পুনর্বীমার নামে বিদেশে অর্থ পাচার: মোহাম্মদী খানমসহ জড়িতদের শাস্তি দেয়ার সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন ভেঙ্গে ৮১৭ কোটি টাকার ১৭টি বীমা পলিসির পুনর্বীমার শতভাগ বিদেশে করেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। অবৈধভাবে পুনর্বীমার নামে অতিরিক্ত টাকা বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ মিলেছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের পদত্যাগী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে। বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ এর ১৭ ধারার লংঘন করায় অভিযুক্ত মোহাম্মদী খানমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি। ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে।

উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র পৃথক দুই তদন্তে প্রাইম ইন্সুরেন্সের তৎকালীন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং এর প্রমাণ পেয়েছিল। দু’টি তদন্ত প্রতিবেদনেই টাকা পাচারসহ আর্থিক অনিয়মের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশও করেছিল।

টাকা পাচারসহ আর্থিক গুরুতর সব অনিয়মের পর মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। বরং অভিযোগের প্রমাণ হওয়ায় পদত্যাগকারী মোহাম্মদী খানমকে দ্রুত ছাড়পত্র প্রদানে দফায় দফায় কোম্পানিকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন। মানি লন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি কমিশনের এমন পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ বীমাখাতে অনিময় উস্কে দেবে বলে আশংকা বিশ্লেষকদের।

 “পুন:বীমার প্রিমিয়ামের ১২ কোট টাকা বিদেশে পাচার করেছে, বর্তমানেও অবৈধভাবে বিদেশ পুন:বীমা করছে এবং পুন:বীমার কমিশনের টাকা কোম্পানীর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়েছেন মর্মে অভিযোগ উত্থাপিত” বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তে নামে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা-আইডিআরএ। সংস্থাটির পরিচালক ও যুগ্ম সচিব মো: ছিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি এই প্রতিবেদন দেয়।

বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রাইম ইন্সুরেন্স সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি) সাথে ১২টি পলিসি পুন:বীমার জন্য পেশ করেনি। ১২টি পলিসির বীমার অংক ৬০৯ কোটি ৯৬ লাখ ১ হাজার ৮৯৮ টাকা, যাহার গ্রস প্রিমিয়াম ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা এবং নেট প্রিমিয়াম ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এছাড়াও ৫টি পলিসি ফরেন কারেন্সি বিদেশে পুন:বীমা করা হয়েছে যেগুলো এসবিসিতে পেশ করা হয়নি বলে প্রাইম ইন্সুরেন্স কোম্পানীর বিবরণীতে দেখা যায়। এগুলোর বীমা অংকের পরিমাণ ২১০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এগুলোর গ্রস প্রিমিয়াম ও নেট প্রিমিয়াম বিবরণীয়তে উল্লেখ করা হয়নি। সর্বমোট ১৭টি (সতের) পলিসি এসবিসিতে পেশ করা হয়নি বলে দালিলিকভাবে প্রতীয়মান হয়।”

আইন অনুযায়ী, যে কোন নন-লাইফ বীমার পুনর্বীমার অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ সরকারি সংস্থা সাধারণ বীমার সাথে যে সাথে করতে হবে। তারপরও ১৭টি পলিসি এসবিসির সাথে পুনর্বীমা না করে শতভাগ বিদেশে পুনর্বীমা করার অভিযোগটি দালিলিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় প্রাইম ইন্সুরেন্সের পুনর্বীমা বিভাগের প্রধান সুজিত কুমার ভৌমিক, তৎকালীন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানম ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকিউল্লাহ শহীদকে অভিযুক্ত করে তদন্ত কমিটি। একইসাথে বীমা কর্পোরেশন আইন ২০১৯ এর ১৮ ধারা এবং বীমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ও ১৩৪ ধারা মোতাবেক শাস্তির সুপারিশ করে।

আবারও মোহাম্মদী খানমের মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ মিলল: এক বছরেরও বিচার হয়নি

এছাড়াও তদন্ত কমিটি, প্রাইম ইন্সুরেন্সের ২ কোটি ৩৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা অবৈধভাবে সাবেক ডিএমডি এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী মনিরুল হকের ব্যক্তিগত একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। এ অবৈধ লেনদেন করায় সরকার ভ্যাট, ট্যাক্স ও বিভিন্ন আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারগণও তাদের নায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্ছিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। এঘটনায় তৎকালীন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদী খানম এবং ডিএমডি মনিরুল হককে দায়ী করে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদন বলা হয়, “বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির দ্বারা ইতোপূর্বে তদন্ত করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি মানি লন্ডারিংয়ের উপাদন রয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে কর্তৃপক্ষ হতে ৩/৭/২০১৯ খ্রি: তারিখে। যার স্মারক নং বী:উ:নি:ক/নন-লাইফ/২৫২৭/২০১৫(অংশ-২)১৩৫ মোতাবেক পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল। তাই এ বিষয়ে আর কোন করণীয় নেই বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।”

তৃতীয় দফায় তদন্ত প্রতিবেদনে টাকা পাচারসহ গুরুতর আর্থিক অনিয়মের পরও শাস্তির সুপারিশের পরও এখনও প্রাইম ইন্সুরেন্সের পদত্যাগী সিইও মোহাম্মদী খানমের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের অপরাধের পরও কী কারণে আইডিআরএ কালক্ষেপণ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এসব বিষয়ে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বর্তমান মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) সৈয়দ মনিরুল হকের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানান। তিনি বলেন, অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে কাগজপত্রসহ অফিসে আসেন তখন আমি কথা বলবো।