নন-লাইফ বীমায় ৭ উপায়ে চলছে অবৈধ কমিশন

আবদুর রহমান আবির: আইনগত নিষেধাজ্ঞা এবং চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহীদের অঙ্গিকারের পরও নন-লাইফ বীমাখাতে বন্ধ হয়নি অতিরিক্ত কমিশন। বরং ব্যবসা সংগ্রহে পাল্টে গেছে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার ধরন। এক পথ বন্ধ হওয়ায় একাধিক পথে চলছে অতিরিক্ত কমিশন। বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৭টি উপায়ে অতিরিক্ত কমিশন চলছে খাতটিতে। তবে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সবাই।

জানা গেছে, অবৈধ কমিশন বন্ধে ১৫ শতাংশ কমিশন বাস্তবায়নে গত জুনে ৬২ নং সার্কুলার জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এরপরই তা বাস্তবায়নে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহীদের উদ্যোগে একাধিক সভায় ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময় সংবাদ সম্মেলন করেও বেশি কমিশন না দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। একইসঙ্গে এক কোম্পানির ব্যবসা অন্য কোম্পানি না নেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

বীমা মালিকদের এক সভায় ঘোষণা করা হয়, ১ আগস্ট, ২০১৯ তারিখ থেকে এজেন্সি কমিশন হিসেবে ১৫ শতাংশের বেশি (এআইটি বাদে ১৪.২৫ শতাংশ) কাউকে প্রদান করা যাবে না; কেউ করলে তা আইনের ব্যত্যয় বলে গণ্য করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুধুমাত্র আইডিআরএ থেকে লাইসেন্স প্রাপ্ত এজেন্টকে ১৫ শতাংশ কমিশন প্রদান করা যাবে।

কোন নন-লাইফ কোম্পানিতে কমিশন ভিত্তিতে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ দানে বিরত থাকার বিষয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। সিদ্ধান্ত হয়, কোন নন-লাইফ কোম্পানি কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে অন্য বীমা কোম্পানির গ্রাহকের সাথে ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বীমা শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এজেন্ট নিয়োগ করা জরুরি বলেও সবাই সহমত পোষণ করেন।

অথচ নিজেরাই রক্ষা করতে পারছেন না নিজেদের প্রতিশ্রুতি। নিষেধাজ্ঞা ভেঙেই চলছে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। এক কোম্পানির ব্যবসাও হাতিয়ে নিচ্ছে অন্য কোম্পানি। তবে সরাসরি অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে নানান কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলো। অভিযোগের সুরে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারাই ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে জানিয়েছেন অবৈধ কমিশন দেয়ার এসব উপায়ের কথা।   

বীমা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু বীমা কোম্পানি অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহের জন্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগে থেকেই ফান্ড গঠন করে রেখেছিল। সেখান থেকে অতিরিক্ত কমিশন বাবদ ব্যয় করে যাচ্ছে এসব বীমা কোম্পানিগুলো। অতীতের বকেয়া প্রিমিয়ামের সাথে সমন্বয় করেও দেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কমিশন। বিশেষ করে ওপেন কভার নোটের প্রিমিয়ামের সাথে সমন্বয় করে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো।

এ ছাড়াও মার্কেটিংয়ে নিয়োজিত জনবলের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করে, সেই বাড়তি বেতন-ভাতা খরচ করা হচ্ছে অতিরিক্ত কমিশনে। আবার নতুন করে মার্কেটিংয়ে ভুয়া নিয়োগ দিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করা হচ্ছে। সেই বেতন-ভাতা থেকেও দেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কমিশন। বিনোদন খাতে অতিরিক্ত বিল-ভাউচার দেখিয়েও ব্যয় করা হচ্ছে গ্রাহক সন্তুষ্টির কমিশনে।

বীমা সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, কিছু নন-লাইফ বীমা কোম্পানি গ্রাহককে পরিশোধিত বীমা দাবির পরিমাণ বাড়তি দেখিয়ে বা ভুয়া বীমা দাবি পরিশোধ দেখিয়ে সেই টাকা ব্যয় করছে অতিরিক্ত কমিশনে। নৌ বীমার ক্ষেত্রে শিপমেন্টের পর কিছু প্রিমিয়াম ফেরত দেয়ার মাধ্যমেও ব্যবসা সংগ্রহের চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলো।

