পরিচালনা পর্ষদ গঠনে কোন নীতিমালা মানছে না বীমা কোম্পানিগুলো

আবদুর রহমান আবির: পরিচালনা পর্ষদ গঠনে কোন নীতিমালা মানছে না দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। এর ফলে বীমা কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ঝুঁকিতে রয়েছে কোম্পানিগুলোর বীমা গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ।

আইন বলছে, একই পরিবারের দু’জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না এবং সর্বোচ্চ শেয়ার ধারণের পরিমাণ হবে ১০ শতাংশ। আবার পরিচালক হতে গেলে সর্বনিম্ন শেয়ার থাকতে হবে ২ শতাংশ। এ ছাড়াও পরিচালনা পর্ষদে নিরপেক্ষ পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার পরিচালক থাকতে হবে। আবার বীমা কোম্পানির পরিচালকরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবে না বলেও আইনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসবের কোনটাই মানছে না বীমা কোম্পানিগুলো।

বীমা কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এবং নিরপেক্ষ পরিচালক নির্বাচনে আইনে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হলেও অধিকাংশ কোম্পানি এই দুই ধরণের পরিচালক নির্বাচন করছে পছন্দমতো নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্য থেকে।

আবার কেউ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হলে বীমা কোম্পানির পরিচালক রাখছেন তার স্ত্রী বা সন্তানকে। এক্ষেত্রে স্ত্রী পরিচালক হলেও বোর্ড সভায় থাকছেন ব্যক্তি নিজেই। এমনটা করা হয় যাতে, বোর্ডে প্রভাবশালীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোন বাধার সৃষ্টি না হয়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুসারে পরিচালনা পর্ষদ গঠন না করা হলে বা অযোগ্য কাউকে পরিচালক করলে কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ ধরণের পরিচালনা পর্ষদে ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত আসতে পারে, যা ব্যক্তি স্বার্থের অনুকূলে থাকলেও গ্রাহকস্বার্থের পরিপন্থী। এ ছাড়াও এমন কোন একগুয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে যাতে কোম্পানির স্টেকহোল্ডাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের বীমা খাতে ব্যবসা পরিচালনাকারী অন্তত ১১টি কোম্পানিতে পারিবারিক শেয়ারহোল্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬টি লাইফ বীমা কোম্পানি এবং ৫টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি। এসব কোম্পানিতে পারিবারিক শেয়ারহোল্ডিংয়ের পরিমাণ ১০.৩৪ থেকে ৩১.৮৫ শতাংশ পর্যন্ত।

এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানিক মালিকানার ক্ষেত্রে ১১.৬৭ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারধারণকারী রয়েছে বীমা কোম্পানিতে। আবার এককভাবে কোম্পানির ৯.৯ শতাংশ শেয়ারধারণের পাশাপাশি চাকরিও করছেন ওই বীমা প্রতিষ্ঠানে -এমন নজিরও রয়েছে।

বর্তমানে দেশের বীমা বাজারে সরকারি বেসরকারি ৮১টি কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ১টি সরকারি ও ৩৪টি বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানি রয়েছে। অন্যদিকে নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১টি সরকারি খাতের ও ৪৫টি বেসরকারি খাতের।

বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বীমা আইন ২০১০ এর ৭৬(১) ধারার বিধান হচ্ছে- কোন বীমা কোম্পানির পরিচালকের সংখ্যা ২০ জনের বেশি হতে পারবে না এবং সেক্ষেত্রে ১২ জন উদ্যোক্তা পরিচালক ও ৬ জন জনগণের অংশের শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক এবং ২ জন নিরপেক্ষ পরিচালক থাকবেন।

আইনটিতে আরো বলা হয়েছে, শেয়ারগ্রহীতাগণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিচালক নির্বাচন করবে।

অর্থাৎ কোন বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠনের ক্ষেত্রে ৩ ধরনের পরিচালক প্রয়োজন- উদ্যোক্তা পরিচালক, শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক ও নিরপেক্ষ পরিচালক। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ পরিচালকের সংখ্যা ২ জন নির্ধারিত হলেও উদ্যোক্তা পরিচালক ও শেয়ার গ্রহীতা পরিচালকের অনুপাত হবে ২:১।

