বীমার টাকা পায় না সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা
আবদুর রহমান: দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ১৩ হাজার মানুষ। এরমধ্যে ৫ হাজার নিহত এবং আহতের সংখ্যা ৮ হাজার। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের আর্থিক সুবিধা দিতে সরকার “থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স” নামে পরিচিত অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করলে এর কোনো সুবিধাই পায় না ক্ষতিগ্রস্তরা।
বীমা আইন অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ির ঝুঁকি গ্রহণকারি বীমা কোম্পানি নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক নিহতের পরিবার ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবে। আর শারীরিকভাবে আহত প্রত্যেকে পাবেন ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ। আর সম্পত্তি নষ্ট হলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানি।
মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স- ১৯৮৩ অনুসারে, প্রতিটি যানবাহনের জন্য অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স তথা তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকির বিপরীতে বীমা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এই বীমা গ্রহণ ছাড়া কোন যানবাহনের নিবন্ধন সনদ বা লাইসেন্স প্রদান করা হয় না। থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স না থাকার কারণে ট্রাফিক আইন অনুসারে অহরহ জরিমানা ও মামলার শিকার হচ্ছেন গাড়ির মালিকরা।কিন্তু দুর্ঘটনার পর এই বীমার কোন সুবিধা পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্তরা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির ২০১৬ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশজুড়ে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৪ জন। বীমার সুবিধা অনুসারে ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ হাজার ৫৫ জনের পরিবার সর্বমোট ১২ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। দুর্ঘটনায় প্রত্যেক আহতের বিপরীতে ৫ হাজার টাকা হিসাবে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা, আর ১০ হাজার টাকা হিসাবে ১৫ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। অথচ তারা কেউ বীমা বাবদ টাকা পায় নাই।
অপর এক সূত্রে দেখা গেছে, বিগত ১২ বছরে দুর্ঘটনায় ৫৭ হাজার ২২৬ জন নিহত হয়েছেন। বীমা সুবিধা অনুসারে ক্ষতিপূরণের অংক দাঁড়ায় ১১৪ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর ৯৩ হাজার ৫০৬ জন আহতের বিপরীতে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৯৩ কোটি ৫০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বীমা দাবি না দেয়া বা দাবি উত্থাপন না করায় অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সের বিপরীতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতে পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সুবিধা পাওয়া নিয়ে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডির পক্ষ থেকে কথা বলা হয়, যাত্রি, বীমা নির্বাহী ও পরিবহন মালিকদের সঙ্গে। তাদের মতে, আইনি জটিলতা, সচেতনতা না থাকা ও আইনের সংস্কার না হওয়ার ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হচ্ছেন আর্থিক সুবিধা থেকে। সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধনের প্রয়োজন বলে তারা সবাই মত প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, বীমা কোম্পানির কাছে ক্লেইম পাওয়া যায় না বলেই ক্ষতিগ্রস্তরা ক্লেইম করেন না। তাছাড়া একটা ক্লেইম প্রমাণ করতে থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে যেসব তথ্যের যোগান দিতে হয়, তাতে প্রায় ৩০/৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এ কারণে কেউ এসব ঝামেলার মধ্যে যেতে চায় না। অনেকে বিষয়টি জানেও না।
তিনি বলেন, যখন মটর ভেহিকল অ্যাক্ট তৈরি করা হয় তখন ২০ হাজার টাকার মূল্য ছিল অনেক। কিন্তু বর্তমান সময়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সাধারণ আহতের চিকিৎসাও হয় না। অথচ উন্নত দেশগুলোতে দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ৭০/৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। মূলত ৫/৬শ’ টাকা দিয়ে পলিসি করে হতাহতের ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব না। আর যা থেকে সাপোর্ট পাওয়া যায় না, তার ওপর আস্থা রাখাও যায় না। তাই নতুন নীতিমালা প্রয়োজন বা দুর্ঘটনার বিষয়ে বর্তমান বীমা আইন সংশোধন জরুরি।
