ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের ধৃষ্টতা, লাইসেন্স বাতিলের হুমকিতেই...!
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ না করে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এমন মন্তব্য খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)। মন্তব্য করেই থেমে থাকেনি কর্তৃপক্ষ। তারা একাধিকবার কোম্পানিটির লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েছে।
তবে এ হুমকির কোনো তোয়াক্কাই করেনি বেসরকারি এ লাইফ বীমা কোম্পানি। সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের এ বাধ্যবাধকতা বছরের পর বছর লঙ্ঘন যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে লাইসেন্স বাতিলের মত নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ হুমকি থেকে গেছে কাগজে কলমেই।
এদিকে আইডিআরএ’র নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য (লাইফ) ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে আবারো সময় দেয়ার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ নীতিমালা পরিপালনের জন্য কোম্পানিটিকে আবারো চিঠি দেয়া হবে। তবে এই চিঠির নির্দেশনা লঙ্ঘন হলেই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র মতে, লাইফ বীমা কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করা বাধ্যতামূলক। বছরের পর বছর তা লঙ্ঘন করে আসছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বন্ডে বিনিয়োগ করতে কোম্পানিটিকে সময় বেধে দিয়ে একাধিকবার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরও কোম্পানিটি তা পরিপালন করেননি।
কোম্পানিটির এ ধরণের নির্দেশ অমান্যকে কর্তৃপক্ষের প্রতি অত্যান্ত ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল বলে আখ্যায়িত করেও চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। চিঠিটি দেয়া হয় ১ বছর ১০ মাস আগে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬। এ চিঠিতেও বিনিয়োগের জন্য ৭ দিন সময় বেধে দেয়া হয়। অন্যথায় বীমা আইনের বিভিন্ন ধারায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
তবে নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য লাইসেন্স বাতিলের মত নিয়ন্ত্রক সংস্থার হুমকি থেকে গেছে কাগজে কলমেই। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ যেমন নির্দেশ পালন করেনি। তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি লাইসেন্স বাতিল বা অন্যকোনো ধারায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ও আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ২৬১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৯৯ টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ২৯৮ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ১১.৩৯ শতাংশ।
এরআগে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৫১৪ কোটি ৯১ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৬ টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ১৭৭ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৯২ টাকা বা ৭.০৫ শতাংশ।
২০১৬ সালের শেষ নাগাদ কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২৬২৩ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ৫৪ কোটি ৭০ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৬ টাকা বা ২.০৯ শতাংশ।
২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৬৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এরমধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ০.০৫৭ শতাংশ।
আর ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ২৫৯১ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এরমধ্যে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ ০.০৫৫ শতাংশ।
এদিকে পলিসি হোল্ডারস লায়াবিলিটির ৩০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে বারবার চিঠি দিয়ে আসছে বীমা উন্নযন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই কোম্পানিটিকে ৬ দফা নির্দেশ দিয়েছে আইডিআরএ।
এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে পাঠানো চিঠিতে বিনিয়োগ নীতিমালা পরিপালনের বিষয়ে ৫টি নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে এসব নির্দেশ পরিপালন করা না হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
এরপর ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল ৭ দিনের সময় দিয়ে চূড়ান্তভাবে আরেকটি চিঠি দেয় আইডিআরএ। চিঠিতে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
এসব চিঠির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর এক চিঠিতে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দেশনা অনুসারে সিকিউরিটিজ বন্ডে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হবে।
এরপর ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল আরেকটি চিঠিতে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ আইডিআরএ’কে জানায়, আমরা এরইমধ্যে ১০১ কোটি ৫৬ লাখ ২৩ হাজার ৫৬৩ টাকা বিনিয়োগ করেছি এবং এই ধারা অব্যাহত রেখেছি।
একইসঙ্গে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড বিনিয়োগের জন্য ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত সময় দেয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ জানায় বেসরকারি এ লাইফ বীমা কোম্পানি।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের প্রথম প্রান্তিকের ওপর মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে আইডিআরএ। ওই প্রতিবেদনে সিকিউরিটিজ বন্ডে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মোট বিনিয়োগ দেখানো হয় ১৩ হাজার ৯৪৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এতে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ দাঁড়ায় গড়ে ৪৭.৯০ শতাংশ।
তবে সিকিউরিটিজ বন্ডে যেসব কোম্পানির বিনিয়োগ ঘাটতি রয়েছে সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি ওই প্রতিবেদনে। সর্বমোট এবং গড় হিসাব দেখানোর ফলে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের এ দূরাবস্থার চিত্রও উঠে আসেনি ওই প্রতিবেদনে।
বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, পলিসি গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোন কোম্পানি এ নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে বীমা আইনে।
সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করলে বীমা আইন ২০১০ এর ঘ এবং ছ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্যাহ'র সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরবর্তীতে আবারও কল করা হলে তিনি রিসিভ না করে কলটি কেটে দেন।
ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগ বিধি না মানার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র সদস্য ড. এম মোশারফ হোসেন, এফসিএ’র সঙ্গে। তিনি বলেন, আগের কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে, কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছে।
কিন্তু বিষয়টি আমাদের নজরে না আসায় কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য হাতে পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রথমে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয়া হবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে শুনানি হবে। তারপরও বিধি অনুসরণ না করলে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আমরা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেব, বলেন ড. এম মোশারফ হোসেন।
আইনের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই উল্লেখ করে আইডিআরএ’র এই সদস্য বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত কোম্পানি ভিত্তিক ব্যবস্থা না নিয়ে সার্বিকভাবে তাদের সতর্ক করেছি। বিনিয়োগ বিষয়ে সেমিনার আয়োজন করেও কোম্পানিগুলোকে বিধি পরিপালনের নির্দেশ দিয়েছি। এরপরও কোন কোম্পানি বিনিয়োগ বিধি না মানলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।