ফিলিপাইনে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের সুরক্ষায় প্রথম প্যারামেট্রিক বীমা চালু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিপাইনের উপকূলীয় অঞ্চলে জীবিকা নির্বাহকারী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চালু হলো প্যারামেট্রিক বীমা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত বেড়ে ওঠা ঝড়ো হাওয়া, উত্তাল সমুদ্র ও ভারী বৃষ্টিপাতের মতো প্রতিকূল আবহাওয়া দীর্ঘদিন ধরে যাদের আয় ও নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আসছে, এই উদ্যোগ তাদের জন্য এক নতুন সুরক্ষার কাঠামো তৈরি করছে। সরকার এই পরিকল্পনাকে শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা নয়, বরং জীবিকা ও পরিবেশ উভয়কেই শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদি নীতি হিসেবে দেখছে।

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ফিলিপাইনের বুরো অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াটিক রিসোর্সেস (বিএফএআর) ও ফিলিপাইন ক্রপ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (পিসিআইসি)। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে বৈশ্বিক সংরক্ষণ সংস্থা রেয়ার এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু ঝুঁকি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান উইলিস। উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করেছে ওসান রিস্ক অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স অ্যাকশন অ্যালায়েন্স (ওআরআরএএ), যার তহবিল এসেছে কানাডা সরকার এবং যুক্তরাজ্যের ব্লু প্ল্যানেট ফান্ড থেকে। এ সহযোগিতা প্যারামেট্রিক বীমার মতো আর্থিক উদ্ভাবনকে জলবায়ু প্রভাবিত সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নতুন পথ খুলে দিয়েছে।

প্যারামেট্রিক বীমার মূল শক্তি হলো ক্ষতির প্রমাণ জমা দেয়া বা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন না থাকা। নির্দিষ্ট আবহাওয়া সূচক- যেমন বাতাসের গতি, সমুদ্রের উত্তালতা বা বৃষ্টিপাত- নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলেই সরাসরি পে-আউট প্রদান করা হবে। অর্থাৎ যখনই সমুদ্র মাছ ধরার জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠবে, তখনই মৎস্যজীবীরা তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা পাবেন। এতে তারা অনিশ্চিত আয়, ঋণের চাপ এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জোর করে সাগরে নামার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।

এই প্রকল্পে সরকার নিজেই পলিসির মালিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এবং নিবন্ধিত মৎস্যজীবীদের জন্য বীমা ব্যবস্থাটিকে একটি সামাজিক সুবিধা হিসেবে নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি টেকসই মৎস্যচর্চায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা এই সুবিধা পাওয়ার একটি প্রধান শর্ত হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও দায়িত্বশীল সম্পদ ব্যবহারের দিকটিকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকারের এই বিনিয়োগ তার রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে স্পষ্ট করে- মৎস্যসম্পদ রক্ষাকারী মানুষদের সুরক্ষিত না রাখলে সমুদ্রের স্বাস্থ্য ও জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা কোনোভাবেই বজায় রাখা সম্ভব নয়।

এই বীমা কাঠামোর ঝুঁকি বহনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত ন্যাচারাল ডিজাস্টার ফান্ডের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও জার্মান সরকারের যৌথ এই তহবিলে রি-ইন্স্যুরেন্স সহযোগী হিসেবে রয়েছে হ্যানোভার রে এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গ্লোবাল প্যারামেট্রিকস। এতে করে প্রকল্পটি শুধু জাতীয় বাজেটের ওপর নির্ভরশীল থাকছে না; বরং বৈশ্বিক ঝুঁকি-বণ্টন ব্যবস্থার সহায়তায় একটি দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো গড়ে উঠছে।

রেয়ার-এর প্রধান নির্বাহী ব্রেট জেনক্স এই উদ্যোগকে ‘মানুষ নয়, তাদের আয়কে সুরক্ষা দেয়া’- এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি বাস্তবসম্মত নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, প্রতিকূল আবহাওয়া যতই তীব্র হোক, পরিবার যাতে মুহূর্তের চাপ থেকে সুরক্ষা পায় এবং একই সঙ্গে সাগরের ওপর চাপ কমে- এই ভারসাম্যই টেকসই উন্নয়নের মূল শর্ত। অন্যদিকে উইলিস-এর এপেক ক্লাইমেট রিস্ক সেন্টারের প্রধান ড. ক্রিস্টোফার অউ এই প্রকল্পকে দেশের জন্য ‘প্রথম ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর বীমা’ হিসেবে বর্ণনা করেন, যা সঠিক সময়ে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে জীবিকার স্থিতিস্থাপকতাকে শক্তিশালী করবে।

এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো জলবায়ু প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিরক্ষামূলক অর্থনীতির ধারণা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ক্ষতি হওয়ার পর নয়, বরং ক্ষতি হওয়ার আগেই ঝুঁকি লাঘব করা হয়। এর মাধ্যমে উপকূলীয় সমাজে আর্থিক সহনশীলতা তৈরি হবে, অতিরিক্ত মৎস্যচাপ কমবে এবং সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে পুনরুদ্ধারের সময় পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে জলবায়ু নীতি, সামাজিক সুরক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে একটি শক্তিশালী সমন্বিত কাঠামোর উদাহরণ তৈরি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে এই প্রকল্প সফল হলে তা শুধু ফিলিপাইনের নয়, বৈশ্বিক দক্ষিণের অসংখ্য দেশ ও উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটি কার্যকর মডেল হয়ে উঠতে পারে। জলবায়ু অভিযোজন, আর্থিক উদ্ভাবন এবং টেকসই জীবিকার এই সমন্বিত প্রয়োগ ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জলবায়ু সুরক্ষা আলোচনাতেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে। (সংবাদ সূত্র: এশিয়া ইন্স্যুরেন্স রিভিউ)