হোমল্যান্ডের প্রবাসী পরিচালকরা আবারো বোর্ড সভা ডাকলেন সিলেটে, স্থগিত করলেন হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক: আবারো সিলেটে বোর্ড সভা আহবান করে নোটিশ প্রদান করে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই বোর্ড সভার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের করা হলে শুনানি শেষে তা আদালত স্থগিত করে দেন। অভিযোগ রয়েছে, হোমল্যান্ড লাইফের অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি-অনিয়মের সকল সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে সিলেটে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে।

এর আগেও কোম্পানিটির প্রবাসী পরিচালকরা আধিপত্য বিস্তারের জন্য সিলেটে সভা করত। এতে ঢাকার পরিচালকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলত সিলেটের ওই সভাগুলোতে। এতে করে অনিয়ম ও দুর্নীতি করার সিদ্ধান্তগুলো প্রবাসী পরিচালকরা নিতেন খুব সহজেই। এবারও হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ও ৫ পরিচালকের শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতির কেলেঙ্কারী ধামাচাপা দিতেই সিলেটে বোর্ডসভাসহ অন্যান্য সভা করার পাঁয়তারা করছে বলে মনে করছেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা।

সিলেটে আহবান করা ওই বোর্ড সভার নোটিশে দেখা যায়, ৪ নম্বর আলোচ্য সূচি ছিল- পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ ছাড়াও কোম্পানিটির ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে আইডিআরএ’র শুনানি সম্পর্কিত আলোচনা করার সিদ্ধান্ত রাখা হয় ৭ নম্বর আলোচ্য সূচিতে।

হোমল্যান্ড লাইফের ১৫১তম বোর্ড সভা কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের পরিবর্তে সিলেটের হোটেল ব্রিটানিয়ায় আহবান করে পরিচালকদের নোটিশ প্রদান করা হয়। এই নোটিশ দেয়া হয় গত ২৩ জানুয়ারি। অথচ এর আগে ১৫১তম সভাটি প্রধান কার্যালয়ের বোর্ড রুমে ২৯ জানুয়ারি বেলা ১২টায় আহবান করা হয়। একইসাথে কোম্পানির নির্বাহী কমিটির সভা এবং নিরীক্ষা, বিনিয়োগ, দাবি ও সিএমআই কমিটি সভার স্থানও সিলেটে স্থানান্তর করে পরিচালকদের নোটিশ প্রদান করা হয়।

পরে সিলেটে সভা আহবানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেন কোম্পানিটির পরিচালক মোহাম্মদ জুলহাস। মামলার শুনানি শেষে ৪ সপ্তাহের জন্য আহূত সকল সভা স্থগিত করে রুল জারি করেন আদালত। হাইকোর্টের বিচারপতি জাফর আহমেদ রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) এই আদেশ দেন। মামলার আইনজীবী রেজাউল করিম রেজা ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফ থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। আর এই লুটপাটে জড়িত ছিলেন স্বয়ং কোম্পানির মালিকরাই। হোমল্যান্ড লাইফের এই ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ নিয়ে এর আগে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি (সংবাদটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন)। ওই প্রতিবেদনে সিলেটে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভাগুলোতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা তুলে ধরা হয় তা পাঠকদের জন্য আবারো তুলে ধরা হলো-

হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধানে নামে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১০ সালে। বিগত সময়গুলোতে নানাভাবে সংগ্রহ করা হয় দুর্নীতির নথিপত্র। আলাপ করা হয় সংশ্লিষ্টদের সাথে। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র হাতে আসা নথিপত্র ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে গ্রাহকের শত কোটি টাকা লুটের তথ্য দিয়ে সাজানো হয় এই প্রতিবেদন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, হোমল্যান্ড লাইফ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশের সিলেটস্থ ব্রিটিশ নাগরিক ও স্থানীয় বাংলাদেশীদের নিয়ে গঠন করা হয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। তবে প্রবাসী পরিচালকরা ব্রিটিশ নাগরিক হলেও কোম্পানিটিতে তারা বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশী হিসেবেই। বিনিয়োগের এই টাকা তারা নিয়ে আসেন হুন্ডি করে। নথিপত্রে এমনটাই তথ্য মেলে।

১৯৯৬ সালে হোমল্যান্ড লাইফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম পাঁচ বছর বোর্ড সভাগুলো অনুষ্ঠিত হতো কোম্পানির মতিঝিলস্থ এল্লাল চেম্বারের প্রধান কার্যালয়ে।

