করোনা আতঙ্কে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে হারিয়েছে
এস এম নুরুজ্জামান: আসলে করোনা ভাইরাস যতটা না মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি করোনা আতঙ্কে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে হারিয়েছে। মৃত্যুর চেয়েও মনুষ্যত্বের এই মৃত্যু নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেদনাদায়ক।
করোনা ভাইরাসজনিত মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনুসারে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সারাবিশ্বে ২২ লাখ ৩৭৭ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৭ জন মারা গেছেন এবং ৫ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮ জন করোনা-আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
মৃত্যুর হারের দিকে থেকে এবং আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে এখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৩৪ হাজার ৬৪১ জন মারা গেছেন।
বাংলাদেশের করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৮ জন, মারা গেছেন ৭৫ জন।
করোনা নিয়ে সতর্কতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থায় করণীয় যা কিছু সেটা করার প্রয়োজন অবশ্যই আছে।
কিন্তু করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া এবং আতঙ্কটা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেখানে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে হারাতে বসেছে।
এর পেছনে কারণটা কী? রহস্যটা কী?
আমরা যদি দেখি, গড়ে বিশ্বে প্রত্যেক বছর ১০০ কোটি মানুষ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। এবং ২ লাখ ৯১ হাজার থেকে ৬ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ মারা যায়। এটি প্রতি বছরের ফ্লু-তে মৃত্যুর হিসাব।
পৃথিবীতে ফ্লু ছাড়া যদি আমরা মৃত্যুর হিসাব দেখি, প্রতি বছর ৫ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ২৪৪ জন মারা যান। প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৪ জন। আর প্রতিঘণ্টায় মারা যাচ্ছেন ৬ হাজার ৫৩৬ জন।
যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে এখন করোনার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি সেখানেও প্রতিবছর ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৬৮৮ জন মারা যায় এবং প্রতিদিন সেখানে মৃত্যুর হার হচ্ছে ৭ হাজার ৭৫৫ জন।
বাংলাদেশে করোনায় এই পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৫ জন। ২০১৬ সালের রিপোর্ট, বাংলাদেশে প্রতি বছর মৃত্যুর হার হচ্ছে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৬২ জন। প্রতিদিন বাংলাদেশে মারা যান ২ হাজার ৪৩৯ জন। এবং প্রতিঘণ্টায় মারা যায় ১০২ জন।
সেখানে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা হচ্ছে ৭৫ জন।
বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ কী?
বাংলাদেশে যদি আমরা দেখি, মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে হার্ট ডিজিজ, হৃদরোগ। ২০১৬ সালে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬০ বাংলাদেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১ লাখেরও বেশি মানুষ এবং প্রত্যেক বছর ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হন ১৫ লাখ মানুষ।
প্রতিবছর যেখানে ১ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। যেখানে ১ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, সেটা নিয়ে আমাদের আতঙ্ক নাই, সেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আতঙ্ক নাই। কিন্তু করোনা নিয়ে মানুষকে আতঙ্কিত, ভীত-সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে কেন!
আমরা যদি দেখি, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে ধূমপান। স্বাস্থ্যগত যে পাঁচটি প্রধান ঝুঁকির উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হচ্ছে ধূমপান।
অথচ যে ধূমপান মৃত্যুর প্রধান কারণ বাংলাদেশে, সে ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা না বাড়িয়ে করোনা নিয়ে আতঙ্কে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ছি। এটা কেন?
আতঙ্কিত হতে গিয়ে আমরা মনুষ্যত্বের বিনাশ ঘটাচ্ছি এবং আতঙ্কিত হতে গিয়ে আমরা যে শুধু নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারই ক্ষতিসাধন করছি তা নয়, আমরা আমাদের মনুষ্যত্বেরও বিনাশ ঘটাচ্ছি এই আতঙ্কিত হয়ে।
আসলে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ভোগবাদী সভ্যতার যে অমানবিক রূপ সেটা করোনা আমাদের কাছে এবার খুব পরিষ্কার করে দিয়েছে।
করোনায় ইউরোপে মৃত্যুর হার এত বেশি কেন?
মূল কারণ তাদের পণ্য-আসক্তি, ভোগবাদী আসক্তি, তাদের স্বার্থপরতা, স্বার্থকেন্দ্রিকতা।
আমরা দেখতে পাই ওল্ড এজ হোমে- সে ইটালি হোক, ফ্রান্স হোক, ইংল্যান্ড হোক, বা যুক্তরাষ্ট্র – বিপুলসংখ্যক প্রবীণ মারা গেছেন কোনো রকম চিকিৎসা বা যত্ন ছাড়া।
শুধু প্রবীণদের প্রতি নয়, সেখানকার রোগাক্রান্ত মানুষের একটি বড় অংশ অভিবাসীরা। অভিবাসী শ্রমিকরা।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় নিহতের সংখ্যা এবং করোনার এত বিস্তার- এই বিস্তারের মূল কারণ হচ্ছে তাদের ব্যর্থ স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
আসলে সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তে রয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবসা। যে কারণে প্রান্তিক মানুষ- বিশেষত কালো মানুষ এবং অভিবাসীরাই এই করোনার প্রধান শিকার যুক্তরাষ্ট্রে।
ভোগবাদী, বস্তুবাদী, পুঁজিবাদী সভ্যতার যে দম্ভ- সেই দম্ভের আসল স্বরূপ বিশ্বের মানুষের কাছে এখন খুব পরিষ্কার।
বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্কের অমানবিক রূপ;
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যিনি করোনাকে পাত্তাই দেননি, তিনি করোনা থেকে নিরাপত্তা লাভের জন্যে হোয়াইট হাউজে ঝাড়-ফুঁকের ব্যবস্থা করেছেন এবং তারপরে তিনি কোথায় সেটা নাকি জানা যাচ্ছে না (আর কি) । নিরাপদ স্থানে রয়েছেন যাতে করোনায় আক্রান্ত না হন।
আসলে যাদের মধ্যে অমানবিকতা যত বেশি, তাদের ভয় এবং আতঙ্ক তত বেশি।
সৌদি বাদশা এক জায়গায় গিয়েছেন আর সৌদি যুবরাজ তার মন্ত্রীদের নিয়ে নিরাপদ কোনো দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন।
আসলে যারা নিজেদেরকে সভ্য মানুষ বলে দাবি করেন, করোনা তাদের অমানবিক রূপ, অমানুষিক রূপ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।
অমানবিকতার দিক থেকে এবং মনুষ্যত্বহীনতার দিক থেকে অস্ট্রেলিয়াও কোনোভাবেই পিছিয়ে নাই।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরপরই সেখানকার প্রধানমন্ত্রী খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ছাড়া আর কারও দায়িত্ব তারা নেবেন না।
আমাদের দেশেও মনুষ্যত্বহীনতার প্রকাশ;
করোনা যে শুধু দেশের বাইরের মনুষ্যত্বহীনতাকেই প্রকাশ করেছে তা নয়। দেশের ভেতরে আমাদের সমাজেও সেই ভয়ানক রূপটি আমরা দেখছি।
আমরা এখন কেউ একটা হাঁচি দিলে, কেউ একটা কাশি দিলে ভীত সন্ত্রস্ত এবং অসহিষ্ণু দৃষ্টিতে আমরা তার দিকে তাকাই। একজন খুব কৌতুক করে বলছিলেন যে, বাঙালি এখন কাশি দিতেও ভুলে গেছে।
যে-কোনো মৃত্যুকেই আমরা ‘করোনায় মৃত্যু’ বলে সন্দেহ করছি এবং যে-কোনো রোগকেই ‘করোনা’ বলে আমরা সন্দেহ করছি।
যেখানে প্রতিদিন বাংলাদেশে মারা যাচ্ছেন ২ হাজার ৪৩৯ জন এবং জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত মারা গেছেন ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯২০ জন।
সেখানে যে-কোনো মৃত্যু, যে-কোনো অসুস্থতা– এটাকে এক শ্রেণির বিকারগ্রস্ত মানুষ ‘করোনা করোনা’ বলে চিৎকার করে সেই পরিবারকে কার্যত একঘরে করে দিচ্ছে আর কি। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হয় না।
যখন আমরা শুনি নারায়ণগঞ্জের ঘটনা- একজন রোগী হাসপাতালে নেয়ার জন্যে তাকে এম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে। কাশি দিয়েছে। করোনা সন্দেহে নাকি তাকে এম্বুলেন্স থেকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার পরিবারও তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায় নাই। রাস্তায় পড়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা গেছেন। আর জানাজায় পরিবারের চারজন সদস্য অংশ নিয়েছিলেন।
