বীমা খাতে ডিজিটাল প্রতারণার বিরুদ্ধে 'এনএলপি' কেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি

রাজ কিরণ দাস: বীমা শিল্পে জালিয়াতি দীর্ঘদিন ধরেই একটি নীরব মহামারি হিসেবে বিরাজমান। প্রতারণার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোম্পানি, প্রক্রিয়াগত জটিলতায় বিপাকে পড়েন প্রকৃত গ্রাহক, আর শেষ পর্যন্ত পুরো শিল্পের ওপরই পড়ে অবিশ্বাসের ভারী ছায়া। ডিজিটাল যুগে প্রতারণার কৌশল যেমন উন্নত হচ্ছে, তেমনই প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে নতুন এক দিগন্ত। সেই দিগন্তের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম- ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, বা এনএলপি।
জীবন বীমা খাত বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ প্রতারণার পদ্ধতিগুলো এখানে আরও বেশি সূক্ষ্ম ও মানবিক আবেগের সাথে মিশে থাকে। মনগড়া দুর্ঘটনার বিবরণ, মিথ্যা চিকিৎসা নথি, ভুয়া পরিচয় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মৃত্যুর নাটক- সবই এমনভাবে সাজানো হয় যে প্রথাগত তদন্তের চোখ এড়িয়ে যায়। বর্ণনার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অসত্য এতটাই নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয় যে একজন মানব বিশ্লেষক সব তথ্য যাচাই করার আগেই অজান্তে অনুমোদন করে বসতে পারেন। ফলে প্রতারণা দমনে মানবচেষ্টার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ক্ষমতাপ্রাপ্তি এখন আর বিকল্প নয়, বরং একটি মৌলিক প্রয়োজন।
এনএলপি যে পরিবর্তন এনেছে, তা মূলত বিশ্লেষণের গতি এবং গভীরতায়। বীমা দাবি, গ্রাহক যোগাযোগ, নীতিমালা, নথিভুক্ত বিবরণ- এই সবকিছুকেই এখন কেবল লেখা হিসেবে নয়, বরং একটি ডেটাসেট হিসেবে দেখা হচ্ছে। এনএলপি পাঠ্যভিত্তিক তথ্যের মধ্য থেকে তারিখ, স্থান, ব্যক্তি, আর্থিক ইঙ্গিত, পরিস্থিতির বিবরণ- সবকিছু আলাদা করে এনে সেগুলোর সম্পর্ক খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে। কোথাও ভাষার সুর অস্বাভাবিকভাবে নাটকীয়, কোথাও ঘটনার বিবরণ বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না, আবার কোথাও বর্ণনার গভীরে লুকিয়ে থাকা সামান্য অসামঞ্জস্য ঘটনাটিকে সন্দেহজনক করে তুলছে। একসময় যা কেবল অভিজ্ঞ তদন্তকারীর চোখেই ধরা পড়ত, এখন তা মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই প্রযুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত হচ্ছে।
একটি দাবির বিবরণে কোনো গ্রাহক যদি আবহাওয়া, স্থান, সময় কিংবা ঘটনার ফরম্যাট এমনভাবে সাজান, যা সাধারণ ঘটনার বিবরণগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এনএলপি তা দ্রুত বুঝে ফেলে। একই সময়ে ওই এলাকায় আবহাওয়া কেমন ছিল, এলাকায় সেই সময় অন্য কোনো ঘটনা নথিভুক্ত আছে কি না, বর্ণনার ভাষাগত ভঙ্গি সাধারণ দাবি থেকে কতটা বিচ্যুত- এসব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এনএলপিকে সন্দেহ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। প্রতারণার বর্ণনা যতই নিখুঁতভাবে গঠিত হোক, ভাষা ও প্রেক্ষাপটের ভেতরে থাকা সত্য প্রযুক্তির কাছে গোপন থাকে না।
বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে এই প্রযুক্তির আরেকটি বড় শক্তি হলো স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা। গ্রাহকের দাবি যত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে যাচাই হচ্ছে, কোম্পানি ততটাই নিশ্চিন্ত হতে পারছে যে প্রকৃত দাবি যথাযথভাবে পরিশোধ হচ্ছে, আর প্রতারণামূলক দাবি শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পাচ্ছে না। সৎ গ্রাহকও এখন বুঝতে পারছেন যে প্রযুক্তি কেবল সন্দেহ শনাক্ত করছে না, বরং তাদের ন্যায্য দাবিগুলোকেও দ্রুততার সঙ্গে স্বীকৃতি দিচ্ছে। শিল্পের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা তাই নতুনভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে।
এনএলপি কার্যকর হতে হলে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সঠিকভাবে অ্যানোটেট করা প্রশিক্ষণ ডেটা। ভাষার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম প্যাটার্ন বুঝতে হলে মডেলকে নিখুঁত উদাহরণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করতে হয়। ল্যাবেলার-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যানোটেটেড ডেটা এনএলপি মডেলকে এমনভাবে সমৃদ্ধ করে যে ভবিষ্যতে প্রতারণার কৌশল যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন, মডেলের বিশ্লেষণক্ষমতা পিছিয়ে পড়ে না। বরং প্রতিটি বিশ্লেষণ নতুন ডেটা যোগ করে মডেলকে আরও শক্তিশালী করে উঠতে সাহায্য করে।
বীমা শিল্প ক্রমেই ডিজিটাল হচ্ছে। গ্রাহকের প্রত্যাশা বদলাচ্ছে, প্রতারণার কৌশল বৈচিত্র্যময় হচ্ছে, আর কোম্পানিগুলোও চাইছে দ্রুত, নির্ভুল এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। এই বাস্তবতায় এনএলপি আর বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য প্রযুক্তিগত কাঠামো হয়ে উঠছে। এটি শুধুমাত্র প্রতারণা শনাক্ত করে না, বরং পুরো শিল্পকে আরও নিরাপদ, দায়িত্বশীল এবং গ্রাহককেন্দ্রিক করে তোলে।




