মামলার আসামি ও আত্মীয়-স্বজনরাই ফারইস্ট লাইফের পরিচালনা পর্ষদে
নিজস্ব প্রতিবেদক: ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা আত্মাসাতের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’র করা সর্বশেষ মামলায় ১৪ জন পরিচালককে আসামি করা হয়। এর আগে আরো ৩টি মামলায় কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক পরিচালকসহ একাধিক পরিচালককে আসামি হিসেবে দেখানো হয়।
অর্থ আত্মসাতে জড়িত দুদক মামলার আসামি ও যাদের যোগসাজসে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই রয়েছেন এখন পরিচালনা পর্ষদে। ফলে পর্ষদে তারা প্রভাবশালী হওয়ায় আত্মসাতকৃত অর্থ উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না ফারইস্ট ইসলামী লাইফ।
অপর দিকে কোম্পানির জমি ও ভবন বিক্রি করে গ্রাহকের দায় পরিশোধেও কোন রকমের দৃশ্যমান উদ্যোগ নিচ্ছে না বীমা প্রতিষ্ঠানটি।
এ অবস্থায় মেয়াদ শেষে দাবির টাকা না পেয়ে চরম হয়রানি ও হতাশার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য গ্রাহক। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের পুরো লাইফ বীমার বাজারে। প্রতিনিয়তই গ্রাহকরা চড়াও হচ্ছেন কোন কোন মাঠ কর্মীর ওপর। ভাঙচুর করছেন অফিস কক্ষও।
আইডিআরএ’র নিয়োগ করা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সিরাজ খান বসাক এন্ড কোং এর তদন্তে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের এই অর্থ আত্মসাতের তথ্য উঠে আসে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। পরবর্তীতে বেক্সিমকো গ্রুপ ফারইস্ট ইসলামী লাইফে’র শেয়ার কিনে নিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। সর্বশেষ ৫ আগস্টের ছাত্র জনতা গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়।
দুদকের মামলায় আসামি করা পরিচালকরা হলেন- বীমা কোম্পানিটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, যিনি প্রাইম পলিমার ও ফারইস্ট ইসলামী প্রোপার্টিজেরও চেয়ারম্যান। এছাড়া আমানত শাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. হেলাল মিয়া, পিএফআই প্রোপার্টিজ ও নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক শাহরিয়ার খালেদ, মোশারফ গ্রুপের পরিচালক ও মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান নাজনীন হোসেন, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, গেটকো টেলিকমিউনিকেশন ও গেটকো এগ্রো ভিশনের চেয়ারম্যান কে এম খালেদ, প্রাইম ব্যাংক ও প্রাইম ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা এবং ম্যাক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টি এম এ খালেক, টারটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ড. ইফফাৎ জাহান।
এই তালিকায় আরও আছেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক খন্দকার মোস্তাক মাহমুদ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রাবেয়া বেগম, স্বতন্ত্র পরিচালক ও আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন এবং স্বতন্ত্র পরিচালক ও পিএফআই সিকিউরিটিজের সাবেক এমডি কাজী ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্যাহ-কেও দুদকের মামলার আসামি করা হয়।
দুদকের করা মামলায় আসামিদের মধ্যে নাজনীন হোসেন এখনো পরিচালনা পর্ষদে আছে। তিনি মোশারফ গ্রুপের পরিচালক ও মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফারইস্টের যেসব জমি ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত করা হয়, সেই জমি ক্রয়ের কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন নাজনীন হোসেন।
এ ছাড়াও নাজনিন হোসেন পরিচালনা পর্ষদে থাকলেও তার স্বামী মোশারফ হোসেন পুস্তী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব বিস্তার করেন। একইসঙ্গে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ভূমিকা রাখেন।
দুদক মামলার আসামি মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. মো. মনোয়ার হোসেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোকাদ্দেস হোসেনের বড় ভাই। এ ছাড়াও ড. মোকাদ্দেস হোসেনের আরেক ভাই মোজাম্মেল হোসেনও দুদক মামলার আসামি।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের নিরপেক্ষ পরিচালক হিসেবে আছেন মোবারক হোসেন। তিনি দুদকের সর্বশেষ মামলার আসামি আমানত শাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. হেলাল মিয়ার ভাই এবং আমানত শাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আমানত শাহ সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ১৩৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এতে ৬০ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা লোকসান হয়। যার বিও অ্যাকাউন্ট নাম্বার হলো (১২০৪৫৭০০১১৯০৩৯২৮) ।
