দানেই সুখ
এস এম নুরুজ্জামান: সম্পদই সুখের উৎস। সম্পদ বাড়ালেই মানুষ সুখী হবে। সম্পদের পেছনে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে গিয়ে গজিয়ে উঠলো একের পর এক বস্তুবাদী সমাজ। কিন্তু সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্য থাকার পরও মানুষ সুখী হতে পারছে না।
২০১৫ সালের এক গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন যে মোট ১৩২ ট্রিলিয়ন সম্পদ আছে, তার ৪২ শতাংশই (৬৩.৫ ট্রিলিয়ন) আছে আমেরিকানদের হাতে। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘ বিশ্বে সুখী দেশগুলোর যে তালিকা করেছে, তার শীর্ষে এ পর্যন্ত একবারও যেতে পারেনি আমেরিকা।
বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ যখন শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে, নিজের জন্যেই সঞ্চয় করে, সে খুব দ্রুত ক্লান্ত আর নিরানন্দ হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের এক যৌথ গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। ৬৩০ জনেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক এ গবেষণাটিতে অংশ নেন। প্রথমে তাদেরকে তাদের বার্ষিক আয়ের বিবরণ দিতে বলা হয়। এরপর মাসে তারা যে ব্যয়গুলো করেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে বলা হয়। নিজেদের জন্যে ব্যয় ছাড়াও দান, উপহারসহ সব ধরনের ব্যয়েরই বিবরণ দিলেন তারা। এরপর তারা সুখী কি না, তা যাচাইয়ের জন্যে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হলো তাদের।
যারা দান করেছেন, অন্যদের উপহার দেবার জন্যে ব্যয় করেছেন, তারা অনেক বেশি সুখী মনে করছেন নিজেকে।
এদের মধ্যে ১৬ জন কর্মীকে বেছে নেয়া হলো, যারা একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন। এদের প্রত্যেকেই বছর শেষে কোম্পানি বোনাস হিসেবে পেলেন ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৮ হাজার ডলার। বোনাস পেয়ে তারা যত না খুশি হলেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হলেন যখন আয়ের একটা অংশ তারা দিয়ে দিলেন সোশাল চ্যারিটি ফান্ডে।
গবেষণায় দেখা যায়, দানের এই তৃপ্তি আর আনন্দের জন্যে মাত্র পাঁচ ডলার ব্যয়ও যথেষ্ট হতে পারে। দান যে শুধু তৃপ্তি আর প্রশান্তিই এনে দেয়, তা নয়, সম্পদে বরকত এনে দেয়, দূর করে দুর্দশা।
একবার বনী ইসরাইলের এক লোক স্বপ্নে দেখল, তার জীবনের দুই অংশ। এক অংশে তার খুব সম্পদ, প্রাচুর্য, বিলাসিতা থাকবে। আরেক অংশে থাকবে দারিদ্র, অভাব, দুঃখ, কষ্ট। স্বপ্নেই তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এ দুই অংশের মধ্যে কোন অংশ সে প্রথমে পেতে চায়, তা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা তার আছে।
এটুকু দেখেই ঘুম ভেঙে গেল তার। বিষয়টি তাকে খুব ভাবাচ্ছিল। স্ত্রীর সাথে আলাপ করল। স্ত্রী তাকে পরামর্শ দিল, ঠিক আছে, যেহেতু দুটো অংশই তোমার নিয়তি, কাজেই প্রথমে তুমি সম্পদ আর প্রাচুর্যই চাও। পরদিন সে আবারো স্বপ্নে দেখল। স্বপ্নেই বলল, সে প্রথম প্রাচুর্যময় জীবনই চায়।
জমি, ব্যবসা ইত্যাদি নানানভাবে বিপুল অর্থ সমাগম হতে লাগল তার বাড়িতে। এদিকে তার স্ত্রী একজন বুদ্ধিমতী মহিলা ছিল। স্বামীর এই বিপুল ধন সম্পত্তিকে শুধু নিজেদের জন্যে খরচ না করে সে স্বামীকে দিয়ে উদার হাতে সে বিলাতে লাগলো গরীব আত্মীয়, প্রতিবেশী, অভাবীদের মাঝে।
এদিকে বনী ইসরাইলীর জীবনের প্রথম অংশ শেষ হয়ে এল। এবার দ্বিতীয় অংশের পালা- দুঃখ, অভাব, বিপদ আর ঝামেলার জীবন! দেখল, সে-তো দিব্যিই আছে। কোনো বিপদাপদ, ঝামেলা নেই। প্রাচুর্যেরও কমতি নেই।
স্বপ্ন দেখল, গায়েবি কণ্ঠ তাকে বলছে, যেহেতু তুমি তোমার সম্পদ গরীব দুঃখীদের জন্যে ব্যয় করেছ, আল্লাহ তাই তোমার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তোমাকে তিনি আরো সম্পদ দান করবেন। যাতে তুমি আরো বেশি বেশি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে পার।
একবার নবীজী (স.) তার সাহাবাদের নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় তাদের পাশ দিয়ে এক ইহুদী হেঁটে গেল। কুঠার হাতে সে জঙ্গলে যাচ্ছিল কাঠ কাটতে। নবীজী (স.) বললেন, এ লোকটি আজ সাপের কামড়ে মারা যাবে।
সন্ধ্যাবেলা জঙ্গল থেকে তাকে হেঁটে বেরুতে দেখে সাহাবারা অবাক হলেন। নবীজী (স) যেমনটি বলেছিলেন, তার তো এসময় এভাবে আসার কথা নয়! নবীজী (স.) কে গিয়ে জানাতেই তিনি তাকে ডেকে আনতে বললেন।
সে এলে নবীজী (স.) তাকে তার কাঠের বোঝাটা মেলে ধরতে বললেন। আর বোঝার বাধন খুলে দিতেই ঝপ করে ভেতর থেকে বেরুলো এক বিষধর সাপ।
নবীজী (স.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বল তো আজ দিনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেছে কি না! লোকটি বলল, না, তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। তবে দুপুরবেলা আমি যখন খেতে বসেছি, তখন এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে আমার কাছে কিছু খাবার চাইল। তো খাওয়ার জন্যে আমার সাথে ছিল দুটো রুটি। তারই একটা আমি দিলাম ওকে।
নবীজী (স.) বললেন, এই তাহলে কারণ। সাপের কামড়ে আজ মারা যাওয়াই ছিল এ লোকটির নিয়তি। কিন্তু দুপুরবেলা ভিক্ষুককে একটি রুটি দিয়ে সে যে পুন্য অর্জন করেছে, তার বদৌলতেই আল্লাহ তার হায়াত দারাজ করলেন। এরপর ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করলেন।
নবীজী (স.) বলেন, আল্লাহ বলেছেন, জান কবচ করতে আজরাইলকে নির্দেশ দিয়েছি, এমন কোন ব্যক্তি যদি তারপরও দান করে, আমি তার জান কবচ থেকে বিরত থাকতে বলি আজরাইলকে।
লেখক: মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।