সপ্তাহে এক দিন অফিস খোলা রাখার দাবি বীমাখাতে

আবদুর রহমান আবির: সপ্তাহে অন্তত এক দিন অফিস খোলা রাখার দাবি উঠেছে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমাখাতে। কোম্পানিগুলো বলছে, বীমা কর্মীদের বেতন-ভাতা ও কমিশন প্রদানসহ সরকারকে ভ্যাট দেয়ার জন্য হলেও অফিস খোলা প্রয়োজন। তাছাড়া বীমা গ্রাহকরা এখনো অনলাইন মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তাই প্রিমিয়াম জমা ও পলিসি ইস্যুর প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে অফিস খোলা রাখা দরকার।

অন্যদিকে দুর্যোগপূর্ণ এই সময়ে বীমা পলিসি না থাকার কারণে জরুরি প্রয়োজনীয় মালামাল বন্দর থেকে খালাস করতে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার জন্য কভার নোট প্রয়োজন হয়। আর পোর্ট থেকে মালামাল নামানোর জন্য বীমা পলিসির প্রয়োজন। তাই এসব জরুরি প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা প্রয়োজন।

তথ্য মতে, সারাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলা এবং এর ব্যাপক বিস্তার রোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছু্টি ঘোষণা করেছে সরকার। গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এই ছুটি। এ অবস্থায় বন্ধ রয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান। বীমাখাতেও এই ছুটি কার্যকর করা হয়েছে। তবে জরুরি সেবা দিতে সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হয়েছে ব্যাংক।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুসারে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ৭৮টি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। বর্তমানে লাইফ বীমায় ৯০ লাখ ২০ হাজার এবং নন-লাইফে ৩০ লাখ ৮০ হাজার বীমা পলিসি চালু রয়েছে। উভয় খাতে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ১৩ হাজার ২৯০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এজেন্ট ও এমপ্লয়ার অব এজেন্টসহ বীমা কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন পদে কাজ করছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ নারী-পুরুষ। আর বীমার আওতায় রয়েছে ২ কোটি জনসংখ্যা।

এ অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সপ্তাহে অন্তত এক দিন অফিস খোলা রাখার দাবি জানান জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, দেশের বীমা গ্রাহকরা এখনো অনলাইন মাধ্যমে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেনি। তাই প্রিমিয়াম জমা নেয়া এবং নতুন পলিসি ইস্যু করতে হলে আমাদের অফিসে যাওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমা দিলে গ্রাহক বীমা কোম্পানির মানি রিসিট পাবে না এবং পলিসির ঝুঁকি গ্রহণও শুরু হবে না।

তাই কোন বীমা পলিসির ঝুঁকি গ্রহণ শুরু হওয়ার জন্য ব্যাংকে জমা দেয়া প্রিমিয়ামের মানি রিসিট বীমা কোম্পানির অফিসে জমা দিতে হয়। এ ছাড়াও বীমা দাবি পরিশোধ এবং কর্মকর্তা, কর্মচারী ও এজেন্টদের বেতন-ভাতা ও কমিশন দেয়ার জন্য অফিসে যাওয়া প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে বীমা খাতের স্বার্থে স্বল্প পরিসরে প্রয়োজনে সপ্তাহে এক দিন আধা বেলা হলেও বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা প্রয়োজন।

‌ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্সুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক সীমিত আকারে খোলা রয়েছে। এখনো বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে যা জনকল্যাণকর যেমন ওষুধ, পিপিই, সেনিটাইজেশন, খাদ্য ইত্যাদি খাতে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে এই এলসি খোলার জন্য মেরিন বীমার কভার নোট প্রয়োজন।

আবার পূর্বে ইস্যুকৃত মেরিন কভারনোটের মালামাল পোর্টে আসার পর তা খালাসের জন্য সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী বীমা পলিসি জরুরি। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ মূহুর্তে বীমা পলিসি না থাকায় জরুরি প্রয়োজনীয় মালামাল পোর্ট থেকে খালাস করতে সমস্যা হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের মতো বীমা কোম্পানিগুলোর অফিস সপ্তাহে অন্তত দু’দিন খোলা রাখা প্রযোজন। 

সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম বলেন, করোনা ভাইরাসের এই মহামারীতে ব্যাংকের মতো বীমা কোম্পানির সেবাও জরুরি। বেশিরভাগ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও জরুরি প্রয়োজনে এখনো আমদানী কার্যক্রম চলছে। ব্যাংকগুলোতে লেনদেন চালু থাকায় তাদের মানি পলিসি ও এলসি খোলার জন্য বীমা প্রয়োজন। এরইমধ্যে অনেক ব্যাংকের বীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে।

এ অবস্থায় তারা পলিসি নবায়ন করার জন্য আমাদের অনুরোধ জানিয়েছে। কারণ যেকোন সময় একটা দুর্ঘটনা হতে পারে। তখন বীমা দাবি নাও পেতে পারে। জরুরি প্রয়োজনে সেবা না দিতে পারলে গ্রাহকের মনে হতে পারে তার প্রয়োজনে বীমা কোম্পানি পাশে দাঁড়ায় না। যা সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্য খারাপ। বীমা গ্রাহকের জন্যও সমস্যার। এ অবস্থায় সপ্তাহে অন্তত এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা প্রয়োজন।

গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরী বলেন, সারাবিশ্বের করোনা পরিস্থিতি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের লকডাউন মানা প্রয়োজন। অবস্থা বিবেচনায় আমরা বন্ধের আগেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছি। এপ্রিল মাসের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্যও আমরা দু’একজন কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি।  

তিনি বলেন, করোনার ঝুঁকি নিয়ে কাউকে আমরা অফিসে আনতে চাই না। জরুরি প্রয়োজনে দু’একজনকে দিয়ে বীমা পলিসির কাজ করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি আমরা। এই সুযোগ তো সরকার আমাদের দিয়েই রেখেছে। তাছাড়া অফিসে ডেকে আনার ফলে যদি কেউ এই ছোঁয়াচে ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে এর দায়ভার কে নিবে!

ন্যাশনাল লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল এম এ নাসের বলেন, অফিস খোলার দরকার আছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার দিকটাও দেখতে হবে। ভাইরাসটি যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে জনস্বার্থে আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের নির্দেশনা অনুসারে লকডাউন মেনে চলা জরুরি। সবারই এখন অর্থের প্রয়োজন। এ অবস্থায় অফিস চালু করলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং পরিণাম আরো ভয়াবহ হতে পারে। তাই বৃহৎ স্বার্থে এখন ঘরে থাকাই উত্তম।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটি’র জেনারেল সেক্রেটারি এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানি উভয়ই আর্থিক প্রতিষ্ঠান। জনসেবায় প্রতিষ্ঠান দু’টি পরস্পরের সঙ্গে আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেক্ষেত্রে ব্যাংক যদি সপ্তাহে ৫ দিন খোলা রাখা যায় তাহলে গ্রাহক সেবার স্বার্থে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ব্যাংকে এলসি খোলার জন্য যেমন বীমার কভার নোটের প্রয়োজন তেমনি পোর্ট থেকে মালামাল খালাসের জন্য প্রয়োজন বীমা পলিসিপত্র। অন্যদিকে লাইফ বীমার কোন গ্রাহকের মৃত্যুর সংবাদ বীমা কোম্পানির অফিসে পৌছানো এবং বীমা দাবি উত্থাপনের জন্যও অফিস খোলা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

আইডিআরএ’র সদস্য ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, জরুরি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সপ্তাহে এক দিন বীমা কোম্পানির অফিস খোলা রাখা দরকার। তবে সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য অনলাইন সেবার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। নতুন পলিসি ইস্যু ও প্রিমিয়াম জমা সবইতো এখন অনলাইনে সম্পন্ন করা যায়। সুতরাং অফিস খুলে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গ্রাহকদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ানো কোন ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

তিনি বলেন, দেশের জনগণ যদি না বাঁচে তাহলে এতো কিছুর প্রয়োজন কোথায়! তবে জরুরি প্রয়োজনের বিষয়টি আলাদা। কোন কোম্পানি চাইলে ২/৩ ঘণ্টার জন্য অফিস খুলে জরুরি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে অফিস খোলার নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ নেই। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকায় এনে যে ভুলটি করা হয়েছে বীমা খাতেও এ ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি হোক তা প্রত্যাশিত নয়।