তাকাফুল চুক্তির শরীয়াহ নীতিমালা ও বিধিবিধান
কাজী মো: মোরতুজা আলী:
তাকাফুল বা ইসলামী বীমা একটি বৈধ শরীয়াহ ভিত্তিক চুক্তি। চুক্তির সহজ সংজ্ঞা হলো এটা আইনি বাধ্যবাধকতাপূর্ণ সমঝোতা। অন্য কথায়, চুক্তি হলো আইনে প্রয়োগযোগ্য সমঝোতা। সাধারণভাবে, প্রায় সব চুক্তিই আইনি বাধ্যবাধকতাপূর্ণ, যদি না তাতে নিচের তিনটি ব্যতিক্রমের কোনো একটি থাকে: ক. আইনি বাধ্যবাধকতাপূর্ণ না হলে কাউকে জোর করে চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়। খ. পুরোপুরি সামাজিক কিংবা ঘরোয়া বিষয় নিয়ে পরিবার, সদস্য বা বন্ধুদের মধ্যকার সমঝোতা। গ. যেসব চুক্তি অস্তিত্বহীন এবং সেগুলো থেকে উদ্ভূত কোনো কিছুর আইনগত ফল নেই।
বৈধ চুক্তির অপরিহার্য বিষয়গুলো হলো: ক. চুক্তির পক্ষগুলোকে অবশ্যই চুক্তি করার সক্ষমতা থাকতে হবে; খ. চুক্তির লক্ষ্যটি অবশ্যই আইনসম্মত হতে হবে; গ. অবশ্যই বৈধ প্রস্তাব ও তা গৃহীত হতে হবে; ঘ. আইনি বাধ্যবাধকতাপূর্ণ সমঝোতা হতে হবে; ঙ. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে এবং চ. কিছু বিবেচনা অবশ্যই থাকতে হবে।
শরীয়াহ স্কলারগণ বৈধ চুক্তির এসব অপরিহার্য বিষয়কে বাতিল করেন না। প্রথমে, আমরা বৈধ চুক্তির কিছু শরীয়াহ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। ইসলামী আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে চুক্তির বৈধতার জন্য বিবেচ্য লেনদেনটি হালাল না হারাম সেটা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনবিদের মতে, চুক্তির মর্যাদা প্রশ্নে মাত্র দুটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে: বৈধ ও অবৈধ (সহিহ ও গায়ের সহিহ)। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যে চুক্তির সব অপরিহার্য শর্ত পূরণ করা হয়েছে সেটি হবে বৈধ চুক্তি। বৈধ (সহিহ) চুক্তি ওই ধরনের চুক্তি যা করার জন্য শরীয়াহ যেসব আইনগত সংশ্লিষ্টতা আরোপ করেছে তা পূরণ করে।
কোনো চুক্তি যদি চুক্তির শরীয়াহ শর্তাবলী লঙ্ঘন করে, তবে তা অবৈধ হবে। চুক্তিকে অবৈধ করার জন্য কিছু উপাদান রয়েছে। যেমন:
ক. বিক্রিত পণ্য যদি শরীয়াহ নিষিদ্ধ হয়।
খ. সম্পত্তিটি যদি বিক্রেতার পূর্ণ মালিকানায় না থাকে।
গ. সরবরাহ তারিখ, মূল্য ইত্যাদি বিষয়ে যদি ঘারার (অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা) থাকে।
ঘ. চুক্তিতে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর যদি চুক্তি বাস্তবায়নে আইনগত যোগ্যতা না থাকে।
হানাফি মাজহাবে চুক্তিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- (ক) সহিহ (বৈধ), ফাসিদ (নিয়ম-বহির্ভূত) ও বাতিল (অবৈধ)। এই ভাগ অনুযায়ী, ‘ফাসিদ’ হলো সহিহ ও বাতিলের অন্তবর্তীমূলক শ্রেণী। ফাসিদ চুক্তির ত্রুটি সংশোধন করা হলে সেটি বৈধ চুক্তিতে পরিণত হয়। ত্রুটিটি যদি মৌলিক হয় এবং সেটি সংশোধন করা না যায়, তবে তা বাতিল হয়ে যায়। বাতিল হলো এমন চুক্তি যা কোনো চুক্তি বৈধ হতে হলে যে অপরিহার্য উপাদানগুলো থাকতে হয়, তাতে কোনো ঘাটতি থাকে। অন্যদিকে ফাসিদ চুক্তি বৈধ নয়, কারণ এতে বৈধ চুক্তির মৌলিক উপাদানগুলোর বাহ্যিক নিষিদ্ধ কোনো উপাদান যুক্ত থাকে।
যেহেতু ত্রুটিপূর্ণ উপাদানটি প্রধান নয়, চুক্তিটি নিয়ম-বহির্ভূত তবে প্রধান উপাদানগুলোর সাথে যুক্ত বাহ্যিক নিষিদ্ধ উপাদানটি দূর করার মাধ্যমে তা সংশোধনযোগ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো পাগল কোনো মদ্যপ ব্যক্তির কাছে মদের দাম পরিশোধের জন্য শূকর বিক্রি করলে চুক্তিটি পুরোপুরি বাতিল হবে। কিন্তু এক গ্রাম স্বর্ণ যদি বিনিময় করা হয় দুই গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে, তবে তা নিয়ম-বহির্ভূত। কারণ এতে ওজনের বৃদ্ধির অস্তিত্ব রয়েছে। এই বৃদ্ধি দূর করা হলে চুক্তিটি বৈধ হয়ে যাবে।
