবে আরও দীর্ঘ এবং কঠিন।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাব আরও গভীর। দুর্যোগ, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার মতো মুহূর্তগুলোতে বীমা যে আর্থিক সুরক্ষা দেয়, সেটাই অনেক পরিবারের শেষ ভরসা। সেই সুরক্ষা না থাকলে সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার মৌলিক স্থিতি বজায় রাখতে হোঁচট খাবে। চিকিৎসা সেবার অস্বাভাবিক ব্যয়ভার তাদেরকে চিকিৎসা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। হাসপাতালগুলোতে বেড়ে যাবে অনাদায়ী বিল, আর সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা অসম ভারে বিপর্যস্ত হতে থাকবে। এর ফল কেবল চিকিৎসা খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজের অগ্রগতির ধারা দুর্বল হয়ে পড়বে।
একইভাবে, বাসস্থান ও সম্পত্তির সুরক্ষাও সংকুচিত হয়ে যাবে। আগুন, বন্যা, ঝড়- যে কোনও দুর্ঘটনা পরিবারকে এক অনতিক্রম্য আর্থিক সংকটে ফেলতে পারে। বাসস্থান হারানোর শঙ্কা, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা এবং বাজারের অস্থিরতা রিয়েল এস্টেট খাতকে অনিশ্চয়তার এক অন্ধকার স্রোতে ঠেলে দেবে। এ অবস্থায় নতুন নির্মাণ, বিনিয়োগ, এমনকি শহর ও অবকাঠামোর উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে।
বাণিজ্যিক খাত বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে পড়বে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে যতটা উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে, ঝুঁকি-প্রশমনেও ঠিক ততটাই বীমার ওপর ভরসা করে। এই সুরক্ষা হারালে ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান- সবাইকে অস্বাভাবিক ঝুঁকির সামনে দাঁড়াতে হবে। একটি দুর্ঘটনা বা আইনি দাবি একটি ব্যবসাকে মুহূর্তেই দেউলিয়া করে ফেলতে পারে। চাকরির বাজার সংকুচিত হবে, উদ্যোক্তা-সংস্কৃতি দুর্বল হবে, আর কমে যাবে উৎপাদনশীলতার গতি।
এই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উঠে আসে যে বীমা শিল্প সমাজের জন্য একটি অদৃশ্য নিরাপত্তা বলয়। এটি শুধু অর্থনৈতিক স্থিরতা রক্ষা করে না; বরং মানুষের মানসিক নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বীমাহীন পৃথিবী আসলে এমন এক পৃথিবী, যেখানে প্রতিটি ঝুঁকি ব্যক্তিগত দায়িত্বের চরম ভারে রূপান্তরিত হয় এবং প্রতিটি ক্ষতি সমাজের বৃহত্তর কাঠামোকে নাড়া দেয়।
এই কারণেই নির্ভরযোগ্য বীমা সুরক্ষা শুধু একটি আর্থিক পণ্য নয়- এটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। যে প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক পরামর্শ, বাস্তবসম্মত কভারেজ ও সহানুভূতিশীল সেবা প্রদান করে, তারা কেবল বীমা ব্যবসায় নয়, বরং সমাজের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অন্যতম সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও সঠিক বীমা কাঠামো আমাদের ঝুঁকি-মোচনের ক্ষমতাকে দৃঢ় করে এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও অর্থনীতি একইসঙ্গে সুরক্ষা পায়।




