অগ্নি বীমা দাবি বাতিল হওয়ার উল্লেখযোগ্য ১০ কারণ
এ এ সাদী: অগ্নি বীমা দাবি বাতিল হতে পারে এমন উল্লেখযোগ্য ১০ কারণ, সে সম্পর্কে সচেতন হন। অপ্রত্যাশিতভাবে বীমা দাবি প্রত্যাখ্যান হয়ে যাওয়া থেকে আপনাকে সচেতন হতে হবে। কি কি কারণে অগ্নি বীমা দাবি বাতিল হতে পারে তা আলোচনা করা হলো-
বন্যা, ঝড়, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির মত আগুন ও অন্যান্য প্রাকৃতিকভাবে দুর্ঘটনার ফলে যে কোন মানুষ বা সম্পদ ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনা মানুষের মনে বড় ধরনের মানসিক আঘাত সৃষ্টি করে। এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া কঠিন এমনকি বিপদজনক হতে পারে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং ক্ষতির বিষয়বস্তু পুনর্নির্মাণ করতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। আর তাই সম্ভাব্য সকল ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে এমন ধরনের বীমা গ্রহণ করা উচিৎ।
Standard Fire Insurance Policy with Special Perils Cover অর্থাৎ সাধারণ দুর্ঘটনার পাশাপাশি অন্যান্য বিশেষ কোন দুর্ঘটনার ফলে ক্ষয়ক্ষতি কভার করে এমন পলিসি। এই ধরনের বিশেষ পলিসি আপনার সম্পদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক সহযোগিতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে।
যখন বীমা দাবি উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, তখন পলিসির আসল রুপ এবং চরিত্র সম্পর্কে আপনি জানতে এবং বুঝতে পারবেন। সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, কি করলে বীমা দাবি পাওয়া যাবে এবং কি কি করলে বীমা দাবি প্রত্যাখ্যান করা হবে সে সকল বিধি নিষেধ সম্পর্কে জেনে নেয়া। বীমার ভাষায় একে বলে Warranty, Terms & Conditions । পলিসি চলাকালীন কোন দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতি হলে তা প্রদান করা যেমন বীমা কোম্পানির দায়িত্ব। ঠিক তেমনি বীমা গ্রাহকের দায়িত্ব বীমাকৃত সম্পদ বা বিষয়বস্তুর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা। ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বীমা গ্রাহকের নৈতিক দায়িত্ব।
এখানে কয়েকটি সাধারণ কারণ রয়েছে যার জন্য আপনার বীমাকারীর দ্বারা দাবিটি অ-গ্রহণযোগ্য বা বাতিল বলে বিবেচিত হতে পারে:
১। প্রাকৃতিক আবহাওয়া:
প্রাকৃতিকভাবে আবহাওয়াজনিত কারণে ধীরে ধীরে ফাটল ধরে যাওয়া। যেমন সূর্যের তাপে দেয়াল বা বাড়ীর ছাদে ফাটল ধরা, বৃষ্টির পানি ক্রমাগত গড়িয়ে পরার ফলে ক্ষয় হওয়া।
২। অসম্পূর্ণ পাইপলাইন, ত্রুটিযুক্ত পাইপলাইন (Gas, Electricity, Water, Sewerage):
সম্পত্তির মালিক হিসাবে, আপনার সম্পত্তির যথাযথ যত্ন নেয়া আপনার দায়িত্ব। তেমনি, কোনও বীমাকারী প্রত্যক্ষ্যভাবে অবহিত, এমন ত্রুটিযুক্ত প্লাম্বিংয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতি বীমা দাবির আওয়তাধিন নয়।
৩। অসম্পূর্ণ নকশা, কাঠামোগত দুর্বলতা, অপরিমিত উপাদান (রড, সিমেন্ট, বালু, ইট) বিন্যাস:
নতুন বিল্ডিং এবং কাঠামো কখনও কখনও কেবল নতুনভাবে নির্মিত কাঠামোতে দেবে যাওয়া বা কাঠামোগত বন্টন (ইট, বালু, সিমেন্ট, রড নির্দিষ্ট স্থান গুলোতে পরিমাণ মত না দেয়া) এর ফলে ইমারত বা স্থাপনার জীবনের শুরুতে ফাটল ধরতে পারে। ইমারত নির্মাণের শুরুতে পাইলিং ত্রুটির কারণেও এটি ঘটতে পারে। এ জাতীয় কোনও ক্ষতি কোনও স্ট্যান্ডার্ড ফায়ার পলিসি এবং অতিরিক্ত ঝুঁকি সহ পলিসিতেও কভার করে না।
৪। ত্রুটিযুক্ত নকশা বা অদক্ষ কারিগর:
ত্রুটিযুক্ত নকশা, অদক্ষ কারিগর, অসম্পূর্ণ বা দুর্বল নির্মাণ সামগ্রির কারণে বীমাকৃত সম্পদের ক্ষতি হলে বীমা দাবি প্রত্যাখ্যান হবে।
৫। বিষয়বস্তু:
বীমাকৃত বিষয় বা সম্পদ Standard Fire and Special Perils policy এর আওতায় থাকলেও পলিসিতে সম্পদের বিস্তারিত বিবরন এবং পরিমাণ (টাকায়) উল্লেখ করে দিতে হবে।
৬। সরকারি নির্দেশের ফলে পরিবর্তন:
সরকারী সিদ্ধান্তের কারণে স্থায়ী বা অস্থায়ী নিষ্পত্তির ফলে সরকারী কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে সম্পদের পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন বা ক্ষতি হলে তা বীমা দাবি পরিশোধের আওতাধীন নয় ।
৭। সিধেল চুরি, বাড়ী ভেঙ্গে চুরি:
