নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর অবৈধ কমিশন দেয়ার নতুন কৌশল

আবদুর রহমান আবির: দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধে বিগত দিনগুলোতে নানান উদ্যোগ নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি অবৈধ কমিশন দিয়ে ব্যবসা সংগ্রহ। বরং নতুন কৌশলে এই অবৈধ কমিশন দিচ্ছে কিছু নন-লাইফ বীমা কোম্পানি।

নন-লাইফ বীমা খাতের কোম্পানিগুলো কান্ট্রি লিমিট ওভার হওয়া বীমা পলিসির ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ফ্যাকাল্টেটিভ পুনর্বীমা প্রিমিয়াম রেইট আনছে এবং সিআরসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী তার সাথে ২০ শতাংশ লোডিং দিয়ে পলিসির প্রিমিয়াম চার্জ করছে । এই চার্জ করা প্রিমিয়ামকে বীমা কোম্পানিগুলো নীট প্রিমিয়াম বলে থাকে । এই প্রিমিয়ামের ওপর এজেন্ট কমিশন দেয়ার কোন সুযোগ নাই । ফলে বীমা গ্রাহককেও কোন কমিশন দিতে হয় না ।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু বীমা কোম্পানি এই চার্জ করা প্রিমিয়ামের ওপর অবৈধভাবে ১৫ শতাংশ এজেন্ট কমিশন ড্র করছে এবং কমিশনের এই টাকা  কোম্পানিগুলো একটি ফান্ডে জমা রাখছে । কোম্পানিগুলো এই টাকা অবৈধ অতিরিক্ত কমিশন হিসেবে দিয়ে  অন্য ব্যবসা সংগ্রহে ব্যয় করছে।

খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এমন তথ্য পেয়েছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে নাম প্রকাশে বারণ করেছেন অভিযোগের বিষয়ে তথ্য প্রদানকারী বীমা কর্মকর্তারা।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি (সিআরসি)’র তথ্য অনুসারে, অগ্নি বীমা পলিসির ক্ষেত্রে বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও নৌ-হাল বীমা পলিসির ক্ষেত্রে বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ৩০ কোটি টাকা এবং নৌ-কার্গো বীমার বর্তমান কান্ট্রি লিমিট ১০০ কোটি টাকা।

নিয়ম অনুসার, নন-লাইফ খাতের কোন বীমা পলিসির বীমা অংক এই কান্ট্রি লিমিট এর বেশি হলে সেই পলিসি বিদেশি কোম্পানিতে ফ্যাকাল্টেটিভ পুনর্বীমা করতে পারবে সংশ্লিষ্ট দেশীয় বীমা কোম্পানি। এক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানি থেকে আনা পুনর্বীমার রেট সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি থেকে ভেটিং বা অনুমোদন করায়ে নিতে হয়।

এক্ষেত্রে আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের নেট রেটের সাথে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত প্রিমিয়াম চার্জ করতে পারে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো। অতিরিক্ত প্রিমিয়ামের এই ২০ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ খরচ হয় পুনর্বীমার প্রিমিয়াম বিদেশে পাঠাতে ট্যাক্স হিসেবে। আর বাকী ১০ শতাংশ খরচ হয় ব্যবস্থাপনায়।

কিন্তু কিছু বীমা কোম্পানি এই ২০ শতাংশের চার্জ করা প্রিমিয়ামের ওপর ১৫ শতাংশ কমিশন চার্জ করে তা  একটি ফান্ডে জমা রাখছে এবং অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে অন্য ব্যবসা সংগ্রহে সেই টাকা ব্যয় করছে, যা আইন অনুসারে অবৈধ। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো পুনর্বীমার খরচের যোগান দিচ্ছে কোম্পানির অন্যান্য পলিসির আয় থেকে। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা খরচ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নন-লাইফ বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহে নির্ধারিত ৩টি ব্যাংক একাউন্টের বাইরে সকল একাউন্ট বন্ধ ঘোষণা করায় অবৈধ কমিশনের উৎস অনেকটাই বন্ধ। তবে নতুন এই পন্থায় ফের অবৈধ কমিশনে ব্যবসা সংগ্রহ করছে খাতটির কিছু কোম্পানি। জনশ্রুতি রয়েছে, অবৈধ কমিশনের এই হার বর্তমানে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে খুব শিগগিরই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করা। যেসব কোম্পানির পলিসির বীমা অংক কান্ট্রি লিমিটের বেশি রয়েছে তাদের কাছ থেকে পলিসিগুলোর তথ্য নিয়ে অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। তা না হলে অবৈধ কমিশনের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়তে থাকবে, যা খাতটিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদ মামুন বলেন, নন-লাইফ খাতে অবৈধ কমিশন একটি বড় সমস্যা। আইডিআরএ’র নানান উদ্যোগের পরও কোন কোন বীমা কোম্পানি অবৈধ কমিশন দিয়ে ব্যবসা করছে- এমন অভিযোগ প্রায়ই আমার কাছে আসে। ধীরে ধীরে অবৈধ কমিশনের এই রেটও এখন বাড়ছে। যেকোনভাবে এটা বন্ধ করা প্রয়োজন।