যখন শুনি একজন মানুষ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনীতে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পরে জ্বরে ভুগে মারা যান। করোনা সন্দেহে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং তার পরিবার একঘরে হয়ে যান। তার জানাজায় পরিবারের চারজন সদস্য ছাড়া কেউই অংশ নেননি। অথচ পরে জানা গেল, যে তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না।
সুনামগঞ্জে ঘটনাও কম মর্মান্তিক নয়। দুই ভাই ও বাবা কাঁধে নিয়ে এক তরুণকে দাফন করতে নিয়ে যাচ্ছে। লাশ বহন করার জন্যে মসজিদ থেকে খাটিয়া দেয়া হয়নি। ২১ ঘণ্টা লাশ পড়েছিল।
শরীয়তপুরে এক মা... তার ছেলেকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যান পা ফোলা এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে। হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনি দুপুরবেলা মারা যান।
মৃত্যুর পর স্বজন বা গ্রামবাসী কেউ লাশ দেখতে আসেনি। লাশের পাশে মা আহাজারি করছেন। মৃতের বড় ভাই, চার বোন, বোনের পরিবারের সদস্যরাও ফিরে তাকাননি। ২১ ঘণ্টা সেইভাবেই লাশ পড়েছিল।
মা আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, “জীবনের শেষ বয়সে ছেলের লাশের ভার আমাকে এইভাবে বইতে হবে তা ভাবতে পারিনি। এভাবে মানুষের মানবতা হারিয়ে গেল! কী হবে এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে? কীসের জন্যে বেঁচে থাকা? কেউ আমার আর্তনাদ শুনল না। সন্তান-স্বজন গ্রামবাসী– কেউ না! আমার মতো এমন পরিণতি কাউকে যেন দেখতে না হয়।”
সেই যুবকেরও নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে- তারও করোনা ছিল না।
চিকিৎসা কর্মীদেরও দেখছি অচ্ছুতের দৃষ্টিতে। শুধু যে আক্রান্ত মানুষ, মৃত মানুষকে, তার পরিবারকে আমরা একঘরে করে ফেলছি তা নয়। যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজের জীবন বিপন্ন করে অসুস্থদের সেবা দিচ্ছেন- আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ, আতঙ্কিত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মানুষ তাদেরকেও রীতিমতো অচ্ছুতের দৃষ্টিতে দেখছি। বিপজ্জনক মানুষ হিসেবে অসহিষ্ণু আচরণ তাদের সাথে আমরা করছি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন এক বাঙালির জন্যে আরেক বাঙালির যে দরদ, যে মমতা, বিপন্ন প্রতিটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে ইতিহাস আমরা রচনা করেছিলাম – সেই বাঙালি, একজন অসুস্থ মানুষ তার সেবা করবে না, একজন মৃত মানুষের সম্মানের সাথে শেষ বিদায় দেবে না– এর চেয়ে বেদনার বিষয় আর কি হতে পারে!
সামাজিক দূরত্বের বদলে শারীরিক দূরত্ব;
আসলে, হয়তো বা আমরা একটি শব্দকে ভুলভাবে প্রয়োগ করছি।
আসলে সোশ্যাল ডিসটেন্স, সামাজিক দূরত্ব, এটা সেই সমাজ থেকে এসেছে যেখানে সোশ্যাল ইম্প্যাথি নাই, সেই সমাজে সোশ্যাল ডিসট্যান্স শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে।
আসলে একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের যে দূরত্ব, যেটাকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলা হচ্ছে – আমাদের মনে হয়, এই শব্দটি হওয়া উচিৎ ‘শারীরিক দূরত্ব’। শারীরিক দূরত্ব ব্যবহার করা উচিৎ, দৈহিক দূরত্ব ব্যবহার করা উচিৎ কিন্তু সামাজিক দূরত্ব নয়।
সামাজিক মমত্ব;
করোনা মোকাবেলার জন্যে যেটা প্রয়োজন- শারীরিক দূরত্ব এবং সামাজিক মমত্ব। সামাজিক মমত্ব যত আমাদের বাড়বে, করোনা মোকাবেলায় তত আমরা সফল হবো।
করোনা মোকাবেলায় পারস্পরিক মমতা প্রয়োজন;
কারণ একজন মানুষ যখন একা থাকে, যখন সে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে, যখন সে মনে করে যে তার প্রতি কারও কোনো মমত্ব নাই, সে আসলে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাও অনেক সময় তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না।