২০০১ সালের ২২ এপ্রিল কোম্পানির ২৫তম বোর্ড সভাটি অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে। সিলেটের কাজী এনাম ভবনের চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। এ ভবনের মালিক বীমা কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম। এরপর ২০০৫ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত ৪৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে।

সিলেটে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভাগুলোতে ব্রিটিশ নাগরিক সিলেটের পরিচালকদের আধিপত্য ও সভাগুলো ঢাকার বাইরে হওয়ায় ঢাকার পরিচালকরা বেশিরভাগই অংশ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেকেই তাদের শেয়ার অংশও তুলে নেন এ সময়ে।

এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বোর্ডে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন সিলেটের ব্রিটিশ নাগরিক পরিচালকরা। সুযোগ নেন দুর্নীতি-অনিয়মের। সিলেটের বোর্ড সভাগুলোতেই গ্রাহকের জমা করা টাকা তুলে নিতে অনুমোদন দেয়া হয় অস্তিত্বহীন জমি কেনার, অস্তিত্বহীন জমিতে মাটি ভরাটের, জমি ছাড়াই দেয়া হয় জমি কেনার অগ্রিম টাকা।

সিলেটে অনুষ্ঠিত ৩১তম বোর্ড সভায় অস্তিত্বহীন একটি জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভাতেই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এমডি সরাফত উল্লাহ ঢালি পদত্যাগ করেন। সিলেটে সর্বশেষ বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ মার্চ ২০০৫ সালে; কোম্পানির ৪৪তম বোর্ড সভা। এরপর চলে যায় আরো কয়েক বছর।

সিলেটের টুকের বাজারে জমি ক্রয়ের নামে আত্মসাৎ ১.৫১ কোটি টাকা

পরিকল্পিতভাবে টাকা আত্মসাতের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০০২ সালে। এ সময়েই অস্তিত্বহীন একটি জমি ক্রয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের এ পরিকল্পনা করা হয়। এই জমি ক্রয়ের প্রস্তাব করেন কোম্পানির তৎকালিন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস শুকুর। তৎকালিন পরিচালক ফারুক তা সমর্থন করেন।

পরের জমিটি ক্রয়ের জন্য ২০০২ সালের ১৯ জুন ৬২তম নির্বাহী কমিটির সভায় ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন- কাজী এনাম, আব্দুস শুকুর, নজরুল ইসলাম ও নাফিসা সালমা।

এই কমিটি পরের দিন-ই, ২০ জুন ৩০তম বোর্ড সভায় জমি ক্রয়ের সম্মতি জানিয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে বোর্ড তা অনুমোদন করে। এক দিনের মধ্যে কোটি টাকা ব্যয়ের জমির প্রতিবেদন দেয়ায় বোঝার বাকি থাকে না কোম্পানির তহবিল থেকে টাকা বের করতেই জমি ক্রয়ের বিষয়টি সাজানো হয়।

যে জমির কোন অস্তিত্ব নেই। সেই জমি কেনার ব্যয় বাবদ অনুমোদন করা হয় ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জনৈক তৈয়ব আলীকে সাজানো হয় জমির মালিক। জমির দাম পরিশোধ করা হয় নগদ চেক ও পে অর্ডারের মাধ্যমে, ৪ দফায়।

২০০২ সালের ১ আগস্ট পরিশোধ করা হয় ৫০ লাখ টাকা, ১২ আগস্ট পরিশোধ করা হয় ২৫ লাখ টাকা। ঐ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর পরিশোধ করা হয় ২৫ লাখ টাকা এবং ১১ নভেম্বর ২০০৩ সালে পরিশোধ করা হয় ৩৫ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, কথিত জমির মালিক তৈয়ব আলীর পক্ষে এই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির তৎকালিন পরিচালকরা।

এ জমি দেখানো হয় সিলেটের টুকের বাজারে। জমির পরিমাণ দেখানো হয় ৪৫ শতাংশ। প্রতি শতাংশের মূল্য ধরা হয় ৩.৪০ লাখ টাকা। জমিটির মোট মূল্য দেখানো হয় ১.৩৫ কোটি টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ খরচ দেখানো হয় ১৬ লাখ টাকা। ২০০৩ সালের ১১ জানুয়ারি জমির মালিক তৈয়ব আলীর নিকট থেকে জমি রেজিস্ট্রেশনের একটি দলিলও তৈরি করা হয়।

