হিসাব সমাপনী ২০২১: লাইফ বীমায় মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ
তাফহিমুল ইসলাম: সর্বশেষ হিসাব সমাপনী বছর ২০২১ সালে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৩৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৮.৭৯ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ ১৫.৪৮ শতাংশ ও নবায়ন সংগ্রহ ৫.৯০ শতাংশ বেড়েছে। লাইফ বীমা কোম্পানির ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব সমাপনী প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৩৫টি কোম্পানির মধ্যে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৩০টি কোম্পানির, কমেছে ৫টির। ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ২৯টি কোম্পানির, কমেছে ৬টির। নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ২৮টি কোম্পানির, কমেছে ৫টি কোম্পানির।
২০২১ সালে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১০ হাজার ২৮২ কোটি ১১ লাখ টাকা। যা আগের বছর ২০২০ সালে ছিল ৯ হাজার ৪৫১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৮৩০ কোটি টাকা।
মোট প্রিমিয়াম (গ্রস প্রিমিয়াম) সংগ্রহের শীর্ষে রয়েছে মেটলাইফ। কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ২ হাজার ৯৩২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যা আগের বছরে ছিল ২ হাজার ৭৮৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। সে হিসাবে ২০২১ সালে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ১৭৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা বা ৫.২৯ শতাংশ।
দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহের শীর্ষে রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ। ২০২১ সালে কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ১ হাজার ৩৮১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ১৫.০৩ শতাংশ।
চতুর্থ প্রজন্মের (২০১৩ সালে লাইসেন্স প্রাপ্ত) কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০২১ সালে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহে এগিয়ে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটি আলোচ্য বছরে ৩১৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে। এর আগে ২০২০ সালে এই সংগ্রহ ছিল ১৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে গেলো বছর কোম্পানি ১৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা বা ১৩৭.৫০ শতাংশ বেশি প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে।
মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে ৫টি কোম্পানির। এর মধ্যে সবচে বেশি কমেছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের। ২০২১ সালে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে ২১৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২০২১ সালে কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৭৫৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। যা গত বছর ছিল ৯৭৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে যাওয়া কোম্পানির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পদ্মা ইসলামী লাইফ। ২০২১ সালে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটির মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৩৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৫১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ ছাড়াও মেঘনা লাইফের কমেছে ১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, বেস্ট লাইফের কমেছে ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং বায়রা লাইফের কমেছে ৯১ লাখ টাকা।
১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ১৫.৪৮ শতাংশ
২০২১ সালে ৩৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির মধ্যে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ২৯টি কোম্পানির, কমেছে ৬টির। মোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে মোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৩ হাজার ২৮৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ২ হাজার ৮৪৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। শতাংশের হিসাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫.৪৮ শতাংশ।
১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে সোনালী লাইফের। ২০২১ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছিল ২০১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ৭৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে গেলো বছর কোম্পানিটির ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ১২৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ। কোম্পানিটির ২০২১ সালে মোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ৪০৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ৩৪০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। গেলো বছরে কোম্পানিটির ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৬৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এরপরের অবস্থানে রয়েছে গার্ডিয়ান লাইফের। কোম্পানিটি ২০২১ সালে ৫৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। কোম্পানিটির মোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ ৩৩২ কোটি ৪ লাখ টাকা।
১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ সবচেয়ে বেশি কমেছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের। কোম্পানিটির ২০২১ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে ১২০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। কোম্পানিটির ২০২০ সালে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ২১৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০২১ সালে কোম্পানিটির সর্বমোট ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ এসে দাঁড়িয়েছে ১১৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
১ম বর্ষ প্রিমিয়াম কমে যাওয়ার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পপুলার লাইফ। গেলো বছর কোম্পানিটির ৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে। এ ছাড়াও রূপালী লাইফের কমেছে ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা, বেস্ট লাইফের কমেছে ৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের ৩ কোটি ৭৪ লাখ এবং বায়রা লাইফের কমেছে ২৪ লাখ টাকা।
নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৫.৯০ শতাংশ
২০২১ সালে লাইফ বীমা খাতে মোট নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ৩৮৯ কোটি টাকা। আলোচ্য বছরে ২৮টি কোম্পানির নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে, কমেছে ৫টির। লাইফ বীমার ৩৫টি কোম্পানির মধ্যে ৩২টি কোম্পানির ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব সমাপণীর প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
৩২টি লাইফ বীমা কোম্পানি ২০২১ সালে মোট নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৬ হাজার ৯৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ৬ হাজার ৫৮৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। শতাংশের হিসাবে এই নবায়ন সংগ্রহ বেড়েছে ৫.৯০ শতাংশ।
২০২১ সালে লাইফ বীমার নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহের শীর্ষে মেটলাইফ। কোম্পানিটি ২০২১ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ২ হাজার ৪৬৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যা আগের বছরে ছিল ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই বছর নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে ১১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
৯৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ। কোম্পানিটি ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বেশি নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে। পপুলার লাইফ আগের বছরের চেয়ে ২০২১ সালে নবায়ন প্রিমিয়াম ৮৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা বেশি সংগ্রহ করেছে।
মোট নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে ১১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা কম প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে। কোম্পানিটি ২০২১ সালে মোট নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৬৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এ ছাড়াও গেলো বছর পদ্মা ইসলামী লাইফের ১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, মেঘনা লাইফের ১৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, বেস্ট লাইফের ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা, প্রোগ্রেসিভ লাইফের ৮৩ লাখ টাকা, বায়রা লাইফের ৬৭ লাখ টাকা এবং প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের ৪ লাখ টাকা নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমেছে।
লাইফ বীমা খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহের বিষয়ে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আপেল মাহমুদ বলেন, বীমা খাতে ডিজিটাইজেশন শুরু হয়েছে এবং এর ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এরইমধ্যে গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। করোনার ধাক্কা সামলে নিয়ে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশের বীমা খাত।
তিনি বলেন, বীমা খাত উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এই ডিজিটাইজেশন। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ইউনিফাইড ম্যাসেজিং প্লাটফর্ম (ইউএমপি)’র এপিএ সিস্টেম সকল কোম্পানিতে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এ খাতে যেমন আরো স্বচ্ছতা আসবে, তেমনি ব্যবসাও বৃদ্ধি পাবে।
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ২০২০ সাল থেকে বীমা দিবস পালন শুরু হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এতে অংশ নেন। যার কারণে বীমা সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা পাল্টে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি এখন বীমার প্রতি আগ্রহী হয়ে এ পেশায় আসছেন। প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও দক্ষতা বাড়ছে কর্মকর্তাদের। এর ফলে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বাড়ছে এবং পুরো বীমা খাত প্রবৃদ্ধির ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি, এই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে এবং জিডিপিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে দেশের বীমা খাত।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন বলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে ব্যবসা বৃদ্ধি করা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। এ জন্য আমরা ২০২১ সালের শুরুতেই কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এরমধ্যে আধুনিক কল সেন্টার সেট আপ করা হয় প্রধান কার্যালয়ে, যা গ্রাহকদের যেকোন ধরনের তথ্যসেবা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের নবায়ন প্রিমিয়াম হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও ওয়ান স্টপ সার্ভিস ও স্বয়ংক্রিয় পরিষেবার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এসব কারণে গেলো বছর প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে।