ফসল বীমায় লাভ বীমা কোম্পানিরই
ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক: বিপদে কৃষকদের পাশে ছায়া হয়ে থাকবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে এসেছিল প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই প্রকল্প চালু হয় ২০১৬ সালে। এই প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল, দেশের কৃষকদের স্বার্থ আগের তুলনায় অনেক বেশি রক্ষিত হবে।
এই প্রকল্পের মূল কথা হলো- সবচেয়ে কম প্রিমিয়াম দিয়ে বিবিধ সুবিধা পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে বীমা সংস্থা কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেবে। খরা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমন সুবিধা মিলবে। আবার রোগে কোনও ফসল নষ্ট হলেও ক্ষতিপূরণ মিলবে। কেন্দ্র এবং রাজ্য কৃষকদের হয়ে বীমার প্রিমিয়াম দেবে। আবার কৃষকদেরও একটা অংশ দিতে হবে।
কিন্তু ‘ফ্যাক্টচেকার’ নামের এক তদন্তকারী সংস্থা জানিয়েছে, মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম জেলা হার্ডদারে দুই শতাধিক কৃষক সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন কৃষি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্ত হয়েছেন। তাদের অভিযোগ, হিসাব জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের পাওনা কম দেখানো হচ্ছে। বীমা কোম্পানিগুলো চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে৷ একই অভিযোগ এসেছে মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু, মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলার কৃষকদের থেকেও।
দেশটির গণদাবি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, বীমা কোম্পানিগুলোর লোকবল কম। পরিকাঠামো দুর্বল। সঠিক হিসাব করাও তাদের কাছে এক দুরূহ ব্যাপার। মাঝখান থেকে ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ কৃষকদের। এই সমস্যা কৃষকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর অস্থিরতায় ঠেলে দিচ্ছে। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে৷ সরকারও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এছাড়া কৃষকদের একটা বড় অংশ এই বীমার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা চাষ করছেন, ব্যাংকের মাধ্যমে তারা এই যোজনার অংশীদার হতে পারলেও, বাকিদের একটা বড় অংশ নানা কারণে এই প্রকল্পের বাইরে রয়েছে।
কৃষি দফতরের এক তথ্য বলছে, জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট কৃষকের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৬ হাজার। ফি বছর বিভিন্ন মরসুমে বীমার আওতায় আসেন আড়াই থেকে তিন লক্ষ কৃষক। প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষক নানা কারণে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারি সহায়তাও এক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম। আবার আবেদনকারীদের ফসল নষ্ট হলেই যে তারা ক্ষতিপূরণ পাবেন এমনটা সবসময় হয় না।
এই বীমার নিয়ম হলো প্রাকৃতিক কারণে কোনও এলাকায় অন্তত ৩৩ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হলে তবেই ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় নাম ওঠে। ব্যক্তিগতভাবেও কোনও কৃষক ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে পারেন। কৃষি দফতর এবং বীমা সংস্থার কর্মীরা এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো অনেক জায়গায় বীমা কোম্পানিগুলোর অফিস নেই। এরপরও যারা ক্ষতিপূরণের টাকা পান, সে টাকার হিসাবেও থাকে নানা জালিয়াতি।
ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া’র ২০১৭–১৮ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬–১৭ অর্থবছরের সময়সীমায় ফসল বীমা প্রকল্প বাবদ ১১টি প্রাইভেট বীমা কোম্পানির লাভের পরিমাণ ৩০৭৪ কোটি টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, বীমা কোম্পানির লাভের অঙ্ক বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই নতুন সরকারের হাত ধরে ফসল বীমা যোজনা প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা পেল তা নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই।
অন্যদিকে ২০১৭–১৮ অর্থবছরে অর্থাৎ ফসল বীমা যোজনার দ্বিতীয় বছরের হিসাবে দেখা যায়, সংগৃহীত মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। সেখানে মাত্র ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ ১২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা কৃষকদের দাবি মেটাতে হয়েছে।
২০১৭ সালে কম্পড্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬৩ শতাংশ কৃষকর এই যোজনার প্রিমিয়ামের হার, রিস্ক্, ক্লেম, তার হিসাব সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। অর্থাৎ এভাবেই সাধারণ মানুষের টাকা দিয়ে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির অর্থ ভাণ্ডারকে পুষ্ট করা হচ্ছে। বীমা কোম্পানির হাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এমন সুবিধা দেয়া হচ্ছে যাতে অধিক মুনাফা করতে তাদের কোনও অসুবিধা না হয়৷