ভূয়া জমির ক্রয় খতিয়ে দেখতে তৎকালিন কর্তৃপক্ষ ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ফার্ম এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক এ কে এম আমিনুল হক এফসিএ’কে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্তে জমির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বোর্ডের সকল সদস্যই এ টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলে দাবি করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

জমি ক্রয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অনুমোদন দেয়া সিলেটে অনুষ্ঠিত সেই ৩১তম পর্ষদ সভায় সর্বমোট ২৮ জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন- এর মধ্যে ৫ জন ছিলেন বিকল্প পরিচালক, ১০ জন পলিসি হোল্ডার পরিচালক ও বাকি ১১ জন উদ্যোক্তা পরিচালক।

ওই সভায় পরিচালকদের মধ্যে উপস্থিত কাজী এনাম উদ্দিন আহমদ (চেয়ারম্যান), মো. আব্দুস শুকুর, (ভাইস-চেয়ারম্যান), ফারুক আহমেদ, মো. মাজহারুল কাদের, মো. কাওসার জাহান কয়ছর, নাফিসা সালমা, রিজিয়া সুলতানা, আবদুর রাজ্জাক, নজরুল ইসলাম কামাল মিয়া ও হোসনে আরা গণি।

৫ জন বিকল্প পরিচালকের মধ্যে ছিলেন- আব্দুর রবের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন আবুল ফয়েজ হক, ফয়জুল হকের পক্ষে বিকল্প পরিচালক হিসেবে ছিলেন এ এইচ এম মহসিন, কাজী ফারুক উদ্দিন আহমেদের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন মশিউজ্জামান খাঁন, জামাল উদ্দিনের পক্ষে বিকল্প পরিচালক ছিলেন মো. আব্দুল কুদ্দুস ও বিকল্প পরিচালক মো. মফাচ্ছিল আলী (মাসুক)।

এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের ১০ জন পলিসি হোল্ডার পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন- জয়নাল আবেদীন, মো. শামীম আহমেদ, মো. আবু তাহের খাঁন, এ কে এম জাকির হোসেন, কাজী নুরজাহান খাঁন আহমদ, মো. দেলোয়ার হোসেন তপাদার, মো. সাবের আলী খাঁন, মোহাম্মদ এনামুল হাসান, আরজ আলী খাঁন, মিস মাহিমা বেগম, সামসুন নাহার ও সাদত আলী খাঁন।

এছাড়াও কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেদায়েতুল ইসলাম খান ওই বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন।

জমি-ই নাই, সেই জমিতে মাটি ভরাট: আত্মসাৎ ৩৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা

মাটি ভরাট ও কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার নামে টাকা আত্মাসাৎ করা হয়েছে হোমল্যান্ড লাইফ থেকে। এ ঘটনা ২০০৮ সালের। জমি নেই অথচ সেই জমিতে মাটি ভরাট ও কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় ৩৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এজন্য জমি দেখানো হয় টুকের বাজারের সেই অস্তিত্বহীন জমি।

এই টাকা আত্মাসাতের জন্য প্রথমে মাটি ভরাট ও কাঁটারের বেড়া দেয়ার জন্য দরপত্র আহবান দেখানো হয়। পরে ওই দরপত্রের বিপরীতে কাজ দেয়া হয় নিলয় এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মহিউদ্দিন হোমল্যান্ড লাইফের কথিত পরিচালক মফিজ উদ্দিনের আপন ভাই।

এই টাকা আত্মাসাতের জন্য বোর্ড সভার কার্যবিবরণী ও দরপত্র এবং কার্যাদেশ সংক্রান্ত নথিপত্রগুলো তৈরি করা হয় জাল-জালিয়াতি করে।

মাটি ভরাটের নামে এই ৩০ লাখ ৭০ হাজার টাকার মধ্যে হোমল্যান্ড লাইফের সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে নিলয় এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয় ২০ লাখ টাকা। এই টাকা দেয়া হয় ২০০৪ সালের ১৯ জানুয়ারি। ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেয়া হয় অগ্রণী ব্যাংক থেকে। বাকি ২ লাখ টাকা দেয়ার কোন নথিপত্র নেই।

