বাংলাদেশে সাইবার ঝুঁকি বাড়ছে, নতুন বাজার খুলতে পারে সাইবার ইন্স্যুরেন্স

রাজ কিরণ দাস: বিশ্ব বীমা শিল্প যখন প্রযুক্তি, জলবায়ু এবং নিয়ন্ত্রক সংস্কারের যুগে নতুনভাবে গড়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বীমা বাজারও আর পুরোনো গতি ও কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এই অঞ্চল এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মধ্যবিত্তের বিস্তার বীমার চাহিদাকে দ্রুত বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু-ঝুঁকি, ডিজিটাল বিঘ্ন, সাইবার হুমকি, মুদ্রাস্ফীতি এবং আস্থা সংকট- সব মিলিয়ে বাজারকে আরও সংবেদনশীল ও প্রতিযোগিতামুখী করে তুলছে। এ অবস্থায় বীমা কেবল একটি আর্থিক পণ্য নয়; এটি হয়ে উঠছে ব্যক্তি, ব্যবসা এবং রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অবলম্বন- যার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে ‘প্রযুক্তি, নীতি, ঝুঁকি ও বিশ্বাস’- এই চারটি ভিত্তির ওপর।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত এক দশকে যে ধীরে ধীরে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও ভোক্তা বাজারের বিস্তার ঘটেছে, তা স্বাভাবিকভাবেই সম্পদ ও দায়বদ্ধতার পরিসর বাড়িয়েছে। শহরমুখী জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাসন, যানবাহন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরবরাহ চেইন- সবখানেই ঝুঁকি ঘনীভূত হচ্ছে। ফলে প্রপার্টি, মেরিন, মোটর এবং দায়বদ্ধতা বীমায় সম্ভাব্য বাজার তৈরি হলেও বাস্তবতা হলো- বীমা গ্রহণের হার এখনও প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। এখানেই বীমা শিল্পের জন্য বড় সুযোগ ও বড় চ্যালেঞ্জ একসাথে কাজ করছে। সুযোগটা হলো, অর্থনৈতিক কার্যক্রম যত বড় হচ্ছে, তত বেশি মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার প্রয়োজন বুঝছে। চ্যালেঞ্জটা হলো, চাহিদা তৈরি হলেও আস্থা ও সেবার মান বজায় রাখতে না পারলে সেই চাহিদা বাজারে রূপ নেয় না।

এই আস্থার প্রশ্নটি দক্ষিণ এশিয়ায় বীমা বাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বাংলাদেশের মতো বাজারে গ্রাহকের একটি বড় অংশ এখনও বীমাকে জটিল কাগজপত্র বা দীর্ঘসূত্রতা’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, পলিসির ভাষা ও শর্তের জটিলতা, এজেন্ট-নির্ভর বিক্রয় ব্যবস্থায় ভুল উপস্থাপন- এসব কারণে বীমা খাতে আস্থা তৈরির প্রক্রিয়া ধীর। অথচ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, বীমা শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব এবং প্রসার নির্ভর করে গ্রাহকের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার ওপর। তাই বাংলাদেশে বীমা খাতের টিকে থাকা ও বিস্তারের কেন্দ্রে থাকবে একটি প্রশ্ন- গ্রাহক কি তার প্রয়োজন অনুযায়ী স্বচ্ছ, সহজবোধ্য এবং দ্রুত সেবা পাচ্ছে?

এই বাস্তবতাকে দ্রুত বদলে দিতে পারে ডিজিটাল রূপান্তর। দক্ষিণ এশিয়ার বাজারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মোবাইল-ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এবং ডিজিটাল লেনদেনের দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা। বাংলাদেশে এমএফএস, অনলাইন পেমেন্ট, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল অনবোর্ডিং যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, তা বীমা শিল্পের জন্য বড় সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। পলিসি কেনা, নবায়ন, কাগজপত্র যাচাই, দাবি দাখিল- এগুলো যদি মোবাইল-কেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্মে সহজ করা যায়, তাহলে বীমাকে মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক জীবনের অংশ বানানো সম্ভব। একই সঙ্গে ডেটা ও অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে ঝুঁকি নির্ধারণ ও প্রিমিয়াম নির্ধারণ আরও ন্যায্য ও বাস্তবভিত্তিক করা যায়, যা বাজারের ন্যায়সংগত প্রতিযোগিতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ডিজিটালাইজেশন শুধু প্রযুক্তি স্থাপন নয়; এটি প্রক্রিয়ার সংস্কার, দক্ষ জনবল তৈরি এবং সাইবার নিরাপত্তার মান উন্নয়ন- সবকিছুর সমন্বিত উদ্যোগ।

কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত ডিজিটালাইজেশন একই সঙ্গে সাইবার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ফিনটেক ও ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম যত বিস্তৃত হচ্ছে, ততই ডেটা লিক, ফ্রড, র‍্যানসমওয়্যার ও সাপ্লাই-চেইন সাইবার আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের ব্যবসাগুলো অনেক সময় উন্নত সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো ছাড়াই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দ্রুত প্রসার ঘটায়, যা ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলে সাইবার ইন্স্যুরেন্সের মতো বিশেষায়িত কাভারেজের চাহিদা আগামী দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। কিন্তু এই ধরনের পণ্য সফল করতে হলে ঝুঁকি মডেলিং, প্রিমিয়াম কাঠামো এবং ক্লেইম যাচাইয়ের সক্ষমতা জোরদার করা জরুরি- যা এখনও এই অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন ক্ষেত্র।