আইন অনুসারে, পরিচালকদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে হলে পূর্ব ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক পরিচালক হেলাল মিয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আমানত শাহ সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেন। যেখানে এই ৬০ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ২০১৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসান হিসেবে প্রভিশন দেখানো হয়।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সিরাজ খান বসাকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, মিরপুরের গোড়ান চটবাড়িতে জমি ক্রয় ও উন্নয়নের নামে ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। গোড়ান চটবাড়িতে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ২০৫তম বোর্ড সভায়। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২ মার্চ, ২০১৬।
আয়েশা হুসনে জাহান ওই সভায় পরিচালক ছিলেন। তিনি বর্তমানেও ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের তিন মামলার মধ্যে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসামি করা হয় ৯ জনকে। যাদের মধ্যে পরিচালক ছিলেন ৭ জন। তারা হলেন, নজরুল ইসলাম, কে এম খালেদ, শাহরিয়ার খালেদ, এম এ খালেক, মিজানুর রহমান, ফরিদউদ্দিন এফসিএ ও আসাদ খান।
এছাড়া ৭২ কাকরাইলের জমি কেনার ক্ষেত্রে ১১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি করা হয় ৮ জনকে। কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম, তাসলিমা ইসলামের ভাই সেলিম মাহমুদ, কোম্পানির সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্যাহ, সাবেক ইভিপি ও প্রজেক্ট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার আমির ইব্রাহিম, টিপু সুলতান, ফুয়াদ আশফাকুর রহমান এবং মোহাম্মদ আলম খান।
তবে ৩৬ তোপখানা রোডের জমি ক্রয়ে ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ১৪ পরিচালক আসামি হলেও ৭২ কাকরাইলের জমি কেনার মামলায় সব পরিচালক আসামি হননি। ৭২ কাকরাইলের জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয় কোম্পানির ২০৬তম বোর্ডসভায়। ২৪ জুন ২০১৬ সালে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সময় কোম্পানিটিতে দু’জন স্বতন্ত্রসহ মোট ১৬ জন পরিচালক ছিলেন। তাদের মধ্যে দুদকের সর্বশেষ মামলার আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। এরা হলেন- নজরুল ইসলাম, হেলাল মিয়া, নাজনীন হোসেন, ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, তাসলিমা ইসলাম, এম এ খালেক, ড. ইফফাৎ জাহান, মোজাম্মেল হোসেন, রাবেয়া বেগম, ড. এম মোশাররফ হোসেন এফসিএ।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলার ৪ নম্বর আসামি নাজনীন হোসেন, যিনি এখনো বীমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে বহাল রয়েছেন। এই অবস্থায় কোম্পানিটির আত্মসাতকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে কিনা বা প্রভাব বিস্তারের কোন সম্ভাবনা রয়েছে কিনা- সে বিষয়ে নাজনীন হোসেনের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়।
তবে ফোন কলটি রিসিভ করেন নাজনীন হোসেনের স্বামী মোশারফ হোসেন পুস্তী। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি বলেন, দুদকের মামলায় হয়তো ভুলবশত নাজনীন হোসেনের নাম এসেছে। প্রকৃতপক্ষে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও তার পরিবার এবং এম এ খালেক ও তার পরিবার ছাড়া অন্য কেউ জড়িত নয়।
“এই অর্থ আত্মসাতের সাথে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে আইনগত চ্যালেঞ্জ করব”- বলেন মোশারফ হোসেন পুস্তী।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের আরেক পরিচালক আয়েশা হুসনে জাহান গোড়ান চটবাড়ির জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত দেয়া ২০৫তম বোর্ড সভাতেও ছিলেন। ওই জমি ক্রয়ের মাধ্যমে কোম্পানিটির ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়।
তিনি বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে বহাল থাকায় কোম্পানির এসব অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে কিনা- সে বিষয়ে কথা বলতে আয়েশা হুসনে জাহানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে কোম্পানির এমডির (সিইও) সাথে কথা বলেন। এ নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাই না।
বীমা কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. মো. মোকাদ্দেস হোসেন এবং পরিচালক মো. মোবারক হোসেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এসব বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফকরুল ইসলামের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়, তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।