ভর্তুকি ছাড়া স্বাস্থ্য বিল পাস, ২ কোটি ৪০ লাখ আমেরিকানের ব্যয় বাড়ার শঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এসিএ ভর্তুকি নবায়ন ছাড়াই রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বিল পাস হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতিতে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মহামারিকালে সম্প্রসারিত অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট বা ওবামাকেয়ারের ফেডারেল স্বাস্থ্য বীমা ভর্তুকির মেয়াদ চলতি বছরের শেষে শেষ হতে যাচ্ছে। অথচ এই ভর্তুকি বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা যুক্ত না করেই বুধবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের উত্থাপিত একটি স্বাস্থ্য বিল ২১৬-২১১ ভোটে গৃহীত হয়েছে। ফলে কংগ্রেস দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নিলে নতুন বছরের শুরুতেই কোটি কোটি আমেরিকানের স্বাস্থ্য বীমার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই ভোটকে চলতি বছরে কংগ্রেসে স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে শেষ বড় সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ভোটের ঠিক আগে রিপাবলিকান নেতৃত্বের মধ্যেই বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কয়েকজন রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে মিলে ওবামাকেয়ার ভর্তুকি তিন বছরের জন্য বাড়ানোর উদ্যোগে সমর্থন জানান। কিন্তু রিপাবলিকান নেতৃত্ব শেষ মুহূর্তে প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই উদ্যোগ আটকে দেয়। হাউস প্রথমে ২০৪-২০৩ ভোটে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার ফলে ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাবটি ভোটে তোলার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে হাউসে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ করেন, ভোট চলাকালেই জোরপূর্বক অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
ভর্তুকির মেয়াদ শেষ হলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসতে পারে ওবামাকেয়ারের আওতায় স্বাস্থ্য বীমা নেয়া প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের ওপর। কংগ্রেস কোনো ব্যবস্থা না নিলে আগামী ১ জানুয়ারি থেকেই তাদের একটি বড় অংশকে বেশি প্রিমিয়াম গুনতে হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে মাসিক ব্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, যা বহন করা কঠিন হবে। এতে কেউ কেউ কম সুবিধার বীমা পরিকল্পনায় যেতে বাধ্য হতে পারেন, আবার অনেকেই পুরোপুরি স্বাস্থ্য বীমার আওতার বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার সতর্ক করে বলেছেন, এর ফলে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে এবং বহু পরিবার উচ্চ ডিডাকটিবল ও কো-পে’র চাপে পড়বে।
রিপাবলিকানদের পাস করা বিলটি ভবিষ্যতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা তাৎক্ষণিক সংকটের সমাধান দিতে পারছে না। বিলটি ২০২৭ সাল থেকে কার্যকর হলে কিছু মানুষের জন্য প্রিমিয়াম কমার সম্ভাবনা থাকলেও সামগ্রিকভাবে এতে ফেডারেল ভর্তুকির পরিমাণ কমে যেতে পারে, যা অনেকের জন্য উল্টো প্রিমিয়াম বাড়ার কারণ হবে। একই সঙ্গে এতে ‘অ্যাসোসিয়েশন হেলথ প্ল্যান’-এর সুযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে, যাতে ছোট ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সার ও স্বনিযুক্ত ব্যক্তিরা একত্রে গ্রুপ স্বাস্থ্য বীমা কিনতে পারেন। রিপাবলিকানদের যুক্তি হলো, বাজারে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করলে বীমা কোম্পানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে সমালোচকদের মতে, এতে সাশ্রয়ী ও মানসম্মত কভারেজ নিশ্চিত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
অরাজনৈতিক কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের বিশ্লেষণ এই উদ্বেগ আরও জোরালো করেছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, প্রস্তাবিত আইন কার্যকর হলে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ স্বাস্থ্য বীমা হারাতে পারেন। যদিও এর ফলে ফেডারেল সরকারের বাজেট ঘাটতি আনুমানিক ৩৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার কমবে, তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- এই সাশ্রয় কি মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণযোগ্য?
এই প্রেক্ষাপটে হাউস স্পিকার মাইক জনসনের অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। হাউসের নিয়ম অনুযায়ী ডেমোক্র্যাটরা ভর্তুকি সম্প্রসারণের বিষয়ে ভোটের দাবি জানাতে পারেন, কিন্তু মাইক জনসন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের আগে তিনি এ বিষয়ে কোনো ভোট নির্ধারণ করবেন না। তার ভাষায়, এই ভর্তুকি ভালো নীতি নয় এবং তিনি এর বিপক্ষে অবস্থান নেবেন। ফলে নতুন বছরের শুরুতেই সাধারণ মানুষের ওপর যে আর্থিক চাপ নেমে আসতে পারে, তা এড়ানোর পথ আপাতত বন্ধই থাকছে।
স্বাস্থ্য ভর্তুকি ইস্যু ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বড় ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। এর আগে সিনেটেও উভয় দলের প্রস্তাবিত ভর্তুকি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং বছরের শুরুতে দীর্ঘ সরকারি শাটডাউনের পেছনেও এই বিষয়টি অন্যতম কারণ ছিল। এখন সামনে ২০২৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচন। বিশেষ করে যেসব রিপাবলিকান সদস্য ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে ভর্তুকি বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা সবাই এমন এলাকা থেকে নির্বাচিত যেখানে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন হতে পারে। ফলে ভোটারদের চাপ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মিলিয়ে স্বাস্থ্য ভর্তুকি প্রশ্নটি আরও স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে।
যদিও হাউসে বিলটি পাস হয়েছে, তবু বছরের শেষের আগে সিনেটে এটি আলোচনায় আসার সম্ভাবনা কম। এর অর্থ হলো, জানুয়ারির শুরুতেই বহু আমেরিকানকে বাড়তি স্বাস্থ্য বীমা ব্যয়ের মুখোমুখি হতে হতে পারে। তবে হাউসে দেখা দেয়া বিভাজন এবং মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের উদ্বেগ নতুন বছরের শুরুতে সিনেটে আবারও আলোচনার দরজা খুলতে পারে। মধ্যপন্থী রিপাবলিকান সিনেটর লিসা মারকাউস্কি ইতিমধ্যেই আশা প্রকাশ করেছেন, হাউসে যা ঘটেছে তার প্রতিক্রিয়া জানুয়ারিতে সিনেটে প্রতিফলিত হবে।
এসিএ ভর্তুকি ঘিরে এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতির মূল দ্বন্দ্বটিকেই সামনে এনে দিয়েছে। একদিকে রয়েছে বাজেট ঘাটতি কমানোর চাপ, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়। কংগ্রেস যদি দ্রুত সমঝোতায় না পৌঁছায়, তাহলে এই নীতিগত দ্বন্দ্ব খুব শিগগিরই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সংকটে রূপ নিতে পারে- যার রাজনৈতিক প্রভাবও আগামী নির্বাচনগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। (সংবাদ সূত্র: রয়টার্স)