চুক্তি নিয়ম-বহির্ভূত হওয়ার কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:
ক. বিক্রেতার জন্য ক্ষতিকর হবে এমন কোনো অপরিহার্য দ্রব্য বা সেবা বিক্রি করা।
খ. সরবরাহের মূল্য, সময়, পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে দ্ব্যর্থবোধকতা থাকা।
গ. পরিমাণ, মূল্য, নিশ্চয়তা, সরবরাহ, সময় ইত্যাদি ব্যাপারে অপর্যাপ্ত তথ্য বা তথ্যের অভাব।
ঘ. সুদের (রিবা) উপাদানের অস্তিত্ব চুক্তিকে অনিয়মিত করে।
ঙ. চুক্তি সম্পাদনে বলপ্রয়োগের অস্তিত্ব।
ইসলামী বীমা বা তাকাফুল চুক্তি বৈধ হতে হলে অবশ্যই নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করতে হবে:
ক. প্রস্তাব (ইজাব) এবং ওই প্রস্তাবের শর্তহীন গ্রহণ (কবুল) অবশ্যই থাকতে হবে। অবশ্য তাকাফুল চুক্তি হলো পারস্পরিক সহায়তা ও পারস্পরিক সুরক্ষার ভিত্তিতে দান-চুক্তি। তা-ই তাকাফুল চুক্তি হলো যারা একই সময়ে সুরক্ষা প্রদান ও গ্রহণ করছেন এবং তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার চুক্তি। তাকাফুল চুক্তি তাকাফুল প্রতিষ্ঠান ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনন্য সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এতে তাকাফুল প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণকারী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের প্রতি সকল বাধ্যবাধকতা যথাযথভাবে পালন করতে হয়।
খ. চুক্তির পক্ষগুলো ব্যক্তি, গ্রুপ বা আইনগত সত্তা হতে পারে, যদি চুক্তিতে প্রবেশ করতে তাদের আইনসম্মত সামর্থ্য রাখে। তাকাফুল চুক্তি এই বৈশিষ্ট্য পূরণ করে।
গ. চুক্তির উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুকে নির্দেশ করে। তাকাফুল চুক্তির ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু হলো ঝুঁকি কভারেজ।
ঘ. চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর কাছে চুক্তির প্রকৃতি, মান, পরিমাণ ও উদ্দেশ্য অবশ্যই জানা থাকতে হবে। এ কারণেই তাকাফুল চুক্তি হতে হবে স্বচ্ছ।
তাকাফুল ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের বীমাগ্রহীতা-বীমা প্রতিষ্ঠান সম্পর্ক নেই। পারস্পরিক সহায়তা ও পারস্পরিক সুরক্ষার উদ্দেশ্যে তাকাফুল চুক্তি মূলত হয়ে থাকে অংশগ্রহণকারী এবং অন্যান্য অংশগ্রহণকারীর মধ্যে। এই একতরফা চুক্তিতে অভিন্ন একটি তহবিল (তাবাররু) সৃষ্টির লক্ষ্যে দান করার প্রতিশ্রুতি দেয় মাত্র (গ্রাহক/অংশগ্রহণকারী) একটি পক্ষ।
তাবাররু প্রাথমিকভাবে দাতার ইচ্ছায় হয়ে থাকে। মুসলিম স্কলাররা তাকাফুলে সহযোগিতা করার লক্ষ্যকে তাকাফুল ব্যবস্থায় তাবাররু প্রদানকে অনুমোদন করেছেন। ক্ষতিপূরণ প্রদান কিংবা অংশগ্রহণকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় সকলের দান থেকে সৃষ্ট অভিন্ন তহবিল থেকে। শর্তসাপেক্ষ দান করা শরীয়ায় অনুমোদিত। এক্ষেত্রে দান একটি অ-বাণিজ্যিক চুক্তি, তবে এটা তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক উদ্যোগের সাথে সম্পর্কিত।
দান চুক্তি ছাড়াও তাকাফুলে অংশগ্রহণকারী ও তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক চুক্তি থাকে। এটাকে বলা হয় মুদারাবা চুক্তি, যেখানে তাকাফুল অংশগ্রহণকারীরা পুঁজি (চাঁদা) যোগান দেয় এবং তাকাফুল প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনাগত পরিসেবা প্রদান করে। এছাড়া ওয়াকালা চুক্তি রয়েছে, যেখানে তাকাফুল অংশগ্রহণকারীরা তহবিল সৃষ্টি করে তাকাফুল প্রতিষ্ঠানকে তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং তহবিলের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে থাকে। তাকাফুল প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে তহবিল ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করে। উদ্বৃত্তের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পারফর্মেন্স ফি-ও প্রদান করা হতে পারে। উদ্বৃত্ত নির্ধারিত হয় অংশগ্রহণকারীদের সব দাবি এবং প্রাসঙ্গিক সব ব্যয় মেটানোর পর অবশিষ্ট পরিমাণের ভিত্তিতে।
