সাড়ে ১৪ কোটি টাকার জমিতে বালু ফেলতেই খরচ ১৪২ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১৩ সালে মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়িতে সাড়ে ১৪ কোটি টাকায় ৭৬৩.৪৮২ শতাংশ জমি যৌথভাবে কেনা হয় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে। আর সেই জমিতে বালু ফেলাসহ উন্নয়ন খরচ বাবদ ১৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জমির দামের ১০ গুণের বেশি বালু ফেলার অবিশ্বাস্য খরচ দেখিয়েছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
এখানেই শেষ নয়, জমির রেজিষ্ট্রেশন খরচ ২ কোটি টাকার জায়গায় বিবিধ খরচ দেখিয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে কো-অপারেটিভের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের নামে সাফ কবলা রেজিষ্ট্রি নিয়ে আরও একশ’ কোটি টাকা কোম্পানি থেকে বের করে নিয়েছে। আর বিনিয়োগের নামে লাইফ ফান্ডের টাকা হাতিয়ে নিতে দফায় দফায় বোর্ড সভার মাইনটস বা রেজুলেশন জালিয়াতি, নগদে শত শত কোটি টাকা লেনদেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র অনুমতির তোয়াক্কা না করাসহ গুরুতর সব জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বীমা কোম্পানিটি।
ফারইষ্টের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও বীমা কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ যোগসাজসে এই টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগটি বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অর্থমন্ত্রণালয়ে দায়ের করেন এক শেয়ার হোল্ডার। মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়ির জমি কেনার নামে ২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য ও প্রমাণ মিলেছে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র অনুসন্ধানে।
জমি ক্রয়ের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে কোম্পানিটি নগদে লেনদেন, বোর্ডসভার কার্যবিবরনীর জালিয়াতি, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের আগেই জমি ক্রয় ও আর্থিক প্রতিবেদনে গোঁজামিল দিয়ে হিসাব প্রদর্শনের মত অনিয়ম দুর্নীতি ও জালিয়াতির পাশাপাশি আশ্রয় নিয়েছে নানা কৌশলের। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অনিয়ম জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
জমি কেনা ও উন্নয়নের নামে ১৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা ও কৌশলে শত কোটি টাকা দাম বাড়িয়ে তহবিল আত্মাসাতের ঘটনার তদন্তে নামে আইডিআরএ। তবে অদৃশ্য কারণে দুর্নীতি ও অনিয়মের কোনো প্রমাণ পায়নি আইডিআরএ’র গঠিত তদন্ত দল। যদিও অবিশ্বাস্য এই খরচকে ‘সামান্য বেশি’(!) বলে মন্তব্য করেছে আইডিআরএ’র তদন্ত দল। এছাড়া অভিযুক্তদের কোনো দোষও পায়নি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণক সংস্থা গঠিত তদন্ত দল। অনুসন্ধানের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়:
মিরপুরের বেরিবাঁদের পূর্বপাশে গোড়ান চাটবাড়িতে এ জমি কেনা হয় ২০১৩ সালের মে থেকে অক্টোবর মাসে। সাড়ে ১৪ কোটি টাকায় মোট জমি দেখানো হয় ৭৬৩ শতাংশ। সেই হিসেবে রেজিষ্ট্রেশন খরচ ছাড়াই প্রতি শতক জমির দাম পড়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮৯ টাকা। আর সেই জমিতে বালু ফেলার খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি টাকা, প্রতি শতক খরচ পড়ে ১৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮২৯ টাকা। যা জমির দামের দশগুণের বেশি! এ যেন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় বা ১২ হাত বাকুড়ের ১৩ হাত বিচি প্রবাদ বাক্যকেও হার মানিয়েছে বীমা কোম্পানীটি!