তবে কান্ট্রি লিমিট ওভার হওয়া বীমা পলিসির ক্ষেত্রে পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের ওপর আবার পনের শতাংশ কমিশন ড্র করার বিষয়টি আমার জানা নেই। এটি একটি জটিল বিষয়। কোন বীমা কোম্পানি এটা করছে- এমন অভিযোগও আমার কাছে আসেনি। কোন কোম্পানি যদি এমনটা করে থাকে সে বিষয়ে আইডিআরএ’কে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, বলেন খালেদ মামুন।

সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামিম বলেন, পুনর্বীমা রেটের ওপর অতিরিক্ত লোড দিয়ে পলিসি ইস্যুর বিষয়টি কখনো আমার কানে আসেনি। তবে কান্ট্রি লিমিট পার না হলেও আইডিআরএ’কে না জানিয়ে বিদেশ থেকে রেট নিয়ে এসে বা পুরনো রেটে পলিসি ইস্যু করছে এমন কথা শুনেছি। এ ধরণের কর্মকাণ্ড যদি সত্যি হয়ে থাকে সেটা আমাদের সবার জন্যই খারাপ কিছু বয়ে আনবে।

এ বিষয়ে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান তারেক বলেন, এরকমটা সাধারণত হওয়ার কথা নয়। বিদেশ থেকে যখন নেট রেট আনা হয় তখন ক্ষেত্র বিশেষে আইডিআরএ অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আরোপের অনুমোদন দেয়। তবে গ্রস রেটের সাথে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আরোপ- সেটা কখনই হওয়ার কথা নয়। কোন কোম্পানি এমনটি করছে কিনা সেটাও আমার জানা নেই।

বিদেশি পুনর্বীমা কোম্পানির দেয়া গ্রস রেটের ওপর অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আরোপের বিষয়টি শুনে ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামিরুল ইসলাম প্রশ্ন ছুড়ে বলেন- এটা কিভাবে সম্ভব! তবে তিনি মিটিংয়ে থাকায় বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।

মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের গ্রস রেটের ওপর কমিশন ড্র বিষয়ে আমি এখন পর্যন্ত কিছু শুনিনি। তবে নন-লাইফ খাতে অবৈধ কমিশন একটি বড় সমস্যা। মার্কেটে চলমান এই অবৈধ কমিশনের কারণে আমাদের কোম্পানির ব্যবসা অনেক কমে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বীমা কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক কোম্পানিই কান্ট্রি লিমিট ওভার হওয়া বীমা পলিসির ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল রেটিং কমিটির নিরধারিত প্রিমিয়ামের ওপর ১৫ শতাংশ কমিশন ড্র করছে এবং কমিশনের এই টাকা  কোম্পানিগুলো একটি ফান্ডে জমা রাখছে । এই ফান্ড থেকে কোম্পানিগুলো অবৈধ অতিরিক্ত কমিশন হিসাবে দিয়ে  অন্য ব্যবসা সংগ্রহে ব্যয় করছে।

তাদের মতে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে কান্ট্রি লিমিট ওভার হওয়া পলিসিগুলোর একটি লিস্ট বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে চাওয়া এবং এর ওপর কমিশন দেয়া হয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া। একইসাথে লিস্ট পাওয়ার পর বীমা কোম্পানিগুলোতে তদন্ত শুরু করা প্রয়োজন।