শরীয়াহ পরিচালনাব্যবস্থা এবং শরিয়াহ কাউন্সিলের ভূমিকা:
তাকাফুল চুক্তি, তাকাফুল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনন্য সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এতে তাকাফুল প্রতিষ্ঠানকে শরীয়াহ নীতিমালা অনুসরণ, আমানতদারীর দায়িত্ব পালন এবং সুবিবেচনা প্রসূত মান পূরণ করার প্রয়োজন হয়। শরীয়াহর বিধান ও নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য তাকাফুল কার্যক্রমে শরিয়াহ পরিচালনা-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
শরীয়াহ পরিচালনা-ব্যবস্থা বলতে বোঝায় এমন প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে শরিয়াহ প্রতিপালনের জন্য কার্যকর, স্বাধীন তদারকি নিশ্চিত করতে হয়। স্বাধীন তদারকির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কোনো মহলের কোনো ধরনের প্রভাব ছাড়াই সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং মতামত দিতে পারার সামর্থ্য। শরীয়াহ কাউন্সিল বা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পুরো সময় ওই সদস্যের পূর্ণাঙ্গ নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাগত স্বাধীনতা থাকতে হবে।
ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আইএফএসবি) ইসলামী আর্থিক পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের শরীয়াহ পরিচালনা-ব্যবস্থা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা ও নীতিমালার সুপারিশ করেছে। শরীয়াহ প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য তাকাফুল প্রতিষ্ঠান নিচের নির্দেশ ও নীতিমালা অনুসরণ করতে পারে। এসব নীতিমালা হচ্ছে:
ক. সংশ্লিষ্ট শরীয়াহ কাউন্সিল তার ম্যান্ডেট ও দায়দায়িত্ব পালনে সুস্পষ্ট বিচার্য বিষয় থাকতে হবে। শরীয়াহ কাউন্সিল সদস্যদের সততা, পেশাদারিত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্য সুষ্ঠু নৈতিকতা ও আচরণবিধি থাকতে হবে।
খ. তাকাফুল প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করবে, যে শরীয়াহ পরিচালনা-ব্যবস্থা তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য সুস্থতাও সক্ষমতার বৈশিষ্ট্য পূরণ করে।
গ. তাকাফুল প্রতিষ্ঠান তার শরীয়াহ কাউন্সিল এবং একইসাথে তার অভ্যন্তরীণ শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স এবং অডিট বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের ব্যবস্থা করবে।
ঘ. সার্বিকভাবে শরীয়াহ কাউন্সিলের এবং শরীয়াহ কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্যের অবদান ও কার্যকারিতা আনুষ্ঠানিক মূল্যায়নের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
ঙ. শরীয়াহ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর বস্তুনিষ্ঠ বিচার করার লক্ষ্যে শরীয়াহ কাউন্সিলের উচিত হবে শক্তিশালী ও স্বাধীন তদারকির ভূমিকা পালন করা। শরীয়াহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রুপকে প্রাধান্য বিস্তার এর অনুমোদন সঠিক হবে না।
চ. শরীয়াহ কাউন্সিল যাতে তার দায়দায়িত্ব পালন করতে পারে সেজন্য চলমানতার ভিত্তিতে সব সভার আগে পর্যাপ্ত ও সময়োচিত তথ্য তাদেরকে সরবরাহ করতে হবে।
ছ. শরীয়াহ কাউন্সিল সদস্যরা নিশ্চিত করবেন যে দায়িত্ব পালন করার সময় তাদের হাতে আসা অভ্যন্তরীণ তথ্য তারা গোপন রাখবেন।
জ. তাকাফুল প্রতিষ্ঠানকে শরীয়াহ সংক্রান্ত নীতি ঘোষণা বা প্রস্তাব জারি করার আইনি অধিকার পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হবে।
