লাইফ বীমা খাতের উন্নয়নে বাজেটে ৭ প্রস্তাব বিআইএ’র
নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে দেশের লাইফ বীমা শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ৭টি প্রস্তাব করেছে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)। সোমবার (১৭ মার্চ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের কাছে লিখিতভাবে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ।
বাজেটে লাইফ বীমা খাত নিয়ে বিআইএ’র প্রস্তবনার মধ্যে রয়েছে-
লাইফ বীমা পলিসির ডিপোজিট হোন্ডারদের জমাকৃত প্রিমিয়ামের অতিরিক্ত টাকার ওপর ৫% হারে কর প্রত্যাহার:
বিআইএ’র চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইন ২০২৩ এর ৯৯ ধারা অনুযায়ী দেশের সকল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ডিপোজিট হোল্ডারদের মুনাফার ওপর ৫% হারে কর আরোপ করার ফলে দেশের সকল লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর ডিপোজিট পলিসি হোল্ডারদের সংখ্যা কমে গেছে। গ্রাম-গঞ্জের ক্ষুদ্র পলিসি হোল্ডারদের ঝুঁকির বিষয় ও ডিপোজিটের মুনাফার সম্বন্ধে সুবিধার কথা বুঝিয়ে তারপর ডিপোজিট সংক্রান্ত পলিসি বিক্রি করা হয়। ক্ষুদ্র পলিসি হোন্ডাদের মুনাফার ওপর ৫% হারে করের যে বিধান চালু করা হয়েছে তা যদি উঠিয়ে নেয়া না হয় তাহলে দেশে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসা ২০১৪ সালের মত প্রতিনিয়ত কমতে থাকবে এবং কোম্পানিগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হবে। পাশাপাশি দেশে ক্ষুদ্র পলিসি হোল্ডাররা সামাজিক সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ৫% হারে কর প্রত্যাহার করা জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির জন্য করপোরেট কর হার ২৫% করার প্রস্তাব:
বিআইএ বলছে, বর্তমানে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংক, সিগারেট, বিড়ি ও মোবাইল অপারেটর ব্যতীত সকল পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ২৫% হারে কর দিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কারণে প্রচুর আয় করে থাকে। বীমা কোম্পানির পক্ষে অত্যাধিক আয় করা দুরুহ। দেশের অর্থনৈতিক অবদানে বীমার ভূমিকা যথেষ্ট কিন্তু বিভিন্ন কারণে বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। সুতরাং বীমা কোম্পানির আয়ের ওপর কর হায় ৩৭.৫% এর পরিবর্তে ২৫% করার প্রস্তাব করছি।
পুনর্বীমা কমিশনের ওপর ১৫% উৎসে মূল্য সংযোজন কর আদায় বন্ধের প্রস্তাব:
বিআইএ বলছে, বীমা আইন ২০১০ এবং বীমা বিধিমালা, ১৯৫৮ এর অধীনে বীমা সেবা প্রদানের লক্ষে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১ এর ৬ ধারা এবং দৃশ্য সংযোজন কর বিধিমালা এর বিধি ১৮(ক), বিধি (খ) সহ প্রচলিত অন্যান্য সকল আইনের বিধান অনুযায়ী উৎসে কর কর্তনযোগ্য সকল প্রকার মূসক কর্তন করে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে মূসক প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের কমিশনের উপর মূসক প্রযোজ্য নয়। বীমা কোম্পানি প্রিমিয়াম গ্রহণের সময় গ্রাহকের নিকট থেকে ১৫% হারে মূসক গ্রহণ করে তা সরকারী কোষাগারে জমা প্রদান করে থাকে। বীমা কোম্পানি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এই প্রিমিয়ামের একটি অংশ পুনর্বীমাকারীকে প্রদান করে পুনর্বীমা গ্রহণ করে থাকে। যেহেতু প্রিমিয়াম গ্রহণকালে সম্পূর্ণ প্রিমিয়ামের ওপর আইন অনুযায়ী মুসক গ্রহণ করে সরকারী কোষাগারে জমা করা হয় এবং এই প্রিমিয়ামের একটি অংশ পুনর্বীমাকারীকে প্রদান করা হয়, সেহেতু পুনর্বীমা প্রিমিয়ামের কমিশনের ওপর ১৫% ভ্যাট আরোপের সুযোগ নাই। এ ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে তা যৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে। তাছারা পুনর্বীমা কমিশন বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণীতে আয় হিসেবে দেখানো হয় এবং কোম্পানিগুলো লাভের ওপর আয়কর এ প্রদান করে।