মাটি ভরাট দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সালে একটি কমিটি গঠন করে হোমল্যান্ডের পরিচালনা পর্ষদ। এই কমিটিতে ছিলেন মেজর অব.সরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মো. জুলহাস, সালেহ হোসেন ও মো. আব্দুর রব। এই কমিটির অনুসন্ধানে টাকা আত্মাসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া হোমল্যান্ড লাইফ থেকে ৮১তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদাভাসীর তদন্তেও আত্মাসাতের তথ্য উঠে আসে।

পরে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর টাকা ফেরত দিতে চিঠি দেয় হোমল্যান্ড লাইফ। কিন্তু মহিউদ্দিন টাকা ফেরত না দেয়ায় প্রথমে মতিঝিল থানায় জিডি করা হয়; জিডি নং ৪৯৩/১৭। পরবর্তীতে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং- ২৮০/১৭।

হোমল্যান্ডের গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের জল্লাদ হয়ে ওঠে সিলেটের জল্লার পাড়

সিলেটের জল্লার পাড়ের জমি যেন হয়ে ওঠে হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকদের জন্য জল্লাদ। কখনো এই এলাকার জমি ক্রয়, জমি ক্রয়ের জন্য অগ্রিম, কখনো বা জমি ক্রয়ের জন্য দালালদের কমিশন পরিশোধ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় কোটি কোটি টাকা। এসব খাতে দফায় দফায় কোম্পানির তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা বের করার অপকর্মে জড়িত কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পরিচালক ও তাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন। সহজ-সরল গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের হাতিয়ার হয়ে ওঠে জল্লার পাড়ের জমি। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য  উঠে আসে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে।

২০০৭ সালের ২৪ জুন। সিলেটের দুর্নীতি দমন কমিশনে জনৈক সচেতন একজন নাগরিক অভিযোগ করেন, ২৫ লাখ টাকার জমি হোমল্যান্ডের নামে কেনা হয়েছে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে ৪০ গুণ বেশি দিয়ে হোমল্যান্ড লাইফের নামে এ জমি ক্রয় দেখানো হয়েছে মূলত কোম্পানির তহবিল তছরূপ করতে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিলেটের জল্লার পাড়ের ১২ শতাংশ একটি জমি। জমির মালিক জিন্নুরিন নাহার চৌধুরী। জিন্নুরিন নাহারের কাছ থেকে ২০০৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জমিটি কিনে নেন মুরাদ খান। জমিটি কেনা হয় ২৫ লাখ টাকায়। মুরাদ খান হোমল্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনামের শ্যালক।

এর মাত্র ৩ মাসের মাথায় এই জমি মুরাদ খান হোমল্যান্ড লাইফের কাছে বিক্রি করেন ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়। মুরাদ খান হোমল্যান্ডের কাছে এ জমি বিক্রি করেন ১৩ মে ২০০৪ সালে।

মজার বিষয় হচ্ছে, জমির মূল্য ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ধরা হলেও জমির দলিলে মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি টাকা। জমির দলিলে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্য কম দেখানো হয় সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে। এমনটাই উল্লেখ করা হয়, এই জমি ক্রয় অনুমোদন দেয়া সভার কার্যবিবরণীতে।

এখানেই শেষ নয়, জমির ক্রয়ের সাব-কবলা দলিল নেয়া হয় মুরাদ খানের কাছ থেকে। অথচ জমির মূল্য বাবদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয় জিন্নুরিন নাহারকে। আর সেই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম।

এই জমি ক্রয়ের এসব অনুমোদন দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদের ৩৪তম সভা থেকে ৩৯তম সভা পর্যন্ত এই ৬টি সভায়। এর সবগুলো সভাই অনুষ্ঠিত হয় সিলেটের জিন্দাবাজার কাজী ম্যানশন ও সিলেটে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।

জমিটি খাস জমি হওয়ায় পরবর্তীতে তা সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। ফলে আজও এ জমি হোমল্যান্ড লাইফ দখলে নিতে পারেনি।

এখানেই শেষ নয়, জল্লার পাড়ের এ জমি ক্রয়ের কমিশন বাবদ কোম্পানির তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর সেই জমির সোলেনামা ডিক্রি, জমির উন্নয়ন, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কথা বলে কোম্পানির তহবিল থেকে নেয়া হয় আরো ১৫ লাখ টাকা। এ টাকা নেন কোম্পানির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মুনিম শিপু। এ টাকার অনুমোদন দেয়া হয় কোম্পানির ৭৭তম পর্ষদ সভায়।