ঝ. শরীয়াহ কাউন্সিল কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো লক্ষ্য করবে এবং যেখানে সম্ভব শরীয়াহ পরিচালনা ব্যবস্থার মানদন্ডের আলোকে সামঞ্জস্যতার বিকাশ ঘটাবে।
যথাযথভাবে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত শরীয়াহ কাউন্সিলের দেওয়া ইসলামী বীমা বা তাকাফুলের শরীয়াহ ইস্যু-সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে শরীয়াহ ঘোষণা বা প্রস্তাব আইনি অভিমত নির্দেশ করে। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল শরীয়াহ ঘোষণা বা প্রস্তাব ইস্যু করা উচিত। জাতীয় কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড বা কাউন্সিলের কোনো একক কর্তৃপক্ষ থেকে থাকলে ওই কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষেরই এ ধরনের ঘোষণা প্রদান করার আইনগত ক্ষমতা থাকা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট শরীয়াহ কাউন্সিলগুলোর উচিত হবে এগুলোর অনুসরণ নিশ্চিত করা।
শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স সন্তোষজনক কিনা নিশ্চিত করার জন্য তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স রিভিউ বা অডিট বিভাগ থাকা উচিত। যেকোনো ধরনের নন-কমপ্লায়েন্স থাকলে তা রেকর্ডভুক্ত করে সেটা অবহিত করা এবং যতটা সম্ভব সমাধান ও সংশোধন করা উচিত। অভ্যন্তরীণ শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স ও অডিট বিভাগ ইস্যুগুলো সংশোধন ও সমাধানের জন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে সুপারিশ করবে এবং শরীয়াহ কাউন্সিলের কাছে রিপোর্ট করবে।
সুষ্ঠু ও কার্যকর শরীয়াহ পরিচালনা-ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কাজটি কেবল শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্যদের ওপর ফেলে রাখলে চলবে না। তাকাফুল ব্যবসার প্রতিটি স্টেকহোল্ডার, গ্রাহক, কর্মী, এজেন্ট, ব্রোকার, ম্যানেজমেন্ট, শেয়ারহোল্ডার এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে তাদের নির্ধারিত দায়দায়িত্বের আলোকে ভূমিকা পালন করতে হবে। অবশ্য, প্রাথমিক দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শরীয়াহ কাউন্সিলেরই। সেগুলো নিম্নরূপ:
ক. শরীয়াহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে পরিচালনা পর্ষদকে উপদেশ দেওয়া।
খ. শরীয়াহ সংশ্লিষ্ট নীতি ও নির্দেশিকাগুলো প্রাক-প্রচার নিরীক্ষণ ও অনুমোদন করা।
গ. শরীয়াহ-প্রক্রিয়ার ম্যানুয়াল প্রস্তুত করা।
ঘ. চুক্তি, সমঝোতা এবং নতুন নতুন পণ্য ও পরিসেবার জন্য অনুমোদন ও বৈধতা দান করা।
ঙ. যাকাত বা অন্য সব ধরনের কল্যাণমূলক তহবিলের দাতব্যকাজে ব্যয়ের হিসাব ও বণ্টন লক্ষ্য করা।
চ. কাউন্সিল সদস্য নয় এমন বিশেষজ্ঞদের কাউকে বা গ্রুপকে নিজেদের দায়িত্বের কিছু অংশ ন্যস্ত করা।
ছ. পণ্য নির্দেশিকা, বিনিয়োগ নির্দেশিকা, বিপণন, বিজ্ঞাপন, বিক্রয় সাহিত্য, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি অনুমোদন ও বৈধকরণ।
জ. শরীয়াহ নীরিক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য, ব্যালেন্সশিট, আর্থিক প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দাখিলকৃত প্রতিবেদন নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদের কাছে পাঠানো।
ঝ. শেয়ারহোল্ডার, পলিসিহোল্ডার ও সদস্যদের কাছে প্রকাশ ও বিতরণের জন্য বার্ষিক শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন দাখিল করা।
ঞ. শরীয়াহ কাউন্সিলের সচিব, সভার বিবরণী রেকর্ড করার দায়িত্ব পালন করবেন। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সচিব সব কার্যবিবরণী যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবেন।
ট. শরীয়াহ কাউন্সিলের প্রাসঙ্গিক কার্যবিবরণী সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ব্যবস্থাপনার সিনিয়র সদস্যদের কাছে দাখিল করা।
