বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায় দুর্বল হয়ে পড়ছে?

এ কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই: বাংলাদেশের বীমা খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা কাঠামোগত সংকট, অনিয়ম ও আস্থাহীনতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি'র (আইডিআরএ) ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ- বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ও অপ্রয়োজনীয় সখ্যতা বজায় রাখার ফলে আইডিআরএ তার মূল নিয়ন্ত্রক ও তদারকি দায়িত্ব পালনে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান শক্তি হলো তার স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আইডিআরএ ও বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই প্রয়োজনীয় দূরত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এর ফলশ্রুতিতে বীমা আইন, বিধি ও প্রবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান বা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতি কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয় না, বরং এটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃত্বের প্রতি বীমা কোম্পানিগুলোর শ্রদ্ধা ও ভয়- দু’টিকেই ক্ষয়িষ্ণু করে তুলছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, অনেক বীমা প্রতিষ্ঠান এখন আইডিআরএ-কে ‘ধরে নেওয়া’ অবস্থানে রেখেছে- অর্থাৎ, অনিয়ম করলেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে না, এমন একটি ধারণা তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

আইডিআরএ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল বীমা গ্রাহক কিংবা পলিসি ধারকদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং খাতটিতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় অভিযোগ উঠছে- সংস্থাটি ক্রমেই বীমা কোম্পানির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যেখানে গ্রাহকদের ন্যায্য দাবি ও অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।

পলিসি দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, অনিয়মের অভিযোগে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া এবং শাস্তিমূলক নজিরের অভাব- এসব বিষয় বীমা গ্রাহকদের আস্থাহীনতা আরও গভীর করছে। অথচ একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়া বীমা খাতের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনা কার্যত অসম্ভব।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি নিয়ন্ত্রিত পক্ষের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপস, শাস্তি প্রদানে অনীহা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ থেকে সরে আসার প্রবণতা- এসবই এমন সম্পর্কের অনিবার্য ফল।

আইডিআরএ'র ক্ষেত্রেও সেই আশঙ্কাই এখন স্পষ্টভাবে সামনে আসছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা যদি কেবল প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে এবং বাস্তব প্রয়োগে দৃঢ়তা না থাকে, তবে তা পুরো বীমা খাতের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বীমা খাতের টেকসই উন্নয়ন ও জনআস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য আইডিআরএ-কে অবশ্যই তার স্বাধীন সত্তা ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন- বীমা আইন ও বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ও নিরপেক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিত পক্ষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পলিসি ধারকদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইডিআর-কে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং আইন, ন্যায় এবং গ্রাহকের স্বার্থের পক্ষেই অটল।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা যদি কেবল বীমা কোম্পানির সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তার নেতিবাচক প্রভাব শেষ পর্যন্ত পুরো বীমা খাতকেই বহন করতে হবে। এতে গ্রাহকের আস্থা ক্ষুণ্ন হবে, বাজার কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে এখনই আইডিআরএ’র উচিত তার মৌলিক দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা এবং সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যে দেশের বীমা খাতে আইন ও ন্যায়ই সর্বোচ্চ নির্দেশক।