অনুমোদন ছাড়া ২ কোটি টাকা নিয়েছেন মীর নাজিম
আবদুর রহমান আবির: নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়া ৬ বার বেতন-ভাতা বাড়িয়েছেন ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী মীর নাজিম উদ্দিন। অনুমোদন ছাড়াই টাকা নিয়েছেন ২ কোটির উপরে। ব্যবসা বৃদ্ধি হলে ইনক্রিমেন্ট পাবেন বা পারফর্মেন্স বোনাস পাবেন আইন লংঘন করে এমন চুক্তি করে এই অতিরিক্ত টাকা নেন মীর নাজিম। অথচ অনুমোদন ছাড়া বেতন বৃদ্ধির এই সময়ে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় বাড়লেও অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে কমে গেছে নীট মুনাফা, রিটেইন্ড আর্নিংস। এসব তথ্য উঠে এসেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালায় একজন মুখ্য নির্বাহী বেতনের বাইরে কি ধরনের আর্থিক সুবিধা পাবেন তা নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে চুক্তি করা বা আর্থিক সুবিধা নেয়া অবৈধ। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি।
বীমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়া হয় চুক্তি ভিত্তিক। এই চুক্তি করা হয় সর্বোচ্চ ৩ বছরের জন্য। মুখ্য নির্বাহীর মোট বেতন নির্ধারণ করা হয়- মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ভাতাদির সমন্বয়ে। অন্যান্য ভাতাদি নিতে পারেন ৬টি খাতে। তবে অন্যান্য ভাতাদির এ ৬ খাতে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করতে হয় এবং চুক্তি করতে হয় সুস্পষ্টভাবে। অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে- গাড়ি, জ্বালানী, চালক, ইউটিলিটি বিল, ছুটি ও পরিবহন সহায়তা। এর বাইরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুবিধা যেমন- লভ্যাংশ বা কমিশন নিতে পারবেন না।
অথচ ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী মীর নাজিম উদ্দিন বীমা কোম্পানিটির সাথে যে চুক্তি করেন, তাতে উল্লেখ করা হয়- প্রতি বছর কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির হলে বিশেষ ইনক্রিমেন্ট সুবিধা পাবেন। এই ইনক্রিমেন্ট ১ লাখ টাকার বেশি হবে না। পরে এ চুক্তি সংশোধন করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, মীর নাজিম কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে পারফর্মেন্স বোনাস পাবেন।
মীর নাজিম উদ্দিন ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সে নিয়োগ পান ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ৩ বছরের জন্য। এরপর তার নিয়োগ ২০১৬ সালে নবায়ন করা হয়। এই নবায়নের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় মীর নাজিমকে ২০২০ সালে অপসারণের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এ সময়ে তার নবায়ন নিয়োগ অনুমোদন করা হয় না। পরে ২০২১ সালে অপসারণের সিদ্ধান্ত মার্জনা করে নবায়ন নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। এ নিয়োগ অনুমোদনের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত। প্রতিবার অনুমোদনেই শর্ত দেয়া হয়- অনুমোদন ছাড়া কোন বেতন-ভাতা বাড়ানো যাবে না।
অথচ ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক প্রতিবেদন ও নিয়োগ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মীর নাজিম ২০১৩ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ইনক্রিমেন্ট বাবদ ৬ বার বেতন-ভাতা বাড়ান। প্রতিবারই বেতন-ভাতা বাড়ানো হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া। এভাবে অনুমোদিত বেতন-ভাতার চেয়ে বাড়তি টাকা নেন ২ কোটির উপরে।
চুক্তি অনুসারে মীর নাজিম ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার কথা ব্যবসা বৃদ্ধি হলে। যদিও আইন অনুসারে এ ধরনের চুক্তি অবৈধ। অথচ গেল বছরগুলোতে কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম আয় বাড়লেও রিটেইন্ড আর্নিংস এবং নীট মুনাফা পরিমাণ কমে যায়। একইসাথে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণও বেড়েছে। অর্থাৎ ইনক্রিমেন্টের জন্য কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির যে শর্ত দেয়া হয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রথমবার নিয়োগে মীর নাজিমের বেতন-ভাতা ছিল সর্বসাকুল্যে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি ২০১৩ সালের সেপ্টম্বর থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ মাস বেতন নেন ৩ লাখ টাকা করে। অনুমোদনের বাইরে প্রতি মাসে বেশি বেতন নেন ৬৫ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি বেতন নেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ অনুমোদন ছাড়া বেতন নেন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
আবার ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ মাসে প্রতিমাসে বেতন নেন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ অনুমোদন ছাড়া প্রতি মাসে বেশি বেতন নেন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এই হিসাবে ৩ বছর মেয়াদি প্রথম নিয়োগে অনুমোদন ছাড়া বেতন নেন ৫৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
