হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ড: শিল্পের স্বার্থে সকল পক্ষের করণীয়

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ: যে কোন অগ্নিকাণ্ডই বীমা শিল্পের জন্য অশনি সংকেত নিয়ে আসে। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা, তাজিন এপারেলস, ষ্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, ডিগনীটি সোয়েটার, বনানীর এফআর টাওয়ার ইত্যাদির পাশাপাশি ২০২১ এর জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস এর অগ্নিকাণ্ড বীমা শিল্পকে বিরাট নাড়া দিয়েছে। কারণ হিসাবে বলা যায়, হাসেম ফুডস এর মালিক বীমা শিল্পের একজন কর্ণধার। তিনি অতীব ভদ্রলোক এবং স্বজ্জন ব্যক্তি। তার প্রমাণ তিনি জেল হাজতে থাকা সত্ত্বেও মৃত ও আহত অনেকের ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। যদিও মৃত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ অর্থের বিনিময়ে সম্ভব নয় এবং এখনো যারা ক্ষতিপূরণ পাননি তাদের জন্য টিভিতে বিজ্ঞাপন ও যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে যেন তাদের অভিভাবকগণ ক্ষতিপূরণের জন্য যোগাযোগ করেন। এটা একটি মহৎ উদ্যোগ।

হাসেম সাহেব দীর্ঘ ৪০-৫০ বছর সাধনা, চেষ্টা, শ্রম, মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শত শত লোকের কর্মসংস্থান করেছেন। বেকারত্ব দূর করেছেন। সরকারকে রাজস্বের যোগান দিয়েছেন। অথচ একটি মাত্র দুর্ঘটনা তার সকল অর্জনকে ম্লান করে দিবে তা কিন্তু মেনে নেয়া যায় না। সমাজের সকল স্তরের মানুষের তার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা পূর্বের মতোই দেখানো উচিৎ। কেননা দুর্ঘটনা যে কারোর ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন কারখানাটি করাই আমার ভুল হয়েছে। আমরা আশা করি এমন কোন পদক্ষেপ কোন পক্ষই নিবেন না যাতে শিল্প উদ্যোক্তা তৈরীতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ী সমাজ আছে বলেই ব্যাংক, বীমা, মানুষের কর্মসংস্থান ও সরকারের রাজস্ব আয় ইত্যাদি চলমান, যার দ্বারা সরকার পরিচালিত হয়। অনেক এমন নির্দশন রয়েছে যে বহু কারখানার মালিক অগ্নিকান্ডে নিজের জীবনও আত্মহুতি দিয়েছেন। তাই তাদের অযথা হয়রানি না করে তদন্তের ভিত্তিতে দোষী সাবস্ত্য হলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আইনের প্রতি সকলেরই শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিৎ।

যে কোন অগ্নিকান্ডের নানাবিধ কারণ থাকে। সকল কারণের জন্যই মালিক পক্ষ সরাসরি দায়ী থাকেন না। অনেক পারিপার্শ্বিক কারণও বিদ্যমান। কারখানার অগ্নিকান্ডের সাথে অনেক পক্ষই জড়িত থাকেন। তার কিছু কারণ ও প্রতিকারের ব্যাপারে আলোচনা করা গেল।

মালিক পক্ষের দায়িত্ব:

  • কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ কোড অনুসরণ করার নীতি রয়েছে। এই নিয়ম মেনে মালিক পক্ষের কারখানা নির্মাণ করা উচিৎ এবং এগুলো দেখার জন্য নির্ধারিত ডিপার্টম্যান্ট রয়েছে। তাদের দায়িত্বকেও আমলে আনতে হবে।
  • ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার ডিকেশন ও প্রোটেকশন ও ফায়ার এলার্ম, ফায়ার এক্সিট, প্রেশারাইজেশন সিস্টেম সচল রাখতে হবে। প্রশস্ত সিড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • দাহ্য বস্তু কারখানায় সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