ঠ. কাউন্সিল, স্বচ্ছতা এবং এর স্বাধীন বৈশিষ্ট্য যাতে ক্ষুণ্ন না হয় তা নিশ্চিত করবে।
ড. সংস্থার মধ্যে যথাযথ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিকাশ করা এবং শরীয়াহ প্রক্রিয়ার অব্যাহত উন্নতি নিশ্চিত করা।
ঢ. শরীয়াহ কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্য শরীয়াহ কাউন্সিলের সভায় উত্থাপিত ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা ও সমাধানে তার সামর্থ্যরে সর্বাত্মক ব্যবহার করবেন।
ণ. শরীয়াহ কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্য অব্যাহতভাবে আত্ম-উন্নয়নের প্রয়াস চালাবেন, সততা প্রদর্শন করবেন এবং যথাযথ পরিচর্যা ও অধ্যাবসায়ের সাথে দায়দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করবেন।
ত. শরীয়াহ কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্য যৌক্তিক ও আইনসম্মত যুক্তি প্রয়োগ করবেন, অন্যদের কাছ থেকে শেখার ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করবেন এবং পালন করবেন।
শরীয়াহ সদস্যগণ সংশ্লিষ্ট একাডেমিক যোগ্যতা রাখবেন কিংবা ইসলামী অর্থব্যবস্থা, ইসলামী বাণিজ্যিক বিধানে (ফিকাহ আল মুয়ামালাত) যৌক্তিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবেন এবং শরীয়াহভিত্তিক আর্থিক লেনদেন বুঝতে পারার বিষয়টি প্রকাশ করতে সক্ষম হবেন। শরীয়াহ সদস্যগণ ইসলামী আইনের দর্শনে (উসুল-আল-ফিকহ) ব্যাপক দক্ষ হবেন বলে আশা করা যায়। তারা শরীয়াহর মৌলিক উৎসের ব্যাপারে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন হবেন। এটাও আশা করা হয় যে, শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্যগণ আরবি ভাষায় ভালো জ্ঞান রাখবেন এবং ইংরেজিতেও পারদর্শী হবেন। অধিকন্তু, প্রতিটি সদস্য নিম্নলিখিত বিষয় বোঝার ক্ষেত্রেও সক্ষম হবেন:
ক. তাকাফুল কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট শরীয়াহ্ বিধান।
খ. তাকাফুল লেনদেনে প্রয়োগযোগ্য সাধারণ, আইনগত ও নিয়ম-কানুন-সংক্রান্ত কাঠামো ও বাধা সমূহ।
গ. শরীয়াহর উদ্দেশ্য অর্জনে (মাকাসিদ আল শরীয়াহ) বাজারে তাকাফুল স্কিম প্রবর্তনের প্রভাব নিরুপন।
নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা:
সাধারণভাবে আইন জারি করে সরকার এবং তা কার্যকর করে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। অবশ্য, সাধারণত আইনের খসড়া তৈরি করে নিয়ন্ত্রণকারী কিংবা এ উদ্দেশ্যে গঠিত বিশেষ কমিটি। তাকাফুল শিল্পের জন্য যথাযথ আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজন। খুব কম দেশেই আলাদা তাকাফুল অ্যাক্ট ঘোষণা করা হয়েছে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ইস্যু উত্থাপন করেছে এবং সেগুলো নিরসন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শরীয়াহ জ্ঞানের অভাব এর বড় কারণ।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাকাফুল শিল্প গত তিন যুগে তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়েছে। শিল্পটির দ্রুত বিকাশের ফলে তাকাফুল কার্যক্রমের দিকনির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার জন্য কার্যক্রমগত কাঠামো জরুরী হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, বিশেষজ্ঞদের নির্দেশিকার আলোকে কিংবা এ ব্যাপারে যথাযথ বিধান প্রণয়নকারী দেশ মালয়েশিয়া, বাহরাইন, সৌদি আরব, পাকিস্তান বা অন্যান্য দেশের নির্দেশিকার আলোকে তা প্রণয়ন করতে পারে।
