রূপালী ইন্স্যুরেন্সে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অর্ধশত কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি
আবদুর রহমান আবির: গ্রাহকের ১৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ অর্ধশত কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে। আইডিআরএ’র নির্দেশিত ব্যাংক একাউন্টে প্রিমিয়াম বাবদ জমা করা টাকার সাথে আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাব তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এতে আত্মসাতের এ চিত্র উঠে আসে।
তবে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের এ তথ্য উঠে আসেনি বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। যদিও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, প্রিমিয়াম আয়ের লেজার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নথিপত্র বীমা কোম্পানিটি সরবরাহ না করায় তা যথার্থ তদন্ত করতে পারেনি। এরপরও গেলো দু’বছরে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।
নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধ ও গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ করতে ২০১৯ সালের ২ জুলাই ৬৪ নং সার্কুলার জারি করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সার্কুলারটিতে ৩টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমা করার নির্দেশ দেয়া হয়।
অপর দিকে ৩টি একাউন্টের বাইরে অন্যকোনো ব্যাংক একাউন্টে প্রিমিয়াম জমা না করার অনুরোধ জানিয়ে ৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে আইডিআরএ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রূপালী ইন্স্যুরেন্সে ৩টি ব্যাংক একাউন্টে ২০২০ সালে বীমা গ্রাহকরা পলিসির মূল্য পরিশোধ বাবদ জমা করেন ৮৭ কোটি ৫০ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ টাকা। এর সাথে ২০১৯ সালের ডিপোজিট প্রিমিয়াম ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৯১৯ টাকা।
অথচ বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাবে দেখানো হয়, গ্রাহকের পলিসির মূল্য বাবদ জমা নেয়া হয়েছে ৭৪ কোটি ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৫ টাকা। অর্থাৎ বাকি ১৫ কোটি ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৮১৮ টাকা আত্মসাৎ করেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
৩টি ব্যাংক একাউন্টের মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল ব্রাঞ্চে ৫৫ কোটি ৯১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৪১ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের লোকাল ব্রাঞ্চে ৬ কোটি ২৯ লাখ ২২ হাজার ২৮ এবং আইএফআইসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চে ২৫ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার ৩৬৫ টাকা জমা করে রুপালী ইন্স্যুরেন্স।
অপর দিকে আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম আয় সংক্রান্ত ৭৪ কোটি ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৫ টাকা হিসাবের মধ্যে- নিজস্ব প্রিমিয়াম (ডাইরেক্ট বিজনেস) আয় ৬১ কোটি ৮৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬০১ টাকা, প্রিমিয়াম ডিপোজিট ক্লোজিং হিসেবে ২ কোটি ১৭ লাখ ২২ হাজার ৬৩৪ টাকা, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প বাবদ সরকারের রাজস্ব প্রদান ১০ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালের প্রিমিয়াম ডিপোজিট ক্লোজিং হিসেবে দেখানো হয় ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৯১৯ টাকা।
আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী কোম্পানি যথাযথ ব্যাংক একাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ করে কিনা তা যাচাই করা সহ অন্যান্য অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ মে পর্যন্ত নিরীক্ষা করতে আহসান মঞ্জুর এন্ড কোং-কে নিরীক্ষক নিয়োগ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
তবে বিশেষ এ নিরীক্ষায় প্রিমিয়াম আত্মসাৎ হয়েছে কিনা তা তদন্ত করতে পারেনি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহসান মঞ্জুর এন্ড কোং। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির মতে, ব্যাংক একাউন্ট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেনি কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও বেশিরভাগ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের লেজার বই সরবরাহ না করায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিস্তারিত যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, রূপালী ইন্স্যুরেন্স গেল ২ বছরে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। রিটার্ন দাখিলে ৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকার বেতন-ভাতা কম দেখিয়েছে। ভুয়া নথিপত্রে বীমা দাবি পরিশোধ করেছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর্থিক প্রতিবেদনে বেতন-ভাতার ৫১ লাখ টাকা গোপন করা হয়েছে। ওভাররাইটিং করা হয়েছে বেতন শিটে।
ব্যবস্থাপনা খাতে দুই বছরে ২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অতিরিক্ত ব্যয়:
ব্যবস্থাপনা ব্যয় যাচাইয়ের জন্য এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত ব্যাংক একাউন্ট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেনি কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও বেশিরভাগ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের লেজার বই সরবরাহ না করায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিস্তারিত যাচাই সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে বিশেষ নিরীক্ষক।