এ বিষয়ে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে কনক্রিট কোন ইনফরমেশন নেই। তবে আমরা অনেক ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছি, পাচ্ছি না, আমাদের রিনিউআল ব্যবসা চলে যাচ্ছে। এগুলো তো এখন হচ্ছে। তবে আইডিআরএ’ও এসব বিষয় জানে। বিআইএ’ও জানে। আমরাও শুনি যে, এতো পার্সেন্ট দিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের হাতে তো কনক্রিট কোন ইনফরমেশন নেই। এটাও ঠিক যে, এবার আমাদের ব্যবসা কম হচ্ছে। আগের বছরে আমাদের ব্যবসা ঠিক ছিল। তবে নতুন একটা নিয়মে আসতে গেলে কিছু কষ্ট হবেই। এখন নতুন ব্যবসা বলতে, কোন গ্রুপের হয়তো একটা অংশের বীমা করা ছিল না সেটা আমরা পাচ্ছি।

গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী আরো বলেন, ফান্ড গঠন করে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার বিষয়টি আমাদের কানেও এসেছে। তবে কয়দিন তারা এটা করবে! ওপেন কভার নোটের মাধ্যমে অনেকে ব্যবসা নিয়ে যাচ্ছে। যদিও ওপেন কভার নোট বন্ধ করার সুযোগ নেই, তবে সাময়িকভাবে এটা স্থগিত করা হয়েছে।

ফারজানা চৌধুরী বলেন, মার্কেটিংয়ে নতুন লোক নিয়োগ দেখিয়ে বেতন তুলে নেয়ার বিষয়টি আইডিআরএ আমাদের জানিয়েছে। এ কারণে ৩১ জুলাইয়ের পর নতুন নিয়োগ কয়জন হয়েছে, কোম্পানিগুলোর সেই রিপোর্ট দেখছে আইডিআরএ। অনেকে আমাদের এসে বলছে- মার্কেটিংয়ে লোক লাগবে, কিন্তু আমরা নিচ্ছি না। এমনকি এটা আমরাও পেয়েছি যে, এই ক্লায়েন্ট আসতে চায় কিন্তু একে চাকরি দিতে হবে। আমরা বলেছি- না, তাহলে নেব না। ওটা নিলেই তো বোঝা যাবে যে, কেন…।

তিনি আরো বলেন, এখন বীমা দাবি পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। আইডিআরএ বলেছে যে, আপনারা দেখে দিবেন যাতে ভুয়া দাবি না দেয়া হয়। মার্কেটে তো এখন এক দিকে রেস্ট্রিক্ট করলে আরেক দিকে খুলে যায়। তারপরও আমরা নিয়মের মধ্যে থাকার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, নিয়মের মধ্যে থাকলে আমাদেরই লাভ। আমাদের সম্মানটা ফিরে আসবে। আগে তো একটা অন্যরকম কম্পিটিশন হতো। এখন রিয়েল কম্পিটিশন হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কোম্পানিগুলো এখন উপযুক্ত রেট দিবে, উপযুক্ত সেবা দিবে, বীমা দাবি তাড়াতাড়ি দিবে। সার্বিকভাবে হেলদি কম্পিটিশন বেড়ে যাবে। এটা সবার জন্যই ভালো।

সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামিম বলেন, আইডিআরএ’তে অনুষ্ঠিত নিয়মিত বৈঠকে কিছু কিছু কোম্পানির সিইও বিভিন্নভাবে (সরাসরি নয়) এ বিষয়ে কথা বলেছেন। যেমন- কেউ কেউ কমিশন দেয়ার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের অফিসগুলোতে। কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক খলিল আহমদ গত বৈঠকে জানিয়েছেন, তিনি কয়েকটি কোম্পানিতে দেখেছেন যে, কারো নামে ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে সে অনুযায়ী বেতন নিয়েছে। মাস তিনেক আগের ঘটনা এটা।

