সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়াই মূখ্য নির্বাহী অনুমোদন দিচ্ছে আইডিআরএ

আবদুর রহমান আবির: ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়াই দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ অনুমোদন দিচ্ছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা।

মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগলাভের জন্য যোগ্য হবেন না, যদি তিনি কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণ খেলাপী হিসেবে ঘোষিত হন। আর সিআইবি প্রতিবেদনের মাধ্যমেই জানা সম্ভব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণ খেলাপী কি-না।

এদিকে প্রস্তাবিত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ঋণ খেলাপীর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার আগেই নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ বলছে, বীমা আইন, ২০১০ এবং মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর বিধানাবলী পরিপালিত হওয়ায় নিম্নোক্ত শর্তাবলী পরিপালন সাপেক্ষে অনুমোদন প্রদান করা হলো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়াই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ অনুমোদন করলে ঋণ খেলাপী ব্যক্তিও বীমা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ এ পদে আসিন হতে পারেন। এতে করে বীমা কোম্পানি ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। বাধাগ্রস্ত হতে পারে বীমাখাতের উন্নয়ন। বাড়তে পারে খাতটির নেতিবাচক ইমেজ।

তথ্য অনুসারে, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে ২৯ জুলাই, ২০২০ তারিখে। অনুমোদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ‘তিনি যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হন তবে তার এই নিয়োগ অনুমোদন বাতিল বলে গণ্য হবে’।

এর আগে ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অজিত চন্দ্র আইচকে অনুমোদন দেয় বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ওই অনুমোদনপত্রেও উল্লেখ করা হয়, ‘তিনি যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হন তবে তার এই নিয়োগ বাতিল করা হবে’।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর অজিত চন্দ্র আইচের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন দেয় আইডিআরএ। ওই সময়েও তার অনুমোদন পত্রের চ) নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘তিনি যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হন তবে তার এই নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন বাতিল বলে গণ্য হবে’।

এই তিন দফা অনুমোদনেই অজিত চন্দ্র আইচের ঋণ খেলাপীর বিষয়ে নিশ্চিত হয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। অর্থাৎ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়াই অজিত চন্দ্র আইচকে তিন দফা মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও নবায়ন অনুমোদন দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়া’র নিয়োগ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি প্রতিবেদন থেকে তার ঋণ খেলাপীর তথ্য নিশ্চিত হয়নি বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল তার এই নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হয়।

নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়ার নিয়োগ নবায়ন অনুমোদনের শর্তেও উল্লেখ করা হয়, ‘তিনি যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হন তবে তার এই নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন বাতিল বলে গণ্য হবে’। অর্থাৎ সিআইবি প্রতিবেদন পাওয়া আগেই তার নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে আইডিআরএ।

২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে মো. আবদুল মতিনের নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। আবদুল মতিনের নিয়োগ নবায়নের পত্রেও উল্লেখ করা হয়, ‘ভবিষ্যতে তিনি ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হলে এই নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন বাতিল বলে গণ্য হবে’।

সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল খালেক মিয়ার নিয়োগ নবায়ন সবশেষ অনুমোদন দেয়া হয় ২০২০ সালের ৩১ মে। তবে এ ক্ষেত্রেও সিআইবি প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়নি। আর এ জন্যই তার অনুমোদনে শর্ত জুড়ে দেয় হয়। বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে তিনি ঋণ খেলাপী হিসেবে প্রমাণিত হলে এই নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন বাতিল মর্মে গণ্য হবে’।

অবশ্য ২০১৮ সালে আব্দুল খালেক মিয়ার নিয়োগ নবায়ন অনুমোদনের ক্ষেত্রে সিআইবি প্রতিবেদন থেকে তার ঋণ খেলাপী না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ খেলাপী সংক্রান্ত সিআইবি প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২৯ মে তার নিয়োগ নবায়ন অনুমোদনপত্র ইস্যু করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, কাজের দ্রুততার স্বার্থে অনেক সময় সিআইবি প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগেই নিয়োগ বা নবায়ন অনুমোদন দেয়া হয়। তবে নিয়ম হচ্ছে সিআইবি প্রতিবেদন থেকে ঋণ খেলাপীর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই অনুমোদন দেয়া।

ড. এম মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, আবেদন পাওয়ার পনের দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় একটা ফাইল চেক করতেই দেড় থেকে দু’মাস সময় লেগে যায়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিপোর্ট আসতেও অনেক সময় দেরি হয়ে যায়।

এসব ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। তবে এই শর্ত অনেক কঠিন। পরবর্তীতে কেউ ঋণ খেলাপী প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু তার নিয়োগ বাতিল হয়নি, এমন ঘটনা নেই। বরং ঋণ খেলাপী প্রমাণিত হওয়ার পর নিয়োগ বাতিল হয়েছে এর ইতিহাস আমাদের মাঝে আছে।

প্রাইম ইসলামী লাইফের সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিআইপিডি’র মহাপরিচালক কাজী মোরতুজা আলী বলেন, জরুরি প্রয়োজনে সময় স্বল্পতার ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপীর বিষয়ে সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়া অনুমোদন দিতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির একটি ঘোষণাপত্র নিতে পারে কর্তৃপক্ষ।

তবে বারংবার বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে একাধিকবার সিআইবি প্রতিবেদন ছাড়া অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। নিয়মিতই এমনটি করার অর্থ কর্তৃপক্ষ আইনটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটা করলে আইডিআরএ তার নিয়ম ভঙ্গ করছে। এর জন্য আইডিআরএ’কে দায়ি থাকতে হবে।

এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন ঝুঁকিতে থাকে তেমনি বীমা কোম্পানিও। কারণ, পরবর্তীতে যদি সেই ব্যক্তি ঋণ খেলাপী প্রমাণিত হয় তাহলে তার নিয়োগ বাতিল হবে। তবে বীমা গ্রাহকের ওপর এর প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ঋণ খেলাপী হতে পারেন, কিন্তু তার কার্যক্রম নয়।

উল্লেখ্য, সিআইবি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ বিভাগ। যেখানে ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বা লিজ গ্রহীতাদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করা হয়। ঋণ গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ইতোপূর্বে ঋণ বা লিজ নিয়েছে কি-না, নিয়ে থাকলে তার অবস্থা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণ খেলাপী কি-না তা সিআইবির ঋণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।

১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক খাত সংস্কার প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআইবি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য খেলাপী ঋণের বিস্তার রোধ করা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিআইবি প্রতিবেদনের সহায়তা নিয়ে নতুন ঋণ বিতরণ এবং ঋণ পুন:তফসিলীকরণের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে।

প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যেক মাসে বিতরণকৃত ঋণ বা লিজের তথ্য সিআইবিতে পাঠাতে হয়। কোন ঋণ বা লিজ হিসাব পুন:তফসিল করা হলেও তার তথ্য সিআইবিতে পাঠানো বাধ্যতামূলক। এমনকি কোন ঋণ বা লিজ হিসাব অবলোপন করা হলেও তার তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করতে হয়।