তো আমরা চলাফেরার ক্ষেত্রে, বাইরে শারীরিক দূরত্ব মেইন্টেইন করব, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখব। কিন্তু আমাদের অন্তরের যে টান– সামাজিক মমত্বের মধ্য দিয়ে এবং যে-ই দুর্গত হোক, যিনি-ই অসুস্থ হোক, তার প্রতি মমত্বের প্রকাশ আমরা যত ঘটাব, যত দেখাতে পারব, তত তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা, সুস্থ হওয়ার সুযোগ তার তত বাড়বে, তার ভেতরের ইমিউন সিস্টেম তখন বাড়বে।
আসলে মানুষের মমতা, ডাক্তারের মমতা, চিকিৎসকের মমতা, আত্মীয়ের মমতা, আপনজনের মমতা – যে-কোনো রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানে তারা খুব সুন্দরভাবে করোনা মোকাবেলা করেছে
আমরা এত দুঃখের পাশেও এত বেদনার পাশেও আমাদের আশার বাণী হচ্ছে- পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছেন। পৃথিবীতে এখনো সবাই শোষক নয়। সবাই জালেম নয়, সবাই ভোগী নয়, সবাই স্বার্থপর নয়।
ত্যাগী মানুষও রয়েছে। যেখানেই এই ত্যাগ আছে, যেখানেই মানুষের প্রতি মমতা আছে, সেখানে তারা খুব সুন্দরভাবে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে এবং মোকাবেলা করে যাচ্ছে।
ভিয়েতনামের কথা আপনারা জানেন– যে সেখানে করোনা সংক্রমণ তারা খুব চমৎকারভাবে সীমিত করেছেন।
কেরালার কথা আপনারা জানেন, যেখানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ভয় ছিল। কিন্তু তাদের সামাজিক মমত্ব এতটাই যে কেরালা সরকার বলেছিল যে বিদেশ থেকে যত মানুষ আসুক, সবাইকেই তারা গ্রহণ করবে। সামাজিক মমত্ব সেখানে করোনার প্রকোপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করেছে।
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কিউবা;
সামাজিক মমত্বের, মানুষের প্রতি মমত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ক্যাস্ট্রোর কিউবা।
যখন ব্রিটিশ ক্রুজ শিপ, যেটা বাহামার পতাকাবাহী ছিল এমএস ব্রেইমারে ৫০ জন প্যাসেঞ্জার করোনা-আক্রান্ত হয়ে গেল, পুরো ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কোনো দ্বীপ... তাদেরকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। যুক্তরাজ্যের বিদেশ মন্ত্রণালয় পাঁচদিন ধরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যত দেশ ছিল, প্রত্যেক দেশকে অনুরোধ জানায়। কিন্তু কেউ ভিড়তে দেয়নি।
কিউবা সেই জাহাজকে তাদের দ্বীপে ভিড়তে দেয় এবং এক হাজার প্যাসেঞ্জার এবং ক্রু– তাদেরকে নামিয়ে নিয়ে আসে এবং সেখান থেকে তারা চার্টার্ড বিমানে করে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসে।
অতএব করোনা-আক্রান্ত রোগীর সেবা করলেই কেউ করোনায় আক্রান্ত হবে, এটা মনে করার কোন কারণ নাই। প্রয়োজন শুধু সতর্কতা। প্রয়োজন শুধু মমত্ব।
মমত্বটাকে যত প্রবল করবেন, তত আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হবে এবং মমত্ব শুধু করোনা আক্রান্ত রোগীকে নয়, আপনাকেও সুস্থ রাখবে, ভালো রাখবে।
আমরা সবসময় মনে রাখবো- আমি মানুষ, আমি সৃষ্টির সেরা।
আপনার যদি মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়, আপনি এবং একটি বন্যপ্রাণীর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না।
মনুষ্যত্বই আমাদেরকে মানুষ করেছে। অতএব মানুষের প্রতি মমত্ব- এই মমত্বটাকে যত প্রবল করবেন, তত আপনার ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হবে।
মনটাকে ভয়মুক্ত করতে যা করবেন;
আর আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে, মনটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে, মনটাকে ভয়ের আবর্জনামুক্ত করতে হবে। আসলে ঘরে বসে থেকে যারাই আতঙ্কিত, তাদের আসলে ঘরে বসে কোনো কাজ নাই। তারা শুধু কন্টিনিউয়াস ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই সংখ্যা দেখছে আর কি।
কারণ মৃতের সংখ্যা সকালে যা থাকে, দুপুরেও তাই থাকে। দিনে মাত্র একবার চেঞ্জ হয়। কিন্তু এই একই সংখ্যা বারবার বারবার বারবার বারবার সে দেখে।