স্বাস্থ্য বীমায় ওপর থেকে কর কর্তন রহিত করার প্রস্তাব:
এ বিষয়ে বিআইএ’র চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রচলিত বীমা আইনে লাইফ বীমা পলিসির প্রিমিয়ামের ওপর কোন ভ্যাট প্রদান করতে হয় না। তবে কেউ এককভাবে স্বাস্থ্য বীমা করলে ১৫% ভ্যাট প্রদান করতে হয়। আবার কোন বীমা গ্রহীতা লাইফ বীমার সাথে স্বাস্থ্য বীমা যুক্ত করে পলিসি করলেও ১৫% ভ্যাট প্রদান করতে হয় এবং এতে করে প্রিমিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে গ্রাহক স্বাস্থ্য বীমা করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সে কারণে স্বাস্থ্য বীমা প্রসারের জন্য এই বীমার ওপর কর রহিত করার জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে।
বীমা এজেন্টদের কমিশন আয়ের ওপর উৎসে কর কর্তন অব্যাহতির প্রস্তাব:
আয়কর আইনের ধারা ১০০ অনুযায়ী বীমা শিল্পে কর্মরত এজেন্টদের ক্ষেত্রে প্রাপ্য কমিশনের পরিমান নির্বিশেষে ৫% হারে উৎসে কর কর্তন করার বিধান রয়েছে। পক্ষান্তরে, বিদ্যমান আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে কর মুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ প্রেক্ষিতে বীমা শিল্পে কর্মরত স্বল্প আয়ের এজেন্টদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের ন্যায় নূন্যতম করমুক্ত আয় সীমা পর্যন্ত উৎসে কর কর্তন থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
লাইফ বীমা ব্যবসায় নবায়ন প্রিমিয়ামের ওপর অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত প্রস্তাব:
এ বিষয়ে বিআইএ বলছে, আয়কর আইন ২০২০ এর চতুর্থ রজনিশের ধারা ৪৭. ২(ঈ) অনুযায়ী নবায়ন প্রিমিয়ামের ওপর অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ১২%। পক্ষান্তরে, বীমা আইন, ২০১০ এবং বিধি ২০২০ অনুসারে অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ১৫%। লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো ইন্স্যুরেন্স আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্বাহ করে। আয়কর নিরুপনের সময় আয়কর কর্তৃপক্ষ আয়কর আইন অনুযায়ী খরচ নিরুপন করে বিধায় লাইফ বীমা কোম্পানির করদায় বেড়ে যায়।
ফলশ্রুতিতে গ্রাহকের বোনাস কমে যায় এবং গ্রাহক নতুন বীমা করতে নিরুৎসাহিত হয়। এর ফলে লাইফ বীমা ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং জাতীয় সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বীমা আইন অনুযায়ী আয়কর আইনের উল্লেখিত ধারায় সামঞ্জস্য আনা যুক্তিযুক্ত।
উৎসে ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব:
অডিট ফি, লিগ্যাল ফি, অ্যাকচুয়ারি ফি, কন্সালটেন্ট ফি ইত্যাদির ওপর ১৫% হারে ভ্যাট রয়েছে। যা সেবা গ্রহণকারী অর্থাৎ কোম্পানির ওপর বর্তায় এবং কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। মূলত উক্ত ভ্যাট দরিদ্র পলিসি হোন্ডারদের প্রিমিয়াম হতে প্রদান করতে হয়। তাই উক্ত ভ্যাট ৫% এ নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়াও বাড়ি ভাড়া, ওয়ার্কশপ, যে কোন ক্রয়, ছাপা খানা ইত্যাদির ওপরও ১৫% হারে ভ্যাট রয়েছে। যা মূলত দরিদ্র বীমা গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা থেকে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রেও উপরোক্ত খাতের ভ্যাটের হার কমানো উচিত।