জমি কিনতে কৌশলের আশ্রয় নেয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জমি কিনতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। কোম্পানির নামে জমি কিনতে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের আইডিআরএ’র অনুমোদন নিতে হয়। তাই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ঝামেলা এড়াতে জমি কিনতে রাতারাতি গঠন করা হয় সোসাইটি। আবার সেই সোসাইটির নামে কোম্পানির তহবিল থেকে ঋণ অনুমোদন করে কেনা হয় জমি।
তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালের ১ জুলাইয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ১৬৯তম বোর্ড সভায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড গঠন ও নিবন্ধন নেয়ার এবং এই সোসাইটির নামে মিরপুর গোড়ানে জমি কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বোর্ড সভা।
এরপর ২০১৩ সালের মে, জুন, আগষ্ট সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এবং ২০১৪ সালের এপ্রিল মে ও জুলাই মাসে মিরপুর গোড়ান চটবাড়িতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও প্রাইম ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে যৌথভাবে ৭৩৯ শতাংশ জমি কেনা হয়। সাব-কবলা দলিলের তথ্য অনুসারে জমির দাম ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৭৫০ টাকায়। ২৬টি সাব-কবলা দলিলে জমির রেজিস্ট্রি করা হয়। শুধু তাই নয়, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে জমি কেনা হলেও উন্নয়নের এ ব্যয় করা হয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে। বীমা আইন ২০১০ অনুযায়ী, কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কর্মীদের প্রভিডেন্ড ফান্ড ও গ্র্যাচুয়িটির অর্জিত টাকার বিপরীতে কেবল ঋণ দিতে পারে। অন্য কোন কোম্পানি ও কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই।
জমির দাম সাড়ে ১৪ কোটি, অতিরিক্ত খরচ ২১৪ কোটি
দলিলের তথ্য অনুসারে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ সোসাইটির নামে কেনা হয় ৭৩৯ শতাংশ জমি। জমির মোট দাম উল্লেখ করা হয় ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৭৫০ টাকা।
অথচ জমি ক্রয়ে মোট খরচ দেখানো হয় ২২৯ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। জমির পরিমাণ ৭৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে-জমি কিনতে অতিরিক্ত খরচ ও উন্নয়ন খরচ দেখানো হয় ২১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫০ টাকা। বাকি ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা জমির ডিড ভ্যালু। জমি ক্রয়ের এ হিসাব দেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রধান হেমায়েত উল্লাহ। জমি ক্রয়ের হিসাবের এ নোটে হেমায়েত উল্লাহ স্বাক্ষর করে ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।
জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ ২ কোটি টাকা, খরচ হয়ে গেছে ৭০ কোটি
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জমি ক্রয়ের রেজিস্ট্রেশন খরচ দেখিয়েও তহবিল থেকে নেয়া হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির জমি ক্রয়ে ব্যয় সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ স্বাক্ষরিত জমি ক্রয়ে ব্যয় সংক্রান্ত ওই নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জমি ক্রয়ে মোট খরচ দেখানো হয় ২২৯ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে দলিল মূল্য ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা। বাকি ২১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫০ টাকা জমি ক্রয়ের অতিরিক্ত খরচ। যার মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্রেশন খরচও ।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত দলের কাছে জমির উন্নয়নে ১৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জবান বন্দিতে উল্লেখ করেন হেমায়েত উল্লাহ। এই হিসেবে অতিরিক্ত খরচ থেকে উন্নয়ন খরচ থেকে বাদ দিলে যে টাকা থাকে তা রেজিস্ট্রেশন বাবদ খরচ করা হয়েছে। অর্থাৎ জমি ক্রয়ে রেজিস্ট্রেশন খরচ দেখানো হয়েছে ৭১ কোটি ৯৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫০ টাকা।
অথচ ক্রয়ের অন্যান্য নথিতে রেজিস্ট্রেশন খরচ ধরা হয়েছে দলিল মূল্যের ওপর সাড়ে ১১ শতাংশ। এ হিসাবে ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা দলিল মূল্যের ওপর রেজিস্ট্রেশন খরচ হয় ১ কোটি ৭০ লাখ ৩৫ হাজার ১৫১ টাকা। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি দেখিয়েছে ৭০ কোটি ২২ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮ টাকা।
জমি কিনেছে প্রাইম, টাকা দিয়েছে ফারইষ্ট
জমি ক্রয়ের ব্যয় সংক্রান্ত ২০১৬ সালের ওই নথির তথ্য অনুসারে, জমি ক্রয়ে অতিরিক্ত খরচ ২১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫০ টাকা। এই টাকা দুই কোম্পানি অর্থাৎ ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ও প্রাইম ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভের সমানভাবে ব্যয় করার কথা। এতে প্রতিটি কোম্পানির কো-অপারেটিভের ভাগে পড়ে ১০৭ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার ১২৫ টাকা। কিন্তু ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত খাতে ব্যয় করেছে ১৭৮ কোটি ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৭ টাকা।