তাকাফুল শিল্পের আদর্শ কাঠামো প্রয়োজন, কারণ তাকাফুল প্রতিষ্ঠান শরীয়াহ আইনের আলোকে সুবিবেচনাপ্রসূত ও নৈতিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে। আলাদা আইন না হওয়ার ফলে তাকাফুল বিকাশ করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের উচিত নির্দেশিকা, প্রবিধান ও নিয়ম-কানুনের ব্যবস্থা করা। প্রবিধান বা নিয়ম-কানুনে তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনাগত কার্যক্রম-প্রক্রিয়া ও রূপরেখা থাকবে। এসব বিধি বা সংসদীয় আইনের উদ্দেশ্য হলো অংশগ্রহণকারী ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ নিরাপদ রাখা, তাকাফুল ব্যবসা পরিচালনায় একরূপতার বিকাশ এবং তাকাফুল শিল্পের কর্মসম্পাদন দক্ষতা বাড়ানো।
কার্যক্রমগত (অপারেশনাল) মডেলের ভিত্তি হবে শরীয়াহ কাউন্সিলের এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদিত তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের করা চুক্তি (মুদারাবা, ওয়াকালা, হাইব্রিড ইত্যাদি) অনুযায়ী।
তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাকাফুল প্রতিষ্ঠানের সম্পদ আলাদা করে রাখার দরকার। পারিবারিক তাকাফুল ব্যবসার জন্য তাকাফুল তহবিল আলাদা দুটি তহবিলে থাকবে: অংশগ্রহণকারী ঝুঁকি তহবিলে (পিআরএফ) এবং অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগ তহবিলে (পিআইএফ) । ঝুঁকি এবং বিনিয়োগ, চাঁদার সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঝুঁকি নিরুপনের জন্য পৃথক করা দরকার।
অংশগ্রহণকারী ঝুঁকি তহবিল (পিআরএফ) চাঁদা দানকারীদের তাবাররু। তাকাফুল চুক্তির আওতায় ঝুঁকির বিপরীতে (রিস্ক কভার) নির্ধারিত দাবী মেটানোর সময় অংশগ্রহণকারীদের পারস্পরিক আর্থিক সহায়তা ও সাহায্য প্রদান করার জন্য পিআরএফ বজায় রাখা হবে। পিআইএফ তহবিলে রাখা হবে চাঁদার সঞ্চয় বা বিনিয়োগ অংশ। অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তিগতভাবে পিআইএফ-এর মালিক হবে।
শরিয়াহ ও নিয়ন্ত্রণকারীর নির্দেশিকা অনুযায়ী, তাকাফুল কোম্পানি যৌক্তিক মুনাফা আয়ের জন্য যথাযথ বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ করবে। বিনিয়োগ-সম্পর্কিত তাকাফুল স্কিমের জন্য, পিআইএফ রাখা হবে ইউনিট আকারে তথা বিনিয়োগের মোট পরিমাণকে ইউনিটে রূপান্তরিত করা হবে। সাধারণ তাকাফুল (ননলাইফ) চুক্তির আওতায় ঝুঁকি মেটানোর ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের পারস্পরিক আর্থিক সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য পিআরএফ ব্যবহার করা হবে।
নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রবিধান বা নির্দেশিকা অনুযায়ী তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সম্পদ, দায়-দেনা, রাজস্ব ও ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে। তাকাফুল তহবিলের বরাদ্দ পদ্ধতি এবং বরাদ্দকৃত চাঁদার পরিমাণ তাকাফুল চুক্তিতে অবশ্যই স্বচ্ছতার সঙ্গে রাখতে হবে।
নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য ডিজাইনে ব্যাপকভাবে মনোযোগী থাকে তা নিশ্চিত করা এবং যেসব পণ্য প্রস্তাব করছে সেগুলোতে পর্যাপ্ত তাকাফুল তহবিল সৃষ্টি করা। তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাকাফুল চুক্তিতে থাকা ঝুঁকি ও বাধ্যবাধকতা মেটানোর লক্ষ্যে তাকাফুল ঝুঁকি তহবিলে পর্যাপ্ত তাবাররু বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে, যে চাঁদা (কিস্তি) নির্ধারণ করা হচ্ছে তা পণ্যটির পুরো মেয়াদে তাবাররু মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত।
পণ্যের বা সেবার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্য যাতে অনেক কম না হয়ে যায় কিংবা অংশগ্রহণকারীদের অতিরিক্ত বেশি মূল্য ধার্য না করার মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সুবিবেচনার পরিচয় দিতে হবে। অতিরিক্ত ঝুঁকিসম্পন্নদের বীমাকরণ (অ্যান্টি-সিলেকশন) এড়াতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে পর্যাপ্ত তাকাফুল তহবিল টিকিয়ে রাখা নিশ্চিত করার জন্য তাকাফুল প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে আন্ডাররাইটিং প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনা করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এবং আন্ডাররাইটিং ঝুঁকি নিরূপণ এবং গৃহীত ঝুঁকি চাঁদা নির্ধারণের সময় ব্যবহৃত সম্ভাব্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ- তা অংশগ্রহণকারীদের কাছে দৃশ্যমান করার জন্যও দায়িত্ব পালন করতে হবে।
