২০২৬ সালে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে ৩.১ শতাংশে: আইএমএফ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমানে গভীর অনিশ্চয়তা ও কাঠামোগত রূপান্তরের এক সংবেদনশীল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে নীতিগত পরিবর্তন, বাণিজ্যসংক্রান্ত বাধা এবং আর্থিক ঝুঁকি একসঙ্গে প্রবৃদ্ধির গতিকে চাপে ফেলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) 'অক্টোবর ২০২৫ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক' অনুযায়ী, বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালের ৩.৩ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালে ৩.২ শতাংশে নেমেছে এবং ২০২৬ সালে তা আরও কমে ৩.১ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এই ধারা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের প্রাথমিক গতি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখন দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
প্রবৃদ্ধির এই মন্থরতা অঞ্চলভেদে ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরছে। উন্নত অর্থনীতিগুলোতে উচ্চ সুদের হার, শ্রমবাজারের সীমাবদ্ধতা এবং কঠোর আর্থিক নীতির প্রভাবে প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে গড়ে মাত্র ১.৫ শতাংশে আটকে থাকতে পারে। অন্যদিকে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলেও তাদের গড় প্রবৃদ্ধি হারও ৪ শতাংশের সামান্য ওপরে সীমিত থাকার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, বৈশ্বিক অর্থনীতির ভার ধীরে ধীরে এসব দেশের দিকে সরে এলেও, কাঙ্ক্ষিত মাত্রার গতি এখনো অর্জিত হয়নি।
মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত মিলছে। বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ২০২৫ সালে ৪.২ শতাংশে এবং ২০২৬ সালে ৩.৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে এই নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেও আর্থিক বাজারে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বাড়তে থাকা ঋণের ব্যয়, সরকারি ও বেসরকারি খাতের উচ্চ ঋণভার, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং প্রযুক্তি খাতসহ নির্দিষ্ট কিছু সেক্টরে হঠাৎ সম্পদের মূল্য পুনর্মূল্যায়নের ঝুঁকি বাজারকে অস্থির করে রাখতে পারে। এসব ঝুঁকি আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তব অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতি হওয়ার পেছনে একাধিক আন্তঃসম্পর্কিত কারণ কাজ করছে। সুরক্ষাবাদী নীতির বিস্তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করছে, একই সঙ্গে শ্রমবাজারে দক্ষতার ঘাটতি ও উৎপাদনশীলতার ধীরগতি অর্থনৈতিক সম্প্রসারণকে সীমিত করে তুলছে। উপরন্তু, অতীতে অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে চাঙা করা দ্রুত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রভাব ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় প্রবৃদ্ধির গতি টেকসই রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে স্থিতিশীল ম্যাক্রো-ফাইন্যান্সিয়াল পরিবেশের গুরুত্ব বিশেষভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে বীমা খাতের জন্য। দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, দায় ও সম্পদের মধ্যে ভারসাম্য এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা বীমা শিল্পের মূল ভিত্তি। কিছু অঞ্চলে বন্ডের ফলন বক্ররেখা স্বাভাবিক হওয়ায় বীমা কোম্পানিগুলো উন্নত বিনিয়োগ আয়, আরও বাস্তবসম্মত পণ্যমূল্য নির্ধারণ এবং শক্তিশালী মূলধন অবস্থানের সুফল পাচ্ছে, যা খাতটির আর্থিক সহনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।
তবে আর্থিক বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা বা দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা তৈরি হলে বীমা খাতও চাপের মুখে পড়তে পারে। এতে সম্পদের মূল্য হ্রাস, বিনিয়োগ আয় কমে যাওয়া এবং দায় ব্যবস্থাপনায় জটিলতা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি বীমা পণ্যের ক্ষেত্রে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হারের ওঠানামা অত্যন্ত সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করে। তবুও অধিকাংশ বীমা প্রতিষ্ঠানের সু-বৈচিত্র্যময় ও উচ্চমানের বিনিয়োগ পোর্টফোলিও ঘনত্বজনিত ঝুঁকি কমাতে, তারল্য নিশ্চিত করতে এবং সামগ্রিক সলভেন্সি রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সব মিলিয়ে, বৈশ্বিক অর্থনীতি বর্তমানে ধীরগতির প্রবৃদ্ধি ও বহুমাত্রিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে এগোলেও, এই বাস্তবতার মধ্যেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। কার্যকর বাণিজ্য আলোচনা, গভীর কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ যদি সময়োপযোগী ও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নতুন গতি দিতে পারে। বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত স্থিরতাই টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।