  • যথাযথ ইলেকট্রিক ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নির্মাণ কোম্পানি রয়েছে তাদেরও দায়িত্ব সঠিক মানের মালামাল তৈরী ও সরবরাহ করা। যা অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই মান-সম্পন্ন মালামল ব্যবহার করতে হবে।
  • লোড ক্যালকুলেশন করে ওভার লোডের সম্ভাবনা থাকলে কিভাবে তা বাইপাস করে লোড সঠিক রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য বৈদ্যুতিক সংযোগের সময় ডেসকো/ডেসা/পল্লী বিদ্যুৎ এর পরামর্শ নিতে হবে।
  • সরঞ্জামাদি সংযোজনের জন্য বিভিন্ন লাইসেন্স প্রাপ্ত ঠিকাদার রয়েছে। তাদেরও উচিৎ যথাযথ যত্ন নিয়ে সংযোগের কাজ সম্পন্ন করা। যাতে কোন রকম ত্রুটি না থাকে। সে জন্য অভিজ্ঞ এবং প্রায়োগিক জ্ঞান সম্পন্ন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে।
  • এগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করার জন্য নির্ধারিত নিয়মও রয়েছে। প্রতিনিয়ত তা হচ্ছে কিনা কারখানায় কর্মরত কর্মকর্তাদের তা খতিয়ে দেখতে হবে। গাফিলতি থাকলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • কল কারখানায় কাজের পরিবেশ, বয়স ভিত্তিক লোকবল নিয়োগ, তাদের সুযোগ সুবিধা দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। তাদের সময় সময় নিয়ম অনুযায়ী কারখানা ভিজিট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • কারখানায় কর্মরত সকলের জীবনের নিরাপত্তার জন্য গ্রুপ বীমার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • অবৈধ আর্থিক সুবিধা না নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সঠিক প্রিমিয়াম দিয়ে বীমা করাও বীমা গ্রহীতার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যা যথাযথ ক্ষতি পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বীমা গ্রহীতাগণ নিশ্চয় সে ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন।

ব্যাংকের দায়িত্ব:

  • ব্যাংকিং সেক্টর শিল্পের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। নির্মাণ ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিক দেখভাল করে তারা লোন বিতরণ করে থাকেন। তাদেরও অভিজ্ঞ লোকবল রয়েছে। তাই তাদের দায়িত্বও কম নয়। যে কোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মালিক পক্ষ যেন ব্যাংক থেকে সর্বতোভাবে সহযোগীতা পান সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ কারখানা সচল না থাকলে তাদের লোন হবে না এটা মনে রেখে সাময়িক সমস্যা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মালিককে আর্থিক সহযোগীতার মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দিতে হবে।

সার্ভেয়ারের দায়িত্ব:

  • দুর্ঘটনায় যাতে ক্ষতির পরিমান কম হয় সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার জন্য সার্ভেয়ার কোম্পানী রয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাতে হবে।
  • সার্ভে কোম্পানীর বীমা কোম্পানীর প্রতিনিধির সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শন করে প্রি-রিক্স ইনস্পেকশন রিপোর্ট দিয়ে বীমা কোম্পানীও বীমা গ্রহীতাকে পরামর্শ/সতর্ক করারও দায়িত্ব রয়েছে।

বীমা কোম্পানীর ও পুনঃবীমাকারীর দায়িত্ব:

  • বীমা প্রতিনিধি সরেজমিনে পরিদর্শন ও প্রি-রিক্স ইনস্পেকশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সঠিক প্রিমিয়াম নির্ধারণ করতে হবে। কোন ফাঁকি বা ঝুঁকির আশ্রয় নেয়া যাবে না।
  • কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বীমা কোম্পানীর প্রতিনিধির দ্রæত ক্ষতিগ্রস্থ স্থান পরিদর্শন করে বীমা গ্রহীতার পাশে দাড়ানো এবং ক্ষতির ধরণ অনুযায়ী অভিজ্ঞ ও গুনগত মান সম্পন্ন সার্ভেয়ার দিয়ে ক্ষতিপূরণের মূল্যায়ন করে তা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ।
  • পুন:বীমার প্রিমিয়াম নিয়মিত সঠিক সময় দিয়ে পুন:বীমাকারী থেকে ক্ষতিপূরণের দাবী আদায়ে জোর চেষ্টা চালানো।
  • বীমা কোম্পানীর কাছে কোন দায়-দেনা থাকলেও পুন:বীমাকারীকে যত দ্রæত সম্ভব দাবী নিষ্পত্তি করে শিল্পের ইমেজ বৃদ্ধিতে সহযোগীতা করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় জন-প্রতিনিধির দায়িত্ব:

