নন-লাইফে কমিশন শূন্য শতাংশ ও এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিত করার সিদ্ধান্ত বেআইনী

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন অনুসারে ব্যক্তি এজেন্ট নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক। অপরদিকে এজেন্ট ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তি বীমা ব্যবসা সংগ্রহ করতে পারে না। এ ছাড়াও লাইসেন্সধারী এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিকে কমিশন বা অন্যকোন পারিশ্রমিক দেয়ারও কোন বিধান নেই বীমা আইনে।
অথচ এই আইন লঙ্ঘন করে এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশ করার প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) । বিআইএ’র এই বেআইনী প্রস্তাবনা মেনে নিয়ে এজেন্ট কমিশন শূন্য ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ।
এখানেই শেষ নয়, এজেন্ট কমিশন শূন্য ঘোষণা করার আগে এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিত করার প্রস্তাবনা চেয়ে সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই প্রস্তাবনা দেয়ার সময় বেধে দেয়া হয়েছে আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ এজেন্ট লাইসেন্স "স্থগিত" করার কোন বিধান নেই বীমা আইন ও প্রবিধানে।
গত (১ ডিসেম্বর) এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
সূত্র মতে, গত ১৮ নভেম্বর বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ আইডিআরএ’কে পাঠানো এক চিঠিতে ব্যক্তি এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশ করার অনুরোধ জানান। ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ওই চিঠিতে তিনি দাবি করেন- “নন-লাইফ বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাগণ এক যৌথ সভায় এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশ করার বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।”
তবে খাত সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, তার এই দাবি সঠিক নয়। এই চিঠির কপিও নির্বাহী কমিটির কোন সদস্য এবং কোন কোম্পানিকে দেয়া হয়নি। এমনকি অফিস কপিও রাখা হয়নি।
এর ৭ দিন পরে বিআইএ ও সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীদের সাথে আইডিআরএ’র অনুষ্ঠিত সভায় এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশ করার সিদ্ধান্ত আইনের তোয়াক্কা না করে অনেকটা চাপিয়েই দেয়া হয়।
আইডিআরএ’র পাঠানো চিঠিতে তিনটি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়-
সকল নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিত করার জন্য আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রস্তাবনা প্রেরণ করতে হবে। উক্ত প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হতে নন-লাইফ বীমা খাতে ব্যক্তি এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পরবর্তীতে কোন নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এজেন্ট কমিশনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লংঘন করা হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করা হবে। এছাড়া সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের লোকবলের সংকট থাকায় উল্লিখিত মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন কর্তৃক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন একটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করতে হবে।
কোন নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যক্তি এজেন্ট কমিশন ০% শতাংশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লংঘন করলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের ভিজিলেন্স টিম কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরবর্তীতে বিষয়টি যাচাইয়ান্তে বীমা আইন ২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু বীমা আইন ২০১০ এবং বীমা এজেন্ট নিয়োগ, নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রবিধানমালা–২০২১ অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত কতটা আইনসম্মত- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, আইডিআরএ নন-লাইফ বীমায় কমিশন শূন্য শতাংশ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বীমা আইন ২০১০ এবং এজেন্ট লাইসেন্স প্রবিধানমালা, ২০২১ -দুটোর সাথেই সাংঘর্ষিক। প্রক্রিয়াগতভাবে আইন পরিবর্তন ছাড়াই কমিশন শূন্য করার নির্দেশ ও কোম্পানিকে এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিতের “নির্দেশক্রমে অনুরোধ” করা বেআইনি । এই সিদ্ধান্ত বীমা খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
বিআইএ এই ধরনের ভিজিলেন্স টিম গঠন করতে পারে কিনা, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এজেন্ট কমিশন শূন্য শতাংশ: যা বলছে আইন
বীমা আইন, ২০১০-এ এজেন্ট কমিশন কাঠামো নির্ধারণ করার ক্ষমতা আইডিআরএ’কে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কমিশন সম্পূর্ণ শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা অযৌক্তিক । এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আইন সংশোধন ছাড়া শুধুমাত্র সভার সিদ্ধান্ত বা প্রশাসনিক চিঠির মাধ্যমে কার্যকর করা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
আইনের ১২৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, “একজন বীমাকারী বা ব্রোকার একজন ব্যক্তি বীমা এজেন্ট নিয়োগ ও তাহার নিবন্ধীকরণ করিবে এবং প্রত্যেক বীমাকারী বা ব্রোকার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বীমা এজেন্ট হিসাবে অনুরূপ সকল নিয়োগ ও নিবন্ধনের একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ করিবে৷”
অপরদিকে বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বীমা এজেন্ট বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা ব্রোকার ব্যতীত অন্য কাহাকে কমিশন বা অন্য কোন নামে কোন পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক পরিশোধ করিবে না বা প্রদান করার জন্য কোন চুক্তি করিবে না৷”
বীমা এজেন্ট নিয়োগ, নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রবিধানমালা ২০২১ অনুযায়ী- আইডিআরএ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে , স্থগিত করতে পারে না। আর কোনো কোম্পানির এজেন্টের লাইসেন্স স্থগিত করার প্রস্তাব পাঠানোর অধিকার নেই । ফলে আইডিআরএ’র চিঠিতে কোম্পানিকে যে প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলা হয়েছে, তা প্রবিধানমালার লঙ্ঘন।
আইডিআরএ’র তথ্য মতে, দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে ব্যবসা পরিচালনা করছে ৪৬টি কোম্পানি। ২০২৩ সালের হিসাবে এসব কোম্পানিতে ২ হাজার ৩৬৫ জন এজেন্ট কমিশন ভিত্তিতে বীমা ব্যবসা সংগ্রহণ করছেন। বর্তমানে কোম্পানিগুলো এজেন্টদের প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন দিয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে এজেন্ট কমিশন শূন্য করা হলে- বীমা এজেন্টদের পেশা বিলুপ্তি ঘটবে। বড় সংকট দেখা দিতে পারে নন-লাইফ বীমার প্রিমিয়াম সংগ্রহে। প্রিমিয়াম ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে । এ ছাড়াও দেশের বীমা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব যেমন পড়বে তেমনি মোটা অংকের রাজস্ব হারাবে রাষ্ট্র।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২১ সালের ১ মার্চ থেকে নন-লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট কমিশন বন্ধ ঘোষণা করেছিল এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। পরবর্তীতে ২০২২ সালে পুনরায় চালু করা হয় এজেন্ট কমিশন।