তাকাফুল কার্যক্রমের নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে:
ক. পুনঃতাকাফুল ব্যবস্থাপনা যথাযথ হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য পুনঃতাকাফুল নীতি ও ব্যবস্থাপনা কৌশল অনুসরণ।
খ. শরিয়াহ শর্তাবলী ও অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশার আলোকে সুষ্ঠু বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
গ. সেবার প্রকৃতি, তাকাফুল চুক্তির মেয়াদ এবং তাকাফুল বেনিফিটের পরিমাণ বিবেচনা করতে যথাযথ ও সুবিবেচনাপ্রসূত মূল্যায়ন ভিত্তি ও পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ।
ঘ. তাকাফুল চুক্তির আলোকে দাবী প্রদান প্রক্রিয়া এবং সঠিক তহবিল থেকে দাবী পূরণ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ চালু রাখা।
ঙ. তাকাফুল সেবার মূল্য নির্ধারণ ও তাকাফুল তহবিলের কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ।
চ. স্বচ্ছলতায় কোনো প্রভাব না ফেলে উদ্বৃত্ত বণ্টনের যথাযথ মান নির্ধারণের জন্য তাকাফুল তহবিলের সক্ষমতা নিরূপণ।
ছ. চাঁদার পরিমাণ যতটা সম্ভব যৌক্তিক রাখা এবং শেয়ারহোল্ডারদের অপেক্ষাকৃত বেশি মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য পরিচালনাগত ব্যয়ের কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ।
আইএফএসবি (IFSB)’ র ভূমিকা
আইএফএসবি (ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড) হলো একটি আন্তর্জাতিক মান প্রতিষ্ঠাকারী সংস্থা। ২০০২ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালের মার্চে। ২০১৫ সালে এর মোট সদস্য দাঁড়িয়েছে ১৮৮। এদের মধ্যে ৬১টি তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, আটটি আন্তঃসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং শতাধিক (১১৯টি) পেশাদার সংগঠন। বৈশ্বিক সুবিবেচনাপ্রসূত মান এবং ব্যাংকিং, বীমা (তাকাফুল), মূলধন বাজার, সুকুক (ইসলামী বন্ড) ইত্যাদিসহ ইসলামী আর্থিক পরিসেবা প্রদানকারী খাতগুলোর জন্য নির্দেশিকা ও নীতিমালা ইস্যু করার মাধ্যমে ইসলামী আর্থিক পরিসেবা শিল্পের প্রচার ও বিকাশ ঘটানো। আইএফএসবি গবেষণা লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ ও সমন্বয়ের উদ্যোগ চালিয়ে থাকে। সংস্থাটি নিয়ন্ত্রণকারী ও শিল্প-সংশ্লিষ্টদের জন্য রাউন্ডটেবিল, সেমিনার ও সম্মেলনেরও আয়োজন করে থাকে। এই কাজের জন্য আইএফএসবি সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্থাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
আইএফএসবির উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:
নতুন বা বিদ্যমান বিধি উপযোগী করে, শরীয়াহ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য ও আন্তর্জাতিক মান এবং উপযোগী করার সুপারিশ করার মাধ্যমে সুবিবেচনাপ্রসূত ও স্বচ্ছ ইসলামি অর্থব্যবস্থার প্রচার ও বিকাশ।
ইসলামী আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর তদারকি ও নিয়ম-কানুন এবং ইসলামি আর্থিক শিল্পের বৈশিষ্ট্য, পরিমাপ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আয়, ও ব্যয় হিসাব ও প্রকাশে আন্তর্জাতিক মান আমলে নেওয়ার পদ্ধতির জন্য নির্দেশিকা প্রদান।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও অর্থব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার মান নির্ধারণকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং ওইসব সদস্য দেশের সাথে যোগাযোগ ও সহযোগিতা করা।