  • সবশেষে বাংলাদেশ সরকার বিপদ আপদ থেকে মানুষ ও সম্পদকে রক্ষার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টম্যান্ট চালু করেছেন। যে কোন অগ্নি দুর্ঘটনায় তারাই মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বীমাদাবীর জন্য তাদের একটি প্রতিবেদন দরকার হয়। যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হউন না কেন তাদের সাথে দফা রফা না করে কোন প্রতিবেদন আনতে পারেন না। যা বীমা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
  • এই প্রতিবেদন সংগ্রহ বীমা শিল্পের ইমেজ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। বড় ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে তা সকলের পক্ষেই অনুধাবন করা সম্ভব হয়। ভিডিও ফুটেজও নেয়া যায় বা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ স্থানের ভিডিও করা যায়। কখনো কখনো পেপার পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের মাধ্যমেও তা প্রত্যক্ষ করা যায়। স্থানীয় প্রতিনিধিরাও অগ্নি দুর্ঘটনায় যে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি সংগঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন। তাই অগ্নি দুর্ঘটনার ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
  • একটি এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন থেকে কারখানা চালু এবং সার্বিক এলাকার লোকজনের চাকুরী, কারখানার নিরাপত্তা, স্থানীয় প্রতিনিধির কার্যক্রমের সাথে জড়িত। দুর্ঘটনা ঘটলে এলাকার লোকজন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান ও ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়াও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
  • তাই বীমা দাবীর ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টাম্যান্টের প্রতিবেদন ছাড়া যাতে বীমা দাবী সহজে নিষ্পত্তি করা যায় সে ব্যাপারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও পুন:বীমাকারী সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে যৌথভাবে ভেবে দেখতে হবে। তাদের যথাযথ সিদ্ধান্ত বীমা শিল্পের ইমেজ বৃদ্ধির সহায়ক হবে।

মালিক পক্ষের বীমা করার বাধ্যকতা ও বীমা কোম্পানীর ভূমিকা:

বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যে কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিলে তার বিপরীতে বীমা করতে হয়। তাই হাসেম ফুডস্ ৪টি বীমা কোম্পানীতে (কালের কন্ঠের) তথ্য মতে বীমা করেছেন যার বীমা মূল্য টাঃ ৪৭৭.০০ কোটি টাকা। বীমাকৃত কোম্পানীগুলো হলো: দেশ জেনারেল, কন্টিন্যান্টাল, রিপাবলিক এবং সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী। বীমা পরিবারের সদস্য হিসাবে আমাদের সকলেরই জনাব হাসেম সাহেবের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।

শুনেছি কোন কোম্পানীতে নাকি তার পূর্বের কোন এক প্রতিষ্ঠানের অগ্নি দুর্ঘটনায় নিষ্পত্তিকৃত দাবীর প্রায় ৮ কোটি টাকা এখনো পাননি। সে বীমা কোম্পানীটি এই দুঃসময়ে ওই টাকা প্রদান করে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিতে পারেন।

আসুন আমরা সকলে বঙ্গবন্ধর জন্ম শত বার্ষিকীতে  যার যার অবস্থান থেকে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখি। বিশেষ করে কারখানার মালিকপক্ষ সরকারী নির্দেশনা মেনে শিল্প স্থাপন ও পরিচালনা করুন। ব্যাংক, বীমা ও পুণঃবীমাকারী যথাযথ পরামর্শ ও নির্ভরশীল সার্ভিস দিয়ে দেশের শিল্পকে সচল রাখতে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিন। শিল্প, শ্রম, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান শিল্প বিকাশের প্রতিবন্ধক না হয়ে সহযোগী হউন। নিশ্চয় বাংলাদেশ একদিন সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিনত হবেই, ইনশাআল্লাহ। লেখকঃ মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

লেখক: মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।