করোনা পরবর্তী বীমা শিল্প

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ: বীমা শিল্প সরকারের রাজস্ব আদায়ের বাতিঘর। সমুদ্রে যেমন নাবিকদের সঠিক পথ দেখাতে বাতিঘরের ব্যবহার করা হয় তেমনি বীমা শিল্প বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সংগৃহীত প্রিমিয়াম সাড়ে সাত লাখ কর্মীর মাধ্যমে সংগ্রহ করে সরকারের কোষাগারে সরকারের প্রাপ্যটুকু জমার ব্যবস্থা করে। অথচ বীমা কর্মীদের পরিবারের প্রায় ৩০ লাখ সদস্য অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। করোনা পরবর্তী সরকারের রাজস্ব আদায়, কোম্পানির আর্থিক অবস্থান এবং কর্মীদের পারিবারিক চিত্র তুলে ধরার মানসে এই লেখা।

ইদানিং প্রায়শঃ আমরা একটি কথা শুনতে পাই- তুমি তোমার পরিবারের জন্য অমূল্য সম্পদ, তোমার মৃত্যুতে তোমার পরিবার-পরিজন উপার্জনক্ষম একজনকে হারিয়ে পথে বসবে কারণ তুমি তাদের কাছে পুরো পৃথিবী। আর তোমার মৃত্যুতে সরকারী হিসাবে একটি সংখ্যা যোগ হবে। এত কিছুর পরেও সরকার দোদুল্যমান অবস্থায় একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে ৩১ মে ২০২০ থেকে স্কুল-কলেজ বাদে সকল প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলার নির্দেশনা দিয়েছেন। জীবনের জন্য লকডাউন যেমন দরকার জীবিকার জন্য লকডাউন সীমিত করা ছাড়া কোন বিকল্প উপায় নেই।

বাংলাদেশে লাইফ এবং নন-লাইফ মিলে মোট ৭৮টি বীমা কোম্পানি করোনা মুক্ত পরিবেশে কাজ করে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে সাধারণ বীমা করপোরেশন ছাড়া বেসরকারী ৪৫টি বীমা কোম্পানি নন-লাইফ সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। 

আমরা যদি একটি আনুমানিক তথ্যের ভিত্তিতে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো ছোট ছোট কোম্পানিগুলো প্রতিমাসে ২-৩ কোটি, মাঝরি কোম্পানিগুলো ৪-৫ কোটি এবং বড় কোম্পানিগুলো ১৫-৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়াম আয় করে থাকে। সে হিসেবে যদি এভারেজ হিসাবে প্রতিটি কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় প্রতিমাসে ৫ কোটি হিসাবে ধরি তাহলে মোট ৪৫টি বেসরকারি বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ২২৫ কোটি টাকা । করোনাকালে যদি কোম্পানিগুলো এপ্রিল মাসে ৫০ কোটি টাকার প্রিমিয়াম আয় করে থাকে তবে এই সেক্টর এপ্রিল মাসে ন্যূনতম ১৭৫ কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর যদি সীমিতভাবে করোনাকালে এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাস পর্যন্ত ধরি তাহলে আনুমানিক ক্ষতি হবে ৫২৫ কোটি টাকা। সাধারণ বীমা করপোরেশনের হিসাব এখানে নেই।

প্রতিটি কোম্পানি প্রিমিয়াম আয় থেকে বঞ্চিত হলেও এপ্রিল মাসের বেতন ও বোনাস বাবদ আনুমানিক ৯০ কোটি টাকা প্রদান করেছে যা পূর্বে সঞ্চিত আয় থেকে ব্যয় করতে হয়েছে। মে মাসেও বেতন হিসেবে আনুমানিক ৬০ কোটি এবং জুন মাসে প্রায় ৯০ কোটি (কোরবানীর ঈদসহ) টাকা বেতন ও বোনাস হিসেবে প্রদান করতে হবে। এই তিন মাসে সর্বমোট ২৪০ কোটি টাকা কোম্পানির আয় না থাকলেও বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের বীমা কর্মীদের প্রদান করতে হবে।

এবার সরকারী রাজস্বের কথায় আসা যাক তিন মাসের নেট প্রিমিয়াম ক্ষতি আনুমানিক ৫২৫ কোটি (পুরোপুরি তথ্য নির্ভর নয়, এই হিসাব কম-বেশি হতে পারে, আইডিআরএ ও বিআইএ কোম্পানিগুলোর কাছে তথ্য চেয়েছে সহসাই প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে ) সেই হিসেবে সরকার তিন মাসে রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ৯৫ কোটি টাকা (ভ্যাট ও ষ্ট্যাম্প বাবদ)।  তাছাড়া প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির আয়কর থেকে বঞ্চিত হবে।

