আইডিআরএ-আইআরএফ সেমিনারের মূল প্রবন্ধ

নন-লাইফ বীমার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১০ সংস্কার প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের নন-লাইফ বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১০টি সংস্কার প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)’র সেক্রেটারি জেনারেল ও সেনা ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম। ‘বীমা খাতের সংস্কার ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে নন-লাইফ বীমা খাত নিয়ে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে তিনি এসব প্রস্তাব দেন।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ও ইন্স্যুরেন্স রিপোর্টার্স ফোরাম (আইআরএফ)’র যৌথ উদ্যোগে গত ১২ মার্চ আইডিআরএ’র বোর্ড রুমে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম। সেমিনারে লাইফ বীমা খাত নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রগতি লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম।

শফিক শামীম বলেন, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বীমা খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আস্থার অভাব, মানবসম্পদের দক্ষতা, পণ্যের বৈচিত্রহীনতা, অনিয়ন্ত্রিত কমিশন, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার যথাযথ তদারকির অভাব ও প্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহার কারণে পিছিয়ে আছে দেশের বীমা খাত। তবে সংস্কারের মাধ্যমেই খাতটি হয়ে উঠতে পারে ব্যাপক সম্ভাবনাময়।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নন-লাইফ বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১০টি সংস্কার প্রস্তাব করেন শফিক শামীম। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে-

এজেন্সি সিস্টেম বাদ দিয়ে শূন্য শতাংশ কমিশন বাস্তবায়ন, দুর্বল কোম্পানিগুলোকে একীভূতকরণ, ব্যাংক ব্যবস্থার সমন্বয়, বীমা পণ্যের ব্যপ্তি ও বৈচিত্র আনয়ন, আস্থাহীনতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারি উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান, বীমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়ন, দক্ষ ও পেশাদার মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তি সহজীকরণ।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা বা অনৈতিক চার্চাকে নন-লাই বীমার বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে শফিক শামীম বলেন, দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তা অনৈতিক চার্চাকে উৎসাহিত করছে। এ খাতের সংস্কারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে একীভূত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং কোম্পানিগুলোর নাম প্রকাশপূর্বক তাদের বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিতে হবে।

নন-লাইফে এজেন্টদের কোন ভূমিকা নেই উল্লেখ করে বিআইএফ সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, এ খাতের এজেন্সি সিস্টেম বাদ দিয়ে শূন্য শতাংশ কমিশন বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে কমিশন প্রথার অপব্যবহার দূর করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এবং বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। গ্রাহকদের হাতে কমিশন যাওয়া বন্ধের দাবিও জানান তিনি।

ব্যাংকগুলোর কাছে দেশের নন-লাইফ বীমা খাত জিম্মি উল্লেখ করে ব্যাংক ব্যবস্থার সমন্বয় করার প্রস্তাব করেন শফিক শামীম। তিনি বলেন, অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে এ খাতে অবৈধভাবে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন লেনদেন হয়। যা এজেন্টের বদলে চলে যায় ব্যাংকারদের পকেটে। এক্ষেত্রে আইডিআরএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এবং তালিকাভুক্ত সকল ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলো যাতে একই ডিজিটাল প্লাটফর্মে (ডাটাবেজ-এ) কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান তিনি।

বীমা পণ্যের ব্যপ্তি ও বৈচিত্র আনয়নের প্রস্তাব করেন শফিক শামীম। তিনি বলেন, বীমা সেবা সরবরাহের ব্যপ্তি বা বৈচিত্র না থাকায় বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে সবাই একই পণ্য নিয়ে একই জায়গায় প্রতিযোগিতা করছে। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষের প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিয়ে কাস্টমাইজ বীমা পণ্য বাজারে আনতে হবে।এক্ষেত্রে শরিয়া ভিত্তিক বীমা পণ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিশেষায়িত বীমা পণ্য, পেশা বা উৎপাদনের খাত ভিত্তিক বীমা পণ্য চালু করতে হবে।