তবে আইডিআরএ সে অনুযায়ী পদক্ষেপও নিয়েছে। এরপর আইডিআরএ বিষয়টি বন্ধ করতে ৬ মাস আগের ও পরের নিয়োগ এবং বেতন মিলিয়ে দেখার জন্য সব কোম্পানির পে-লিস্ট ও অরিজিনাল এমপ্লয়মেন্ট তথ্য নিয়েছে। অনেক কোম্পানি এ তথ্য দিতে দেরি করায় প্রশ্ন উঠেছিল, কেন দেরি হচ্ছে। আমরাতো চাওয়ার সাথে সাথেই দিয়েছি। অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার এটি একটি পথ ছিল।

শফিক শামিম আরো জানান, অনেকে বলেন যে, বেতন নির্ধারিত না থাকায় এজেন্টকে কমিশন কম দিয়ে, সেটা বীমা গ্রাহককে প্রদানের সুযোগ রয়েছে। অনেক কোম্পানি এ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। কমিশন বন্ধ হওয়ার আগেই কোন কোন কোম্পানিতে ফান্ড গঠনের কথা শুনেছি। আবার বীমা দাবির পরিমাণ বাড়িয়ে এবং বকেয়া প্রিমিয়ামের সাথে সমন্বয় করেও অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার কথা এসেছে। বর্তমানে অবশ্য সাময়িকভাবে ওপেন কভার নোট ইস্যু স্থগিত করা হয়েছে।

তবে আমার মতে এসব কাজ কঠিন। অনেক কিছু মেইনটেইন করে এসব করতে হয়। সব কিছুরইতো হিসাব রয়েছে। মূল কথা হচ্ছে- নিজেরা ভালো না হলে কেউ আমাদের ভালো করতে পারবে না। আমাদেরকে আইনের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং নিজেদের ভালোর জন্যই এটা করতে হবে। 

এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ইমাম শাহীন বলেন, এসব বিষয়ে আমিও কিছু শুনেছি। বিষয়গুলোর সমাধান করার জন্য আমাদের মূখ্য নির্বাহীদের সংগঠন বিআইএফ’র পক্ষ থেকে আগামী ১১ তারিখে সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় এসব বিষয় নিয়ে কথা হবে। তারপর আগামী ২৭ তারিখে ঢাকা ক্লাবে চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহীদের নিয়ে বিআইএ’র একটি সভা রয়েছে। সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

ইমাম শাহীন বলেন, আমার জানা মতে প্রায় সবাই অতিরিক্ত কমিশন দেয়া বন্ধ করেছে। দু’একটা কোম্পানি হয়তো এখনো অতিরিক্ত কমিশন দিচ্ছে, তবে এর সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ জানা নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ, বিআইএ এবং বিআইএফ যৌথভাবে এটি বন্ধের চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, নন-লাইফ বীমাখাতে অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার বিষয়টি প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

ইসলামী কমাশিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখনো অনেক কোম্পানি অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসা করছে। তা না হলে এক কোম্পানির ব্যবসা অন্য কোম্পানি নেয়ার অভিযোগ আসত না। সুযোগ-সুবিধা বেশি পেলেই গ্রাহক অন্য কোম্পানিতে বীমা করে। আমার কোম্পানির ব্যবসাও নিয়ে গেছে অন্য কোম্পানি।

ওপেন কভার নোট ইস্যু সাময়িক স্থগিত আছে, কিন্তু অনেকেরই প্রিমিয়াম বকেয়া আছে। ব্যবসা সংগ্রহের জন্য এখন এই বকেয়া প্রিমিয়াম অনেকে কাজে লাগাচ্ছে বলে আমরা জানতে পারছি। কিন্তু কেউতো বিষয়টি স্বীকার করবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ইস্যুতে আমি কথা বলি এবং মাঝে-মধ্যে লেখালেখি করি বলে আমাকেই চাপে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তবে আমি চাই, সেক্টরে ভালো কিছু হোক। ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে আমরা আরো এগিয়ে যেতে চাই।