কিন্তু জমি দখলের নামে টাকা নিলেও দখলের কোন কাজ করেনি আব্দুল মুনিম শিপু। এতে আব্দুল মুনিম শিপুর বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে হোমল্যান্ড লাইফ। আব্দুল মুনিম শিপু কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের নিকটাত্মীয়।

জমি ক্রয়ের নামে টাকা আত্মসাতের এ অনুসন্ধানে সিলেট ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে রেকর্ড পত্রে দেখা যায়, জমিটি হাসন রাজার পরিবারের জিন্নুরিন নাহার রাজা চৌধুরির নামে রেকর্ড করা। এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়, তাছাউর রাজার সাথে।

আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের জমি আমাদেরই আছে। তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কেউ ভূয়া দলিল পত্র তৈরি করে জমি বিক্রি করেছে কিনা সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই। যেহেতু এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ নেই, আমাদের জমি বেদখল হয় নাই। তাই এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই।

জমি বিক্রির নামে সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে নিলেন ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা

হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনামের ছেলে আরাফাত কাজী। থাকেন লন্ডনে। বয়স ১৬ বা ১৭ বছর। লন্ডনে থাকা এই কাজী আরাফাতের কাছ থেকেই জমি বিক্রির প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় ৩৮তম বোর্ড সভায়। জমি কেনার অগ্রিম বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার পরিশোধের অনুমোদনও করা হয় ওই সভায়।

পরে জমির মূল্য বাবদ নেয়া টাকা ফেরত দিতে কাজী আরাফাতের পক্ষ থেকে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার একটি চেক দেয়া হয় হোমল্যান্ড লাইফকে। পরে চেকটি নগদায়ন না হওয়ায় ২০০৫ সালে কাজী আরাফাতের বিরুদ্ধে এনআই এক্ট -এ মামলা করেন হোমল্যান্ড লাইফের কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম।

মামলায় আরাফাত কাজী দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার আদেশসহ ১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এই রায়ের পর আরাফাত কাজী ৬ মাস জেল খেটে জামিন নেন। পরে আবারও বিদেশে চলে যান তিনি।

ওই মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছিল, জমি বিক্রির নামে কাজী আরফাতের পিতা হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময়ে বায়নামা বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন।

এই টাকা হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিশোধ করে ২০০৪ সালের ১১ মে থেকে একই বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সর্বমোট ২৮টি কিস্তিতে। কাজী আরাফাতের পক্ষে এ টাকা গ্রহণ করেন তার পিতা হোমল্যান্ড লাইফের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ।

অভিযোগে বলা হয়, টাকা গ্রহণের প্রতিটি ভাউচারে কাজী এনামের স্বাক্ষর রয়েছে।

মামলায় আরো অভিযোগ করা হয়, কোম্পানির পক্ষ থেকে আরাফাত কাজীকে জমি রেজিস্ট্রি দেয়ার চাপ দিলে আরাফাত কাজী জমি রেজিস্ট্রি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময়ে কাজী এনাম উদ্দিনের মধ্যস্থতায় ৫ লাখ টাকা লাভ ধরে টাকা পরিশোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

আরাফাত কাজী ২০০৪ সালে ২৯ ডিসেম্বর ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সিলেট শাখার হিসাব নং- ৩৩১১৫২০৬ এর অধীনে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেন, যার নং- ৬৩৮০৩৩৪।

চেকটি ডিজঅনার হয় ৪ এপ্রিল ২০০৫ তারিখে। নগদায়ন না হওয়ার বিষয়টি আরাফাত কাজীকে জানানো হয় ২০০৫ সালের ৭ মে। ১১ মে ২০০৫ সালে পাঠানো হয় উকিল নোটিশ।

জল্লার পাড়ের জমি ক্রয় দেখিয়ে তহবিল আত্মসাতের ঘটনায় ১৩ এপ্রিল ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত কোম্পানির ৬৬তম বোর্ড সভায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন- তৎকালীন চেয়ারম্যান ফয়জুল হক, সাবেক পরিচালক মো. মোসলে উদ্দিন ঢালী এবং এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক আমিনুল হক এফসিএ।

এই কমিটি ৮ জুলাই ২০১০ সালে দাখিল করা প্রতিবেদনে জল্লার পাড়ের জমি ক্রয়ের নামে চরম আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে মতামত দেন। এ প্রতিবেদন দাখিল করেন চার্টার্ড একাউন্টস এ হক এন্ড কোং এর নিরীক্ষক আমিনুল হক এফসিএ।