মনের শক্তি বাড়ানোর জন্যে বিশ্বাসের শক্তি বাড়ানোর জন্যে কোরআন তেলওয়াত করেন।
কারণ বিশ্বাসীর জন্যে, কোরআন শুধু রহমত না, কোরআন শেফাও। শেফা মানে নিরাময়। দৈহিক মানসিক সামাজিক পারিপার্শ্বিক –যতরকম সমস্যা আছে, যতরকম রোগ আছে (আর কি), সমস্ত রোগের নিরাময়ক হচ্ছে কোরআন।
এবং সনাতন হিন্দুরা, বৌদ্ধরা, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মবাণীতে মনোযোগ দেন।
প্রয়োজন শারীরিক পরিচ্ছন্নতাও
মনের পরিচ্ছন্নতার সাথে সাথে, নিয়মিত হাত ধোয়া, এবং হাত ধোয়ার জন্যে বাংলা সাবানের চেয়ে ভালো সাবান আর নাই। এবং অকারণে স্যানিটাইজার, এই এলকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করাটা এক হচ্ছে অর্থের অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয়।
এবং আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানাই যে তারা স্যোপি-ওয়াটার তৈরি করেছেন পানির সাথে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্টের মিশ্রণের মাধ্যমে আর কি। এক টাকাতে ৮০বার হাত ধোয়া যায় আর কি। অর্থাৎ অপচয় যত কমান তত ভালো। এবং এই সুযোগে যেহেতু ঘরে আছেন কাপড়-চোপড়, বিছানা-চাদর, ঘরবাড়ি সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তকতক ঝকঝক করে ফেলেন।
করোনা প্রতিরোধে যা সেবন করবেন
আর রসুন, কালিজিরা, মধু, প্রতিদিনের খাবার, একবেলা করে-সকালবেলা।
আর ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার, আইসক্রিম এবং ঠান্ডা পানীয় বর্জন করুন। এমনকি ঠান্ডা পানিও খাবেন না, গরম পানি খান আর কি।
আর যদি পরিবারে কেউ করোনা-আক্রান্ত হন, এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই, ভয় পাওয়ার কিছু নাই।
নিজের বা পরিবারের করোনার আক্রমণ সন্দেহ করলেই পরিবারের সবাই সকল ঠান্ডা খাবার ও পানীয় বর্জন করেন, গরম পানি পান করুন এবং নাক দিয়ে গরম ভাপ নিন। দিনে চারবার করে।
এবং দুবেলা কালিজিরা বেটে এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খান।
নাইজেরিয়ার গভর্নর যেভাবে করোনামুক্ত হলেন
নাইজেরিয়ার এক রাজ্যের গভর্নর, সেয়ি ম্যাকেন্দি, করোনায় আক্রান্ত হন। এবং আক্রান্ত হওয়ার পরে তিনি তার চিকিৎসকের পরামর্শে কালিজিরা এবং মধুর মিশ্রণ সেবন করেন। এবং ১৫ দিন পরে তিনি করোনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যান।
অতএব আপনিও কোনোরকম ঠান্ডা লাগলে গরম পানি, গরম ভাপ নাক দিয়ে নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়েন এবং দুবেলা কালিজিরা মধুর মিশ্রণ খান। প্রচুর ফল খান, শাক-সবজি খান। প্রয়োজনে করোনা চিকিৎসাকেন্দ্রের শরণাপন্ন হন।
এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সামাজিক মমত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে
করোনা নিয়ে আতঙ্ক নয়, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই, শুধু সতর্কতা প্রয়োজন।
নিজের যত্ন প্রয়োজন, নিজের প্রতি মনোযোগ প্রয়োজন।
সামাজিক মমতা প্রয়োজন, পারিবারিক মমতা প্রয়োজন।
এবং আমরা যেন ‘সোশ্যাল ডিসটেন্স’ শব্দটা ব্যবহার না করি, ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দটা যেন ব্যবহার না করি কখনও।
আমরা যেন শারীরিক দূরত্ব এবং সামাজিক মমত্ব- এই বাণী নিয়ে আমরা যে-কোনো দুর্যোগের ইনশাল্লাহ মোকাবেলা করতে পারব আর কি।
এবং এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সামাজিক মমত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পরম করুণাময় আমাদেরকে, আমাদের দেশকে এবং বিশ্বের বঞ্চিত মানুষদেরকে করোনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহ হাফেজ।
লেখক: এস এম নুরুজ্জামান, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।