বিআইএফ সেক্রেটারি জেনারেল শফিক শামীম বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পেশাদারিত্বের অভাব ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে বীমা খাতের প্রতি জনআস্থা বাড়েনি, বরং কমেছে। এই আস্থাহীনতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, বীমার পেনিট্রেশন বাড়াতে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সকল বীমাকারীকে একসাথে মার্কেটিং এবং শিক্ষামূলক উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়া, স্কুল-কলেজ এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জনসাধারণকে বীমা সুবিধা সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে। বীমা অর্থ সুরক্ষা- এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে।

বীমা খাতের বিকাশে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছেন শফিক শামীম। তিনি বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তিগত সুবিধা নিতে হবে এবং স্মার্ট পরিষেবাগুলোর মাধ্যমে প্রচলিত ব্যবসায়িক ধরণ ও প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে হবে। স্মার্ট পদ্ধতির সঙ্গে প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ব্যাপক সুরক্ষা দিতে পারে বীমা। একইসঙ্গে বীমা সেবার পথ প্রশারিত হবে এবং প্রশমিত হবে এ খাতের অনৈতিক চর্চার পথ।

সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের অন্য অংশের চেয়ে বীমা খাত পিছিয়ে থাকার অন্যতম মূল কারণ হলো- এ খাতে সরকারে যথেষ্ট পরিমাণ মনোযোগের অভাব, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং এ খাতের উন্নয়নের জন্য বাস্তবসম্মত নীতিমালার অভাব। এক্ষেত্রে বীমা খাতের উন্নয়নে আর্থিক সমন্বয়, গবেষণা ও বাধ্যতামূলক বীমার পরিধি বৃদ্ধিতে সরকারি উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন বিআইএফ সেক্রেটারি জেনারেল শফিক শামীম।

নন-লাইফ বীমা খাতের সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম আরেকটি প্রস্তাব হলো- বীমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায়ন। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বীমা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সংগঠিত ও নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা প্রদান করা গেলে অবৈধ কমিশন বাণিজ্য, সঠিক সময় গ্রাহকদের বীমা দাবি পূরণ এবং করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে বলে মন্তব্য করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামীম।

বীমা খাতে দক্ষ ও পেশাদার মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেন শফিক শামীম। তিনি বলেন, এ খাতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বীমা কোম্পানিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রথমে এ খাতের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করতে হবে। দেশের অন্যান্য আর্থিক খাতের ন্যায় এ খাতে কর্মরত মানুষের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, নিম্ন বেতন কাঠামোর কারণে এ খাতে মেধাবীরা কাজ করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে হবে, যা নিম্ন বেতন কাঠামোর লোকজনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সামাজিক ও আর্থিকভাবে এ খাতের লোকজন পিছিয়ে রয়েছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

‘বীমা খাতের সংস্কার ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে নন-লাইফ বীমা খাতের পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তি সহজ করার প্রস্তাব করেন শফিক শামীম। তিনি বলেন, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব নন-লাইফ ও পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের অমীমাংসিত দাবির বেশিরভাগই পুনর্বীমা দাবি। গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় নথি ও তথ্য সরবরাহে ঘাটতি এবং করপোরেশনের সহায়তার অভাবে দাবিগুলো সময়মতো নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।  

এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে সাধারণ বীমা করপোরেশনের জনশক্তির মান ও পরিচালন দুর্বলতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারি বেসরকারি সকল কোম্পানিকে সমতার সাথে পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়াও পুনর্বীমা দাবি পরিশোধে গ্রাহকের কাছ থেকে কি কি নথি ও তথ্য নিতে হবে তার চেকলিস্ট প্রদান করতে হবে। তবে চেকলিস্টে এমন কোন নথি বা তথ্য রাখা যাবে না যা গ্রাহকের পক্ষে সংগ্রহ করা কঠিন। তাহলে গ্রাহকদের বীমা দাবি যথা সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে এবং এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।