নিউজিল্যান্ডে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক: বীমার মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: নিউজিল্যান্ড সরকার সম্প্রতি যে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন ফ্রেমওয়ার্ক’ প্রকাশ করেছে, সেটি দেশটির জলবায়ু অভিযোজন নীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বীমা খাতের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইন্স্যুরেন্স কাউন্সিল অব নিউজিল্যান্ড (আইসিএনজেড) এই উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, এই ফ্রেমওয়ার্ক দীর্ঘমেয়াদে দেশকে জলবায়ু সহনশীলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং নাগরিকদের জন্য বীমা সেবাকে সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও টেকসই রাখবে।
আইসিএনজেড’র প্রধান নির্বাহী ক্রিস ফাফোই বলেন, ফ্রেমওয়ার্কটি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনাকে স্পষ্ট ও কার্যকরভাবে উপস্থাপন করেছে। এটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি খাত এবং সম্প্রদায় একসঙ্গে কীভাবে কাজ করলে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি বিষয়ে উন্নত তথ্য, দায়িত্ব বণ্টনের স্বচ্ছতা এবং ঝুঁকি হ্রাসে বিনিয়োগ- এই তিনটি উপাদানই নিউজিল্যান্ডকে জলবায়ু সহনশীলতার পথে নিয়ে যাবে।”
ক্রিস ফাফোই সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর দ্বীপে সংঘটিত ভয়াবহ আবহাওয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, দুর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতি সামলানো কঠিন ও ব্যয়বহুল কাজ। তাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হলো আগেভাগে প্রস্তুতি নেওয়া এবং ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা। তার মতে, “আমরা যত তাড়াতাড়ি জলবায়ু ঝুঁকিগুলো শনাক্ত করে মোকাবিলা শুরু করতে পারব, তত বেশি আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি সুরক্ষিত থাকবে।”
এই নতুন ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডের প্রতিটি স্থানীয় কাউন্সিলকে আগামী তিন দশকের জন্য অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এতে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি, সম্ভাব্য ক্ষতি, প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, অর্থায়নের উৎস ও বাস্তবায়ন কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বিশেষভাবে উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে এসব পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ক্রিস ফাফোই বলেন, এই উদ্যোগ স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াবে। তবে এখনই প্রয়োজন সেই নীতিমালা, দিকনির্দেশনা ও কার্যকর টুলস, যাতে কাউন্সিলগুলো দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে পারে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, জলবায়ু অভিযোজনের কাজ যত বিলম্বিত হবে, ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়বে। কিছু ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায় ইতোমধ্যেই বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তারা বছরের পর বছর শুধু পরিকল্পনা দেখতে চায় না; অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রস্তুতিমূলক কাজ অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন।
ক্রিস ফাফোই জোর দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নির্বাচনী সময়সূচির অপেক্ষা করে না। তার মতে, দল-মত নির্বিশেষে স্থায়ী রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে, যাতে সরকারের পরিবর্তন হলেও অভিযোজন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। যদি জলবায়ু নীতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে, তবে বীমা ও অবকাঠামো খাতও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে।
ইন্স্যুরেন্স কাউন্সিলের মতে, সহনশীল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ শুধু মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেয় না, বরং অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি লাভজনক। তারা উল্লেখ করেছে, প্রতিরোধমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠনের খরচ বহুলাংশে কমিয়ে আনে। অর্থাৎ, আগাম প্রস্তুতির প্রতিটি ব্যয় ভবিষ্যতের ক্ষয়ক্ষতি সামলানোর তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর।
ফ্রেমওয়ার্কে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু অভিযোজন বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই হয়।
আইসিএনজেড মনে করছে, এই অভিযোজন কাঠামো বীমা বাজারে আস্থা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে। ঝুঁকি হ্রাস পেলে বীমা প্রিমিয়াম কমবে, ফলে নাগরিকদের জন্য বীমা আরও সাশ্রয়ী ও প্রবেশযোগ্য হবে। একইসঙ্গে, বীমা কোম্পানিগুলোও ঝুঁকি নিরূপণে আরও নির্ভুল তথ্য পাবে, যা তাদের টেকসই ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় সহায়তা করবে।
নিউজিল্যান্ড সরকারের এই ফ্রেমওয়ার্ক শুধু একটি নীতিমালা নয়, বরং একটি সমন্বিত অভিযোজন কৌশল, যার মাধ্যমে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে সরকারের নেতৃত্ব, স্থানীয় প্রশাসনের পরিকল্পনা, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং জনগণের সচেতনতা একসঙ্গে কাজ করবে।
নিউজিল্যান্ডের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন ফ্রেমওয়ার্ক’ জলবায়ু অভিযোজন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সুরক্ষার এক সমন্বিত রূপরেখা তৈরি করেছে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টা, স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য- সব মিলিয়ে এটি দেশটির জলবায়ু নীতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। আইসিএনজেড আশা করছে, এই উদ্যোগ শুধু জলবায়ু সহনশীল নিউজিল্যান্ডই গড়ে তুলবে না, বরং নাগরিকদের জন্য টেকসই ও ন্যায্য বীমা ব্যবস্থারও নিশ্চয়তা দেবে। (সংবাদ সূত্র: এশিয়া ইন্স্যুরেন্স রিভিউ)