নন-লাইফ পুরোপুরি এখনো এজেন্ট নির্ভর নয় বলে কর্মীরা তাদের মাসিক বেতন ও বোনাস পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লাইফ ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট নির্ভর বলে তাদের ব্যবসা না থাকাতে বা সামাজিক দূরত্বের কারণে বীমা গ্রহীতাদের সাথে যোগাযোগ মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকাতে এই সেক্টরের অবস্থা আরও খারাপ।

জীবন বীমা করপোরেশন ও মেটলাইফ ছাড়া বেসরকারী খাতে এদেশীয় ৩০টি বীমা কোম্পানি কাজ করে যাচ্ছে।  ছোট ছোট কোম্পানিগুলো প্রতিমাসে ১-২ কোটি,  মাঝারি কোম্পানিগুলো ৫-৭ কোটি  এবং বড় কোম্পানিগুলো আনুমানিক ৩০-১০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে থাকে। সেই হিসেবে যদি প্রতি কোম্পানির মাসিক গড় আয় ১০ কোটি টাকা হিসেবে গণনা করা হয় তবে প্রতি মাসে ৩০ টি কোম্পানির আনুমানিক প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা। করোনাকালে এপ্রিল মাসে সীমিত আকারে যদি কোম্পানিসমূহ ১০০ কোটি টাকার প্রিমিয়াম জমা করতে সমর্থ হয় তবু মাসিক ক্ষতি ২০০ কোটি টাকা। আর শিল্পে কর্মরত অফিস কর্মকর্তা ও স্টাফদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে বেতন ভাতা ও বোনাস বাবদ অনেক টাকা প্রদান করতে হবে এবং মানবিক বিবেচনায় এজেন্টদের ও কিছু আর্থিক অনুদান বা অগ্রিম দিতে হবে। তাই সার্বিক অবস্থায় তিন মাসে সরকার আনুপাতিক ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব ও আয়কর থেকে বঞ্চিত হবে। কোম্পানি ব্যবসা না করেও বেতন-ভাতা এবং এজেন্টরা ব্যবসা না করতে পারাতে মাসিক আয় থেকে বঞ্চিত হবে। তাই বাধ্য হয়ে অনেককে বীমা পেশা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে ।

সার্বিক বিবেচনায় করোনাকালীন বীমা শিল্প ও অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় যেমন গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, পর্যটন, সড়ক পরিবহন, নৌ পরিবহন, বিমান, পরিবহনের মতো গুরুতর আর্থিক সংকটে পড়বে।

এই সংকটপূর্ণ সময় থেকে উত্তরণের জন্য আল কুরআনের ৪টি মোটিভেশনাল শব্দের মাধ্যমে লেখাটি শেষ করতে চাই ।  

লা তাগদাব: জীবনে চলার পথে বিভিন্ন অনাকাংখিত বিষয়ের সম্মুখীন হতে হবে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

লা তাসখাত: আল্লাহর কোন ফয়সালার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা যাবে না।

লা তাহযান:  অতীত নিয়ে কখনো হতাশ হওয়া যাবে না ।

লা তাখাফ: ভবিষ্যত নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করে তাওয়াক্কালতু আলাআল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর উপর সোপর্দ করতে হবে। 

সেই সাথে নেলসন ম্যান্ডেলার সেই কথাটা না বললেই নয়- “দেরিতে হবে কিন্তু ঠিকই হবে, তুমি যা চাও তাই হবে। মনে রেখো তোমার সময়টা খারাপ তোমার জীবনটা নয়, শুধু অপেক্ষা করো সময় সব কিছু ফিরিয়ে দিবে” ।

আর কিছু না হোক করোনা আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করেছে। একে অপরকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতিগুলো পুন:জীবিত করেছে, সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে ।

তাছাড়া বউদের জীবন থেকে দুটি প্রশ্ন প্রায় হারিয়েই গেছে …

১. কোথায় আছো ?

২. বাসায় কখন আসবা ??

এটাও একটা পজিটিভ দিক ।

ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, পরিবারের প্রতি, প্রতিষ্ঠানের প্রতি দরদী হউন, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদে থাকুন । 

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।