এ বিষয়ে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোকাররম দস্তগীর ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে বলেন, আমাদের কোম্পানিতে অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স কমই হয়। তবে যেসব পলিসি হয়, সাধারণত সেগুলোর কোন ক্লেইম হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের পক্ষে গাড়ির মালিককে এই ক্লেইম করার কথা। কিন্তু তারা কখনো ক্লেইম করে না। ক্লেইম করতে কাগজপত্র ও প্রমাণাদির প্রয়োজন হয়, যা তারা সংগ্রহ করতে চায় না। থানা-পুলিশের ঝামেলা এড়াতে তারা ম্যানেজ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্তরাও বিষয়টি ভালো জানে না। অনেক সময় গাড়ির খোঁজই থাকে না। তাছাড়া ১০/২০ হাজার টাকার জন্য কেউ এসবে জড়াতে চায় না। সরকার থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করেছে বলেই গাড়ির মালিকরা এই বীমা করে থাকে। কিন্তু এর কোন সুফল ক্ষতিগ্রস্তরা পায় না।
তিনি আরো বলেন, অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সের আইনটি অনেক আগের। এখানে প্রিমিয়াম ও ক্ষতিপূরণের অংক অনেক অল্প। তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরণের জন্য গাড়ির মালিকরা ক্লেইমের ঝামেলায় যেতে চায় না। তাই সময়ের প্রেক্ষিতে বাস্তবতার নিরীখে আইনটি সংশোধন প্রয়োজন। বীমা সুবিধা প্রদান করতে হলে যাত্রীদের বীমা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কম্প্রিহেনসিব পলিসি গ্রহণ করা। যাতে সব ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করা হয়। বীমা অংকের পরিমাণও বাড়াতে হবে। বর্তমানে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয় যাত্রীবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে আসন প্রতি ৪৫ টাকা। অথবা গাড়ির সিসি’র ওপর নির্ভর করে এর প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়।
আলভি রেন্ট এ কার’র জুলফিকার হায়দার বলেন, প্রতিটি গাড়ির থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স করতে হয়। সরকার এটা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে আমাদেরকে বীমা করতে হয়। কিন্তু যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন এই বীমার কোন সুফল পাওয়া যায় না। ক্লেইম করলেও ক্লেইম পাওয়া যায় না। তাই কেউ ক্লেইম করতেও চায় না। আরো বেশি টাকা নিয়েও যদি বীমার সুবিধা পাওয়া যায় তাই ভালো। এই নামমাত্র বীমা করে কোন লাভ নেই। সরকারের উচিত এই সিস্টেম বাদ দেয়া অথবা বীমার সুবিধা পাওয়া নিশ্চিত করা। বীমা আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, এই বীমার প্রয়োজনও নেই।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির ২০১৬ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশজুড়ে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১৫ হাজার ৯১৪ জন। এরআগে ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
তবে বাংলাদেশ পুলিশের সূত্র দিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪২২ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ২৮৯ জন আহত হয়েছেন।এর আগে ২০১৫ সালে ২ হাজার ৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৩৭৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন আরো ১ হাজার ৯৫৮ জন।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর) জানিয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ১২ বছরে সারাদেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৭ হাজার ২২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন ৯৩ হাজার ৫০৬ জন। অর্থাৎ বছরে গড়ে ৪ হাজার ৭৬৯ মানুষ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন বছরে গড়ে ৭ হাজার ৭৯২ জন।
বিআরটিএ’র তথ্য মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ১৬ হাজার ৪১০টি। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ২১৫টি। আগের বছর ২০১৪ সালে নিবন্ধিত যানবাহন ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩৯টি।শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২০১৬ সালে ১ লাখ ১০ হাজার ৫২০টি, ২০১৫ সালে ৯৫ হাজার ৭৪৩টি এবং ২০১৪ সালে ৭৩ হাজার ৫১টি। নিয়ম অনুসারে, যানবাহন নিবন্ধনের সময়ই থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স করতে হয়।