তবে ২০১১ সালে আরাফাত কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সিলেটে তার নিজ বাড়িতে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের।

কাজী ভবনের ড্রয়িং রুমে বসে এই আলাপচারিতায় আরাফাত কাজী বলেন, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যখন এ ঘটনা ঘটে তখন আমার বয়স ছিল ১৬/১৭ বছর। আমি এ সময়ে লণ্ডনে ছিলাম। এখন আপনারাই বলেন, একজন ১৬/১৭ বছরের ছেলে এতগুলো টাকা একটি লিমিটেড কোম্পানি থেকে তুলে নিবে এরকম ঘটনা কি স্বাভাবিক? আমি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে কোন টাকা নেইনি। আমি জমিও রেজিস্ট্রি দেইনি। ২ কোটি ২০ লাখ টাকার যে চেক দেয়ার কথা বলা হয়েছে এ চেকটিও আমি দেইনি। এ চেকের স্বাক্ষর আমার নয়।

আরাফাত কাজী আরো বলেন, এ সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। আমার বাবার অফিস রুম সেগুন বাগিচার গেস্ট হাউস থেকে এ চেকটি তারা সংগ্রহ করে থাকতে পারে? কোম্পানির নামে সেগুন বাগিচায় একটি গেস্ট হাউজ ছিল এখানে আমার বাবা এসে থাকতেন। এই গেস্ট হাউজে আমার ব্যাংকের চেক ছিল, কাগজপত্র ছিল। আমি জমি রেজিস্ট্রি দেইনি। আমার নামের জমি অন্য কেউ রেজিস্ট্রি দিয়েছে।

তিনি বলেন, এ সময় কোম্পানির লন্ডনে যেসব ডিরেক্টর আছেন এবং পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন তাদের মাঝে একটি ভালো সম্পর্ক ছিল। একারণে আমি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এ অভিযোগ এনে আইনের আশ্রয় নেইনি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হয়েছিল যারা এ টাকা নিয়েছে তারা কোম্পানিকে টাকাগুলো ফেরত দিবে। টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলায় তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। আমার বাবা লণ্ডনে যে সব ডিরেক্টররা আছেন তাদের চাপে এ টাকা কোম্পানি থেকে নিয়েছে। কোম্পানি থেকে এই টাকা তোলার বিষয়ে আগে থেকেই ডিরেক্টরদের মাঝে আলোচনা হয় আমার বোনের বিয়ের পর আমাদের একটি পারিবারিক পার্টিতে ৪ জুলাই ২০০৪ এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেন লন্ডনের প্রবাসী ডিরেক্টররা।

অগ্রিম বাবদ কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের আত্মসাৎ ২.১০ কোটি টাকা

এবার জমি ক্রয় করা হবে সিলেট শহরে। এ জমি কিনে দেয়ার নাম করে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ কোম্পানির তহবিল থেকে অগ্রিম নেন ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এ জমি আর কেনা হয়নি। অগ্রিম বাবদ নেয়া টাকাও থেকে যায় এনাম আহমেদের পকেটেই।

জমি কেনার জন্য অগ্রিম নেয়ার এ ঘটনা ধরা পরে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিনের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। একনাবিনের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটে জমি কেনার অগ্রিম বাবদ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ২ কোটি ১০ লাখ টাকা অগ্রিম নিলেও কোম্পানির নামে তিনি কোন জমি রেজিস্ট্রি করে দেন নাই।

পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি কোম্পানির নির্বাহী কমিটির ২৭৯তম সভায় এ টাকা কাজী এনামের নামে অগ্রিম দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়।

শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে ১৭ বছর ধরে হোমল্যান্ডের পর্ষদে ৫ পরিচালক

জালিয়াতির শেয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে হোমল্যান্ড লাইফের পর্ষদে রয়েছেন কোম্পানিটির লন্ডন প্রবাসী ৫ পরিচালক- আবদুল হাই, আবদুল আহাদ, জামাল মিয়া, কামাল মিয়া এবং জামাল উদ্দিন। এই জাল সার্টিফিকেট দিয়েই তারা ১৭ বছর ধরে তারা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন এবং ভোগ করছেন নানান আর্থিক সুবিধা।

