আইন লঙ্ঘন করে ৩ বছর ধরে মুখ্য নির্বাহী পদ শূন্য আকিজ তাকাফুলের
নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন লঙ্ঘন করে ৩ বছর ধরে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য রেখেছে নতুন লাইফ বীমা কোম্পানি আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি। ২০২১ সালের ৬ মে কোম্পানিটি লাইফ বীমা ব্যবসা করার অনুমোদন পায় এবং তখন থেকেই কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য রয়েছে।
আইন অনুসারে কোনো বীমা কোম্পানি মুখ্য নির্বাহীর পদ ৩ মাসের বেশি শূন্য রাখা যায় না। বিশেষ ক্ষেত্রে আরো ৩ মাস সময় বৃদ্ধি করতে পারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । আইন লঙ্ঘন করে মুখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য রাখা হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে বীমা আইনে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি অনুমোদন পায় ৬ মে ২০২১ সালে। আর কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়ার জন্য আবেদন করে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে। অর্থাৎ কোম্পানিটি অনুমোদনের ১ বছর ৪ মাস ২১ দিন পর আবেদন করে। এ সময় মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীর নিয়োগ অনুমোদন দিতে আবেদন করা হয়। এ আবেদন করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন।
মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীকে যখন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়ার আবেদন করা হয় তখন মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে তার কর্ম অভিজ্ঞতা ছিল ১ বছর ২ মাস ১৯ দিন। আইন অনুসারে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৩ বছর। উল্লেখ্য, তখনো সংশোধিত প্রবিধানমালা হয়নি।
মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীকে আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য করা কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিনের আবেদনটি না-মঞ্জুর করা হয় ১৪ মার্চ ২০২৩ সালে। অর্থাৎ আবেদন করার ৬ মাস ৮ দিন পর।
না-মঞ্জুর পত্রে স্বাক্ষর করেন আইডিআরএ’র পরিচালক আব্দুল মজিদ। না-মঞ্জুর পত্রে বলা হয়, মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে আলমগীর চৌধুরীর কর্ম অভিজ্ঞতা ১ বছর ৮ মাস। প্রবিধানমালা অনুসারে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাই আবেদনটি না-মঞ্জুর করা হলো।
না-মঞ্জুর করে দেয়া ওই পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, ভবিষ্যতে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রবিধানমালা অনুসারে প্রস্তাবিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, মোট অভিজ্ঞতা, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা আছে কি না তা বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ অনুসারে যাচাই বাছাই করে যেন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করা হয়।
সেই সাথে নির্দেশ দেয়া হয় বীমা আইন ২০১০ এর ৮০ (৪) ধারা অনুসারে মুখ্য নির্বাহীর পদ ৩ মাসের বেশি শূন্য রাখা যাবে না। তাই ৩ মাস পুর্তির ১৫ দিন আগেই আবেদন করতে হবে।
কিন্তু আইডিআরএ’র না-মঞ্জুর পত্রের ওই নির্দেশ আমলে নেননি আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’র চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন।
মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীকে মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনেুমোদন দিতে পুনরায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন। এই আবেদন করা হয় ১৪ নভেম্বর ২০২৩ সালে। এ সময়ে আলমগীর চৌধুরীর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে অভিজ্ঞতা ২ বছর ৫ মাস ৪ দিন।
এই আবেদনে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন দাবি করেন দফায় দফায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যাওয়ায় বিশেষ বিবেচনায় মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীর নিয়োগ অনুমোদন করার।
যদিও আলমগীর চৌধুরীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তার সনদ যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় আইডিআরএ। আলমগীর চৌধুরী দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা থেকে ২০০৩ সালে বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। আর এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৪ সালে।
এসব সনদের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে চিঠি দেয় আইডিআরএ। এর প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে আইডিআরএ পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা অনুমোদন পায় ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে, বিবিএ প্রোগ্রাম অনুমোদন করা হয় ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে। আর এমবিএ প্রোগ্রামটি অনুমোদন দেয়া হয় ৩০ অক্টোবর ২০০৩ সালে।
পত্রে আরো জানানো হয়, বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাকার্যক্রম চালু ছিল ২০০৬ সাল পর্যন্ত। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টি চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়ার আদেশ উচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির ঠিকানা জটিলতা, চলমান মামলা, বিওটি গঠন সংক্রান্ত বিভ্রান্তি, সনদ বাণিজ্য, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় কমিশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয় নাই।
এর মধ্যে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ সংক্রান্ত প্রবিধানমালা ২০১২ এর সংশোধন করে প্রবিধানমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত প্রবিধানমালা অনুসারে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ২ বছর।
আলমগীর চৌধুরীকে মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদন দিতে আবারো আবেদন করা হয় চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি। এ সময় আলমগীর চৌধুরীর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে কর্ম অভিজ্ঞতা ২ বছর ৭ মাস ১১ দিন।
এসব বিষয়ে তাকাফুল ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী বলেন, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুসারে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আমার নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করেছিল। তবে প্রথম দফায় আমার অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না হওয়ায় সে আবেদন গ্রহণ করেনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যোগ্য মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশিত কোন মুখ্য নির্বাহী পাওয়া যায়নি।
আলমগীর চৌধুরী বলেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রবিধানমালা সংশোধনের পর যোগ্যতার সব শর্তই আমার পূর্ণ হয়েছে। এ কারণে আকিজ তাকাফুল লাইফ কর্তৃপক্ষ আবারো আমাকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন জানিয়েছে। সেটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়তো যেকোন সময় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সব সময়ই কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করছে বলে দাবি করেন তিনি।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে বলেন, আকিজ তাকাফুল লাইফ কর্তৃপক্ষ যদি মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের আবেদন করে থাকে তাহলে সেটা ‘অন প্রোসেস’। তবে কোন ব্যক্তির নিয়োগ আবেদন কর্তৃপক্ষ নাকোচ করলে সেটি অনুমোদনের জন্য আবারো কর্তৃপক্ষে পাঠানো নিয়মের পরিপন্থী।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর ৩ বছরে একজন যোগ্য মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে না পারাটা স্বাভাবিক বিষয় নয়; এ জন্য তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কারণ, কোন বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর পদ সর্বোচ্চ ৬ মাসের বেশি শূন্য রাখার সুযোগ নেই আইনে।