প্রগ্রেসিভের ৫ পদে জহির উদ্দিন, দুর্নীতি তদন্তে আইডিআরএকে দুদকের চিঠি
তাফহিমুল ইসলাম সুজন: প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানি সচিব (সিএস) মো. জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, চুরি ও শেয়ার জালিয়াতিসহ নানান অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । গত ৭ জুন পাঠানো এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দুদক পরিচালক (দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল) উত্তম কুমার মন্ডল। কোম্পানিটির একজন শেয়ার হোল্ডারের অভিযোগের ভিত্তিতে এ চিঠি পাঠায় দুদক।
এর আগে জহির উদ্দিনের দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত ৯ মে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কমিটি এক চিঠিতে জহির উদ্দিনের বিষয়ে তথ্য জানাতে প্রগ্রেসিভ লাইফের মুখ্য নির্বাহীকে চিঠি দিয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য ও আইডিআরএ'র কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম খান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ৩টি বিষয়ে তথ্য জানাতে বলা হয়। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে- জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোম্পানির পরিচালকদের অভিযোগের বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ, কোম্পানির মামলার বিভিন্ন তথ্য ও জহির উদ্দিনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিষয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের লিখিত বক্তব্য।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জহির উদ্দিন প্রগ্রেসিভ লাইফের আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। বর্তমানে তিনি কোম্পানির ৫টি বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে রয়েছে-কোম্পানি সচিব, হেড অব এইচআর, হেড অব উন্নয়ন প্রশাসন, হেড অব এজেন্সি এবং হেড অব শেয়ার ডিপার্টমেন্ট। অভিযোগ উঠেছে কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান নাসির আলী শাহ এবং কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচকে ম্যানেজ করে একাধারে ৫টি বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন।
অথচ জহির উদ্দিন এর আগে দুর্নীতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চুরি ও শেয়ার জালিয়াতির কারণে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে চাকরি হারান। হোমল্যান্ড লাইফের চাকরি থেকে তাকে অব্যহতি দেয়া হয় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।
অব্যহতি দেয়ায় জহির উদ্দিন হোমল্যান্ড লাইফ থেকে কোন ছাড়াপত্র পাননি। অথচ প্রগ্রেসিভ লাইফে নিয়োগ নেয়ার সময় হোমল্যান্ড লাইফের ছাড়পত্র দাখিল করেন জহির উদ্দিন। অভিযোগ রয়েছে জালিয়াতি করে তৈরি করা ছাড়পত্র দাখিল করেন প্রগ্রেসিভ লাইফে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, জহির উদ্দিনকে দ্রুত অপসারণ করা না হলে কোম্পানিটির ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও পলিসিগ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই কোম্পানিতে এজিএম হচ্ছে না বলেও উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।
অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জহির উদ্দিনের অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চুরি ও শেয়ার জালিয়াতির বিষয়ে মতিঝিল থানায় ২টি মামলা দায়ের করে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এ মামলা ২টি দায়ের করা হয় ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে। বর্তমানে ২টি মামলাই বিচারাধীন রয়েছে।
জহিরের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মামলাটি করা হয় ১৩টি শেয়ার সার্টিফিকেট জালিয়াতি সংক্রান্ত। যার মামলা নং- ১১(০৪)১৭। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জহির উদ্দিনের সহায়তায় হোমল্যান্ড লাইফের ভোল্ট থেকে ১৩টি শেয়ার সার্টিফিকেট চুরি হয়। এর মধ্যে ৪টিতে জাল-জালিয়াতি করে শেয়ারের অংক বসানো হয়।
শেয়ার সার্টিফিকেট চুরি ও জালিয়াতি করে জহির উদ্দিন কোম্পানিটির একজন পরিচালককে সহায়তা করেন। শেয়ার সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তারা উভয়েই লাভবান হন বলেও উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
জহির উদ্দিনের অপর মামলাটি করা হয় ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭০০ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ। মামলা নং ১১ (০১) ১৮। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জহির উদ্দিন হোমল্যান্ড লাইফের আইন কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় কোম্পানির বিভিন্ন মামলার পরিচালনা খরচ বাবদ ২৬ জানুয়ারি ২০১১ সাল থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭০০ টাকা উত্তোলন করে। যেসব মামলা পরিচালনার কথা বলে জহির উদ্দিন টাকা উত্তোলন করে সেসব মামলা নিষ্পত্তি হওয়া ও স্থগিতকৃত। এ ধরণের কর্মকাণ্ডকে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ প্রমাণিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, জহির উদ্দিন প্রগ্রেসিভ লাইফের সিলেট বিভাগের মাসুক মিয়ার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নেন। পরে ধারের টাকা ফেরত চাইলে জহির উদ্দিন মাসুক মিয়াকে পুষিয়ে দেয়ার কথা বলেন। পরবর্তীতে তাকে পুলিশে দেয়ারও হুমকী দেন জহির উদ্দিন।
এছাড়াও জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে হুমকী দেয়ার অভিযোগে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালক হোসনে আরা নাজ। সাধারণ ডায়েরি নং-১৭৪১ তারিখ- ২৫/৯/২০১৭।
এতে বলা হয়, জহির উদ্দিন হোসনে আরা নাজকে আপত্তিকর ভাষায় ধমক, এক সময়ের ছাত্রদল নেতা পরিচয়ে অফিসে এসে আক্রমন ও হোসনে আরা নাজের বাসায় যাওয়ার হুমকি দেন। এ সময়ে জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে করা হোমল্যান্ড লাইফের সকল মামলা তুলে নিতে হোসনে আরা নাজকে হুমকি দেন। ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় মোবাইল ফোনে এসব হুমকী দেন জহির উদ্দিন।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে জহির উদ্দিনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে তিনি ফোন রিসিভ না করায় কথা বলার বিষয় উল্লেখ করে তার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠানো হয়। এ সময় তিনি অভিযোগগুলোকে মিথ্যা, জাল ও উড়ো চিঠি বলে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বার্তা পাঠান।
এসব বিষয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে কথা বলার বিষয় উল্লেখ করে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।