পরে তার নিয়োগ নবায়ন করা হয় ২০১৬ সালে। এ সময়ে সর্বসাকুল্যে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করা হয়। এই নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৭ মাস বেতন নেন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে। অনুমোদনের বাইরে প্রতি মাসে বেশি বেতন নেন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এরপর ২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১১ মাস বেতন নেন ৫ লাখ টাকা করে। অনুমোদনের বাইরে তিনি প্রতি মাসে বেতন নেন ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে।
২০১৮ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি বেতন নেন ৬ লাখ টাকা করে। এ সময় অনুমোদনের বাইরে প্রতি মাসে বেশি বেতন নেন ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৮ মাস বেতন নেন ৭ লাখ টাকা করে। অর্থাৎ অনুমোদনের বাইরে প্রতি মাসে তিনি অতিরিক্ত বেতন নেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই হিসেবে দ্বিতীয় দফায় ৩ বছরে অনুমোদন ছাড়া বেতন নেন ৭৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
তৃতীয় মেয়াদে তার নবায়ন নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হয় ২০২১ সালের আগস্টে। তবে এই নিয়োগে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত। সর্বসাকুল্যে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৫ লাখ টাকা। এই মেয়াদে মীর নাজিম ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৪ মাস বেতন-ভাতা নিয়েছেন ৭ লাখ টাকা করে। অনুমোদনের বাইরে প্রতি মাসে তিনি ২ লাখ টাকা করে অতিরিক্ত বেতন নেন।
ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বারো মাসে মীর নাজিম সর্বমোট ৯১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন। যার মাসিক গড় দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ ২০২০ সালে মীর নাজিম গড়ে প্রতি মাসে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫০ টাকা করে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা নিয়েছেন।
আবার ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সর্বমোট বেতন-ভাতা নিয়েছেন ৮৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা; যার মাসিক গড় দাঁড়ায় ৭ লাখ ২৭ হাজার ৫শ’ টাকা। অর্থাৎ ২০২১ সালে মীর নাজিম গড়ে প্রতি মাসে ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা নিয়েছেন। এই হিসেবে তৃতীয় দফায় ২ বছর ৪ মাসে মীর নাজিম অনুমোদন ছাড়া বেতন নিয়েছেন ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
মীর নাজিমের বিরুদ্ধে দুদকে যে অভিযোগ:
২০১৯ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র একটি তদন্তে মীর নাজিমসহ কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ১০টি অনিয়ম-জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। যার ভিত্তিতে মীর নাজিমকে অপসারণসহ ৯ লাখ টাকা জরিমানা ও সিটি সেন্টার শাখা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় আইডিআরএ। তবে মীর নাজিমকে অপসারণের ও সিটি সেন্টার শাখা বন্ধের বিষয়টি পরবর্তীতে মার্জনা করে দেয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই মার্জনা করে পরবর্তীতে আর কোন অপরাধ করবেন না এমন মুচলেকা দেয়ায়।
কিন্তু সম্প্রতি আবারও মীর নাজিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এরইমধ্যে অভিযোগটি তদন্ত করতে আইডিআরএ’কে নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত ৯ নভেম্বর দুদক পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’কে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট কয়েকজন বীমা গ্রহীতা সংশ্লিষ্ট নথিপত্রসহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ অভিযোগটি দায়ের করেন। তবে অভিযোগপত্রে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। বীমা গ্রহীতাদের পক্ষে অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে মীর নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বীমা পলিসির নথিপত্র জালিয়াতি; নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জাল-জালিয়াতি; কানাডা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার; সংগৃহীত প্রিমিয়াম গোপন; ভূয়া রিফান্ডে অর্থ আত্মসাৎ; ভ্যাট ফাঁকিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
একইসাথে আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিনের নিয়োগ অনুমোদন দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
অনুমোদনের বাইরে অতিরিক্ত ২ কোটি টাকা নেয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাজিম উদ্দিনের সাথে। বিস্তারিত শোনার পর তিনি বিষয়টি লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। পরে বিষয়টি লিখিত আকারে তার ই-মেইলে পাঠানো হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন বক্তব্য দেননি, এমনকি পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি মীর নাজিম।
এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র বক্তব্য নেয়া চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র না থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।