তবে লন্ডন প্রবাসী ওই ৫ পরিচালকের দাবি, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে যাওয়ায় নতুন করে তাদের নামে ডুপ্লিকেট শেয়ার ইস্যু করা হয়। এই ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট দিয়েই তারা বীমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন।

মূলত এই ৫ পরিচালকের সবগুলো শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো বন্ধক রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বা সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে। শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো বন্ধক রেখেছেন হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ। ২০০৫ সালে তিনি এসব শেয়ার সার্টিফিকেট ব্যাংকে বন্ধক রাখেন।

এই প্রেক্ষিতে লন্ডন প্রবাসী ওই ৫ পরিচালকের শেয়ার সার্টিফিকেটের বৈধতা যাচাই করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ২০২৪ সালের ৮ মে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে এই ৫ পরিচালকের শেয়ার সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, হোমল্যান্ড লাইফ গঠন করা হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।  ওই বছরের ডিসেম্বরের ৮ তারিখে পর্ষদের ৩য় বোর্ড সভায় শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। আর ৫ জন পরিচালকের নামে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয় ৬ষ্ঠ বোর্ড সভায়। তবে শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে বোর্ড সভার অনুমোদন তৎকালীন বীমা অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন করানো হয়নি এবং স্বাক্ষর ভেরিফিকেশনও করা হয়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, হোমল্যান্ড লাইফের প্রবাসী ৫ পরিচালকের শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে যায় ২০১৪ সালের এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর মাসে। একইদিনে এসব শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে যাওয়াকে সন্দেহজনক এবং অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করে আইডিআরএ’র তদন্ত দল।

অপরদিকে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই কোম্পানির ৯৬তম বোর্ডসভায় হারিয়ে যাওয়া শেয়ার সার্টিফিকেটের বিপরীতে ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট ইস্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এই ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট ইস্যুর বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ৫ পরিচালকের মধ্যে জামাল মিয়া, আবদুল আহাদ ও কামাল মিয়া তাদের হারিয়ে যাওয়া শেয়ার সার্টিফিকেটের বিপরীতে ইস্যুকৃত কোন ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট দেখাতে পারেননি। তদন্ত দলের কাছে তারা যেসব শেয়ার সার্টিফিকেটের অনুলিপি প্রদর্শন করেছেন তা ইস্যু করা হয়েছে ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

এছাড়া আবদুল হাই এর শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো আইনজীবীর মতামত অনুসারে ডুপ্লিকেট। আর জামাল উদ্দিন শেয়ার সার্টিফিকেটের অনুলিপি প্রদান করেছেন ১৬টি। এর মধ্যে ৩টি হারিয়ে যাওয়া শেয়ার সার্টিফিকেটের বিপরীতে ইস্যু করা ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট। বাকী ১৩টি শেয়ার সার্টিফিকেট ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা।

শেয়ার সার্টিফিকেট ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টারের তথ্য পর্যালোচনা করে তদন্ত দল। এই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে হোমল্যান্ড লাইফের ৩য় ও ৬ষ্ঠ বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে পরিচালকদের শেয়ার সার্টিফিকেটের যে নম্বরের কথা উল্লেখ করা হয় তার সাথে শেয়ার সার্টিফিকেট ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টারে ৫ পরিচালকের দাখিলকৃত ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট নম্বরের কোন মিল পায়নি তদন্ত দল।

শেয়ার ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টার পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটিতে তদন্ত দল আরো বলেন, অনেক শেয়ারহোল্ডারই/ পরিচালক শেয়ার সার্টিফিকেট গ্রহণ করেননি। যার মধ্যে হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদও রয়েছেন।

শেয়ার ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টার পর্যালোচনা করে তদন্ত দল প্রতিবেদনে বলেছে, কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ যদি শেয়ার সার্টিফিকেট গ্রহণ নাই করেন তাহলে তিনি কি করে শেয়ার সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলেন।

এ ছাড়াও ২০১৬ সালে হোমল্যান্ড লাইফের ইস্যু করা ডুপ্লিকেট শেয়ার সার্টিফিকেট আবদুল হাই ব্যতিত অন্যকেউ গ্রহণ করেনি। এমনকি শেয়ার সার্টিফিকেট ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টারে কোন পৃষ্ঠা নম্বর পায়নি তদন্ত দল। তাই এই শেয়ার ডিসবার্সমেন্ট রেজিস্টারটি পরবর্তীতে বানানো হয়েছে বলে মনে করছে তদন্ত দল।