অগ্নি দুর্ঘটনার সময় সিধেল চুরি হওয়ার ফলে ক্ষয়ক্ষতি অগ্নি বীমা পলিসিতে কভার করে না। এমনকি অগ্নিকান্ডের সময় , বা অগ্নিকান্ডের পরে বা দুর্ঘটনা চলমান অবস্থায় কোন চুরি হলে এরূপ ক্ষয়ক্ষতি অগ্নি বীমা পলিসিতে কভার করে না । তবে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিয়ে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বন্যা, ধর্মঘট, সন্ত্রাসবাদের ক্ষয়ক্ষতিজনিত কভার গ্রহণ করা যেতে পারে।
৮। প্রস্তাবিত বীমার বিষয়বস্তু বা সম্পদের উপর নিজ (বীমা গ্রাহক এবং বীমাকারী) স্বার্থ না থাকা:
বীমার বিষয় বস্তু বা সম্পদের উপর বীমা গ্রাহক এবং বিমাকারীর স্বার্থ না থাকলে বীমা পত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
উপরে উল্লেখিত নির্দেশক দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থের বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলে গ্রাহক আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন। সেই মুহূর্তে বীমাকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি কামনা করেন। এটাই বীমা গ্রাহকের বীমাযোগ্য স্বার্থ। অপর দিকে সম্পদের বীমা করার বিনিময়ে প্রিমিয়াম প্রাপ্তি হচ্ছে বীমাকারীর স্বার্থ। উক্ত অর্থ সঞ্চয় করে রাখার মাধ্যমে নিজ বীমা প্রতিষ্ঠান ও বীমা গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষায় ভুমিকা রাখেন ।
৯। বৈদ্যুতিক বা যান্ত্রিক গোলযোগ:
সাধারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ঘটনাচক্রে মেশিনারি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তবে প্রধানতঃ এ ধরনের ক্ষতির উৎস অগ্নিকাণ্ড থেকে নয়- এরূপ পরিস্থিতিতে বীমা দাবি বাতিল হবে। ক্রমাগতভাবে চলমান বা ব্যবহৃত মেশিন অত্যাধিক চাপের কারণে, মেশিনের নিজস্ব উত্তাপের জন্য, বৈদ্যুতিক লিকেজ বা ত্রুটির ফলে সৃষ্ট শর্ট সার্কিটজনিত কারণে সম্পদের ক্ষতি হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। আর তাই বৈদ্যুতিক লাইন এবং লাইনের উৎস, ইলেকট্রিক মটর, পাওয়ার হাউজ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
১০। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা:
বীমাকৃত সম্পদ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হবার সময় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাতে কম হয়, সে জন্য আপনাকে আপনার সাধ্যমত চেস্টা করে যেতে হবে, যা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। অবশ্যই যথাযম্ভব প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বীমা দাবি উপস্থাপনের পর অনুমোদিত সার্ভেয়ার ঘটনাস্থল এবং ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের উপর জরিপ বা পর্যবেক্ষণমূলক তদন্ত করবেন। এ সময়ে আপনার কোন অবহেলার কারণে ক্ষতির কারণ বৃদ্ধি হয়েছে বা ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এরূপ প্রমান হলে বীমা দাবি বাতিল হবে।
উপরোক্ত তালিকায় উল্লেখিত কারণ ছাড়াও আপনার বীমা দাবি নাকচ হয়ে যেতে পারে। আপনার বীমা দাবি যাতে সময়মতই পরিশোধ হয় তার জন্য নিম্নলিখিত তথ্য জেনে রাখুন।
- আপনার সম্পদের বীমাকারী প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত দুর্ঘটনার সংবাদ জানান।
- সময়মত পলিসি নবায়ন এবং প্রিমিয়াম প্রদান করুন।
- আপনার বীমাকৃত সম্পদের যে কোন পরিবর্তন, হস্তান্তর, পরিমার্জন, সংশোধন তাৎক্ষণিকভাবে বীমাকারীকে জানিয়ে রাখুন।
- আপনার পলিসি পেপারগুলোর মাঝে লেখা সকল শর্তাবলি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আপনার পলিসিতে কি কি ঝুঁকি কভার করে আর কোন কোন ঝুঁকি কভার করে না তাও পরিপূর্ণভাবে জেনে রাখুন।
- দুর্ঘটনার সময় ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।
- দাবি সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র হালনাগাদ, সত্যায়িত করে রাখুন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিষয়ভিত্তিক তালিকা করে রাখুন।
- বীমাপত্র গ্রহণ করার সময় সম্পদের সঠিক তথ্য দিন, সম্পদের প্রকৃত মূল্য উপস্থাপন করুন। তা না হলে বীমা দাবি পরিশোধের সময়ে সম্পদের মুল্যের পার্থক্য বা ভুল তথ্য প্রমাণিত হলে গড় হিসেবে বীমা দাবি পরিশোধ হবে।
যখন আপনি বীমা পলিসি গ্রহণ করবেন, তখনই পলিসিতে প্রদত্ত আদেশ-নিষেধ, শর্তাবলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নিন। এর ফলে আপনার সম্পদের জন্য পলিসি গ্রহণ করার সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: অবলিখন কর্মকর্তা, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।