তবে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বীমা বাজারকে যে চালকটি সবচেয়ে দ্রুত চাপে ফেলছে, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশ জলবায়ু-ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস এবং দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা শুধু মানবিক সংকট সৃষ্টি করে না; এটি কৃষি, অবকাঠামো, শিল্প উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্যও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনে। এমন পরিস্থিতিতে বীমা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র, কারণ দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে দ্রুত আর্থিক সহায়তা না থাকলে ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং দারিদ্র্য বাড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুর্যোগ-ঝুঁকি বেশি হলে প্রিমিয়াম বাড়ে, বীমা দেয়ার সক্ষমতা কমে এবং কিছু ক্ষেত্রে কাভারেজ সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে বাজারের টেকসই সমাধান হবে এমন পণ্য ও মডেল তৈরি করা, যা জলবায়ু ঝুঁকির বাস্তবতায়ও কার্যকর থাকে এবং একই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যও আর্থিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।

এই কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় প্যারামেট্রিক ইন্স্যুরেন্স এবং মাইক্রোইন্স্যুরেন্সের সম্ভাবনা বাড়ছে। যখন নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি, বাতাসের গতি বা নদীর পানি স্তর- এ ধরনের মাপযোগ্য সূচকের ভিত্তিতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়া যায়, তখন ক্লেইম যাচাইয়ের দীর্ঘসূত্রতা কমে। কৃষি, উপকূলীয় এলাকা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য এটি বড় সুবিধা দিতে পারে। তবে এখানেও একটি শর্ত আছে- ডেটার নির্ভুলতা, ট্রিগার নির্ধারণের স্বচ্ছতা এবং গ্রাহকের কাছে এই মডেলের বোঝাপড়া নিশ্চিত না হলে আস্থা তৈরি হবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্ভাবনী পণ্য সফল করতে হলে সরকারি সংস্থা, আবহাওয়া ও ডেটা প্রতিষ্ঠান, পুনর্বীমা বাজার এবং বীমা কোম্পানির মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য।

এর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে আরেকটি বড় চালক হলো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মূল্যস্ফীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়, নির্মাণ ব্যয় এবং খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বীমা ক্লেইমের খরচে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও মোটর বীমায়। অন্যদিকে সুদের হার ও বিনিয়োগ আয়ের ওঠানামা বীমা কোম্পানির লাভজনকতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে প্রিমিয়াম এমনভাবে নির্ধারণ করতে হচ্ছে যাতে ক্লেইম ব্যয় সামাল দেয়া যায়, অন্যদিকে বাজার প্রতিযোগিতায় প্রিমিয়াম অতিরিক্ত বাড়ালে গ্রাহক হারানোর ঝুঁকিও আছে। এই দ্বৈত চাপই দক্ষিণ এশিয়ার বাজারকে আরও নাজুক করে তুলছে, কারণ এখানে গ্রাহকের মূল্য সংবেদনশীলতা তুলনামূলকভাবে বেশি।

এই পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশে বীমা খাতে স্বচ্ছতা, সুশাসন, মূলধন পর্যাপ্ততা, দাবি নিষ্পত্তির সময়সীমা, ডিজিটাল পলিসি রেকর্ড এবং গ্রাহক সুরক্ষা- এসব জায়গায় কার্যকর নীতিগত উন্নয়ন হলে বাজারে আস্থা বাড়তে পারে। একই সঙ্গে বাজার আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করা জরুরি, যাতে ভুল বিক্রয়, অস্বচ্ছ শর্ত এবং ভোক্তা হয়রানি কমে। দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, বীমা বাজারের দ্রুত সম্প্রসারণ কেবল বাণিজ্যিক উদ্যোগে হয় না- এর জন্য একটি দৃঢ় নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং কার্যকর বাস্তবায়ন কাঠামো দরকার, যা আস্থা তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বীমা বাজার আগামী দিনে একটি বড় সুযোগের মুখোমুখি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নগরায়ণ, মধ্যবিত্তের বিস্তার এবং ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার- এসব উপাদান বীমার চাহিদাকে স্বাভাবিকভাবেই বাড়াবে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে শিল্পকে কয়েকটি মৌলিক বাস্তবতা মেনে এগোতে হবে- জলবায়ু ও সাইবার ঝুঁকি এখন অতিরিক্ত ঝুঁকি নয়, এগুলো মূল ঝুঁকি; গ্রাহক অভিজ্ঞতা এখন বিক্রয় কৌশলের অংশ নয়, এটি প্রতিযোগিতার কেন্দ্র; এবং প্রযুক্তি এখন অপশন নয়, এটি সক্ষমতার শর্ত। যে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবর্তনগুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে গ্রহণ করে, ডেটা ও অ্যানালিটিক্সকে নৈতিকভাবে ব্যবহার করে, দ্রুত ও স্বচ্ছ দাবি নিষ্পত্তি নিশ্চিত করে এবং দুর্যোগ-ঝুঁকির বাস্তবতায় নতুন পণ্য তৈরি করতে পারে- তারাই বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার বীমা বাজারে নেতৃত্ব দেবে।