উদ্যোক্তা পরিচালকদের বিষয়ে বীমাকারীর মূলধন ও শেয়ার ধারণ বিধিমালা- ২০১৬ বলছে, কোন ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এককভাবে বা যৌথভাবে বা কোন কোম্পানি কোন বীমাকারীর শতকরা ১০ ভাগের অতিরিক্ত শেয়ার ধারণ করতে পারবেন না। আবার উদ্যোক্তা পরিচালকের শেয়ার বীমাকারীর মোট পরিশোধিত মূলধনের শতকরা ২ ভাগের নিম্নে হতে পারবে না।

অন্যদিকে বীমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা ২০১৩ অনুসারে, পরিচালকের ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডিং ২ শতাংশের কম হওয়া যাবে না। নিজের পরিবারের পরিচালক সংখ্যা ২ এর অধিক নয় এবং ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হবে না। আবার নিজের পরিবারে পরিচালক সংখ্যা ২ কিন্তু ধারণকৃত শেয়ারের পরিমাণ ৫ শতাংশের কম হবে না।   

এ ছাড়াও বীমা কোম্পানির পরিচালক অন্য কোন ব্যাংক বা একই শ্রেণীর বীমা কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকতে পারবেন না। আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়েছেন অথবা প্রতারণামূলক কাজের সাথে জড়িত, অর্থনৈতিক অপরাধ ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হলেও বীমা কোম্পানির পরিচালক পদ ধারণের অযোগ্য বিবেচিত হবেন।

উল্লেখ্য, বীমা আইন ২০১০ এর ২(১৮) ধারা অনুসারে ‘পরিবার’ অর্থ স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল সকলেই অন্তর্ভুক্ত।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক বীমা কোম্পানিতে নিজের পরিবারের সদস্য ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল অনেকেই পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। তবে কৌশলগতভাবে ওইসব নির্ভরশীল ব্যক্তি তাদের ব্যবসাকে পৃথকভাবে দেখাচ্ছেন এবং পৃথকভাবে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করে নিজেদেরকে নির্ভরশীল ব্যক্তি নন বলে প্রমাণের অপচেষ্টা করে থাকেন।

বীমা বিধিমালা- ১৯৫৮ এর বিধি ১৫/ক অনুসারে, শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক নির্বাচনের জন্য দু’টি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে ৬০ দিন আগে বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে অখ্যাত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পছন্দের পরিচালক নির্বাচনের অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়াও শেয়ার গ্রহীতা পরিচালকের ক্ষেত্রে নির্বাচনের কমপক্ষে ৬ মাস আগে থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তবে সাধারণ শেয়ার গ্রহীতাদের মধ্য থেকে ২ শতাংশ শেয়ারধারণ করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বীমা আইন ২০১০ এর ৭৬(১) ধারা অনুসারে, বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ২ জন নিরপেক্ষ পরিচালক থাকবেন। তবে বিএসইসি’র বিধান মতে, নিরপেক্ষ পরিচালক হবেন মোট পরিচালকের এক-পঞ্চমাংশ।

এ বিষয়ে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ পাভেল বলেন, পছন্দ বা অপছন্দের পরিচালক হওয়া কোন সমস্যা নয়; আইন পরিপালনই মুখ্য। তবে সমস্যা হয় যখন পরিচালনা পর্ষদে গ্রুপিং তৈরি হয়। সম্প্রতি দু’/একটি লাইফ বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে বিতর্কের ঘটনাও আমরা দেখতে পেয়েছি। এ ধরণের ঘটনা শেয়ারহোল্ডার বা গ্রাহক- কারো জন্যই ভালো নয়।

তবে অবশ্যই আইন মেনে পরিচালনা পর্ষদ গঠন হতে হবে। আইনের বাইরে গিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন হলে সেটা সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির জন্য যেমন ভালো না, তেমনি এ খাতের জন্যও নেতিবাচক ইমেজ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। তাই বীমা আইন ও বিএসইসি’র নির্দেশনা মেনেই আমাদেরকে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে হবে, বলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ পাভেল।

বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠনে আইন পরিপালনের বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র বক্তব্য নেয়া চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র না থাকায় এ বিষয়ে কোন বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।