তবে আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহসান মঞ্জুর এন্ড কোং জানিয়েছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে রূপালী ইন্স্যুরেন্স মোট ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪১৭ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
এই দুই বছরে কোম্পানিটি মোট ব্যয় করে ৬৭ কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ৭০ টাকা। অথচ ব্যয়ের অনুমোদন ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৮৪ হাজার ৫৯৯ টাকা।
২০২০ সালে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ১২ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৯৪ টাকা, যা অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি। আর ২০১৯ সালে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৭ টাকা বা ৩০ শতাংশ বেশি।
রিটার্ন দাখিলে ৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকার বেতন-ভাতা গোপন:
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দাখিলকৃত রিটার্নের তথ্যের সাথে আর্থিক প্রতিবেদন ও মাসিক বেতন শিটের তথ্যেও তারতম্য পেয়েছে বীমা কোম্পানিটিতে নিয়োজিত বিশেষ নিরীক্ষক।
২০২০-২০২১ অর্থ বছরের রিটার্নে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের প্রদত্ত বেতন-ভাতা দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৪২৩ টাকা। অথচ মাসিক বেতন শিটে এ খাতের খরচ দেখানো হয়েছে ১৫ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ টাকা।
এই হিসাবে কোম্পানিটি রিটার্ন দাখিলের সময় ৮ কোটি ৫৪ লাখ ৪ হাজার ৩৬৭ টাকা গোপন করেছে। তবে আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এই গোপনের পরিমাণ ৮ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৬০৪ টাকা।
ভুয়া নথিপত্রে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ:
মণ্ডল গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠান ট্রপিক্যাল নিটেক্স লিমিটেডের উত্থাপিত অগ্নি বীমা (পলিসি নং আরআইসি/জিইউবি/এফপি-১৬৩/১২/১৫, তারিখ- ০১/১২/২০১৫) দাবির সকল নথিপত্র ভুয়া বা জাল বলে দাবি করেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহসান মঞ্জুর এন্ড কোং। ভুয়া নথিপত্রে উত্থাপিত এই বীমা দাবি বাবদ ৫ কোটি ৬২ লাখ ৭ হাজার ৭০১ টাকা পরিশোধ করেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স।
বিশেষ নিরীক্ষক বলছে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হিসাবের বই থেকে মূল নথিপত্রের অনুলিপি তৈরির কাজের চাপ কমানোর জন্য ইচ্ছাকৃত এ ধরণের জাল নথিপত্র উত্থাপন করেছে বীমা দাবিদার বা গ্রাহক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও গভীরভাবে যাচাই-বাছাই না করেই বীমা দাবিটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই অর্থ পরিশোধ করেছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
বেতন-ভাতার ৫১ লাখ টাকা আর্থিক প্রতিবেদনে হাওয়া:
চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ফার্মটি জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্যও সরবরাহ করেনি রূপালী ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ। এসব কারণে প্রধান কার্যালয় কর্মকর্তাদের বেতন ও ভাতাদি যাচাই করা সম্ভব হয়নি এবং যদি কোন ভুতুড়ে কর্মচারীর অস্তিত্ব থেকে থাকে তাও চিহ্নিত করা যায়নি।
তবে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক প্রতিবেদন ও মাসিক বেতন শিটে উল্লেখিত বেতন-ভাতার মধ্যে তারতম্য খুঁজে পেয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানিটি বেতন-ভাতা খাতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে ১৪ কোটি ৫১ লাখ ১১ হাজার ২৭ টাকা। অথচ মাসিক বেতন শিটে ২০২০ পঞ্জিকা বর্ষে বেতন-ভাতা বাবদ মোট খরচ ১৫ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ৭৯০ টাকা। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিবেদনে বেতন-ভাতার ৫১ লাখ ৯ হাজার ৭৬৩ টাকা কম দেখিয়েছে।
এ ছাড়াও কোম্পানিটির কিছু শাখা অফিসের কয়েক মাসের ব্যাংক স্যালারি এডভাইস পাওয়া যায়নি।
বেতন শিটে ওভাররাইটিং, ভুয়া কর্মচারীর শঙ্কা:
নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান বলছে, রিটার্নে সব কর্মকর্তার তথ্য অন্তর্ভুক্ত না করায় ভুয়া কর্মচারীর উপস্থিতি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানিটির অনেক মাসের বেতন শিটে ওভাররাইটিং করা হয়েছে। কিন্তু ওভাররাইটিংয়ের বিষয়ে কোন সত্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি এবং সেখানে কর্তৃপক্ষের কোন স্বাক্ষর নেই।
এ ছাড়াও প্রমোশন ও পদোন্নতির তালিকা সরবরাহ করলেও তাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির তথ্য দেয়নি রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এ কারণে প্রমোশন ও পদোন্নতির সত্যতাও যাচাই করতে পারেনি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহসান মঞ্জুর এন্ড কোং।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পি কে রায়, কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আতিকুর রহমান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী কাজী ইমরুল হোসাইনের সাথে ২৩ মার্চ ২০২২ থেকে একাধিকবার স্ব-শরীরে দেখা করে লিখিত আকারে মতামত চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাহীর সাথে কথা বলে মতামত দিবেন বলে একাধিক দিন জানান কোম্পানি সেক্রেটারি আতিকুর রহমান। কিন্তু তিনি প্রতিবার যোগাযোগের সময়ই জানান মুখ্য নির্বাহীর সাথে তিনি কোন কথা বলতে পারেননি। তার সাথে কথা বলেই তিনি জানাবেন। সর্বশেষ আজ (৩ এপ্রিল, ২০২২) সকালে ফোন করার পর দুপুরে ক্ষুদে বার্তা দেয়ার পরও কোন সাড়া দেননি কোম্পানি সেক্রেটারি।