ইসলামী আর্থিক সেবা শিল্প বিকাশে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা উৎসাহিত করা।
ইসলামী আর্থিক সেবা শিল্প এবং সংশ্লিষ্ট বাজারগুলোতে কার্যকর নিয়ম-কানুনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষতা বিকাশে প্রশিক্ষণ প্রদান ও কর্মী তৈরি করা।
ইসলামী অর্থ সেবা শিল্পে গবেষণা পরিচালনা করা, সমীক্ষা প্রকাশ ও জরিপ চালানো।
২০১৫ সাল অবধি আইএফএসবি ইসলামি আর্থিক পরিসেবা বিষয়ক ২৪টি মানদন্ড, নির্দেশিকা নীতিমালা, নির্দেশনা ও ব্যবহারিক নোট ইস্যু করেছে। আইএফএসবি’র প্রস্তাবিত মানদন্ড ও তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে এবং যেখানে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে, গণ-শুনানির আয়োজন করেছে। আইএফএসবি বিভিন্ন দেশে সেমিনার, কর্মশালা, সম্মেলন, প্রশিক্ষণ ও সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে ইসলামি আর্থিক সংস্থাগুলোর নিয়ম-কানুন ও তদারকি প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট বা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতনা বাড়ানোর কাজে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত।
ইসলামি অর্থব্যবস্থা যে সত্যিই ভিন্নভাবে পরিচালিত হয় এবং তা যে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ভালো তা গ্রাহক, বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার জন্য শরিয়াহ পরিচালনাব্যবস্থার ধারণা, ব্যবসায়ে আচরণবিধি এবং নৈতিকতা এসব মানদন্ডের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাকাফুল কার্যক্রম শুরু করার সময় আর্থিক প্রতিবেদনে তথ্য প্রদান ও স্বচ্ছতা লক্ষ করা না যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম ও কর্ম-সম্পাদনা দক্ষতা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল। বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডার এবং সেইসাথে জনসাধারণ যাতে ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হতে আস্থাশীল হয়, সেজন্য তাদের কাছে আরো স্বচ্ছ হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্দীপ্ত ও উৎসাহিত করে আইএফএসবি।
তাকাফুল ব্যবস্থা ইসলামি বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত হওয়ায় তাদেরকে অবশ্যই শরিয়াহর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উপাদানগুলো থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া পরিসেবাগুলোকে কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাও পূরণ করতে হবে। তাকাফুলের এসব লক্ষ্য হাসিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, অর্থ মন্ত্রণালয়, তাকাফুল প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট শরিয়াহ কাউন্সিলের মধ্যে সফল সহযোগিতার পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন। প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা ও দায়দায়িত্বও বোঝা প্রয়োজন। সকল পক্ষ যদি নির্বিকার থাকেন এবং আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন তবে তাকাফুল চুক্তি স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সুষমার দ্বারা বিকশিত হবে না। তাকাফুল চুক্তি এবং এর বাধ্যবাধ্যকতা হতে হবে স্ফটিক স্বচ্ছ এবং এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে। বীমা কর্তৃপক্ষ যদি এগিয়ে না আসে, তবে তাকাফুল প্রতিষ্ঠান সমূহকে এ ব্যাপারে যৌথভাবে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক: চীফ কনসালটেন্ট, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।
প্রকাশের তারিখ-২ জানুয়ারি ২০১৭