অপর দিকে প্রাইম ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে অতিরিক্ত ব্যয়ের খাতে ১০৭ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার ১২৫ টাকা ব্যয়ের কথা থাকলেও ব্যয় করেছে ৩৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৪ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এই হিসেবে অতিরিক্ত ব্যয়ের বাকি ৭১ কোটি ১৪ লাখ ৩৩২ টাকা ব্যয় করা হয়েছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে। যা প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের কাছে পাওনা।
অপর দিকে জমি ক্রয়ের জন্য প্রাইম ইসলামী লাইফকে ঋণ দিয়েছে এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই ২০১৬ সালের ফারইষ্টের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে। অথচ নথি অনুসারে ঋণ দেয়া হয়েছে ২০১৬ সালেই। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে প্রতিটি আয়-ব্যয়ের তথ্য দেয়া বাধ্যতামূলক। এমনকী জমি ক্রয়-বিক্রয়সহ যে কোন প্রাইস সেনসেটিভ তথ্য জানাতে হয় ষ্টক এক্সচেঞ্জ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বরাবর। কোন ধরনের তথ্য গোপন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
৫ কোটি টাকার জমি দিয়ে ৫০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ
গোড়ান চাটবাড়ির জমি কিনতে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ গঠন করে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি। এই সোসাইটিকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে। এ সিদ্ধান্ত ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পরিষদের ২০১৩ সালের ১ জুলাই ১৬৯তম বোর্ড সভায়। কিন্তু একটি এমপ্লোয়ীজ সোসাইটি খুলে তার নামে ঋণ দিতে আইনগত বাধা রয়েছে। তাই এই টাকা সোসাইটির কাছে ফেরত চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ২০১৪ সালে ৪ জুন অনুষ্ঠিত ১৭৯তম বোর্ড সভায়। অর্থাৎ ঋণ দেয়ার এক বছরের মাথায় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ কর্তৃপক্ষের মনে হয় যেভাবে সোসাইটিকে ঋণ দেয়া হয়েছে তা বৈধ নয়।
সোসাইটিকে ঋণ দেয়া আইন সঙ্গত নয়, এ মতামত দেন কোম্পানির আইন উপদেষ্টা আইনজীবী ব্যরিষ্টার এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক। এ মতামতের উপর ভিত্তি করে সোসাইটির কাছে ঋণের ৫০ কোটি টাকা ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ।
বোর্ড সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, সিদ্ধান্ত অনুসারে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটির কাছে ঋণের টাকা ফেরত চাইলে তারা ঋণের টাকা ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। অন্যদিকে অন্যত্র জমি বিক্রি করতে পারছে না। ফলে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য সোসাইটির নামে কেনা গোড়ান চাটবাড়ির ৩৮১ শতাংশ জমি ফারইস্ট ইসলামী লাইফকে সাব-কবলা রেজিস্ট্রি দেয়।
উল্লেখ্য ফারইস্ট ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়ায় তিনি নিজে কোম্পানির নিয়মিত কর্মীদের নামে গঠিত কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রধান হওয়ার সুযোগ নেই আইন অনুযায়ী।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৩৮১ শতাংশ জমি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফকে সাব-কবলা রেজিস্ট্রি দলিলে জমির মুল্য ধরা হয় ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। অথচ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ফারইষ্ট লাইফ ঋণ দেয়া ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা জমির বদলে সোসাইটির ৫০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করে। ৮টি দলিলে এ জমির রেজিস্ট্রি করা হয় ১৫ মে ২০১৬ সালে। প্রশ্ন উঠেছ গ্রাহকের লাইফ ফান্ড থেকে দেয়া ঋণের বাকি ৪৬ কোটি টাকা গেল কোথায়?
৭১ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধে প্রাইমের জমি গেল ২৩৭ শতাংশ
অন্যদিকে জমি কেনার অতিরিক্ত খরচ বাবদ প্রাইম ইসলামী লাইফের অংশ ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা পরিশোধে প্রাইম ইসলামী লাইফকে লিখে দিতে হয় ২৩৭ শতাংশ জমি। দলিলে এ জমির মূল্য ধরা হয় ৭১ কোটি ১৫ লাখ। অর্থাৎ প্রতি শতাংশ প্রায় ৩০ লাখ টাকা! প্রাইম ইসলামী লাইফ এ জমির রেজিস্ট্রি করে দেয় ২০১৮ সালে ২৫ ও ২৮ অক্টোবর।
জমির দাম ৮৬ কোটি, দেখানো হয়েছে ১৮৬ কোটি: ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নামে জমি রেজিস্ট্রি
জমির সাব কবলা দলিলে তথ্য অনুসারে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নামে মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়িতে মোট জমি কিনেছে ৬২৮ শতাংশ। এর মধ্যে-ফারইষ্ট এমপ্লয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে জমি কিনেছে ৩৮১ শতাংশ। জমির মোট দাম পড়েছে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। অর্থাৎ শতাংশ প্রতি জমির দাম ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৪ টাকা। ৮টি দলিলে এই জমির সাব-কবলা রেজিস্ট্রি করা হয় ২০১৬ সালে ১৫ মে।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছ থেকে ২৩৭.১৫ শতাংশ জমির সাব-কবলা রেজিস্ট্রি নেয়া হয় ২০১৮ সালের ২৫ ও ২৮ অক্টোবর। জমির মোট দাম ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। শতাংশ প্রতি দাম ৩০ লাখ টাকা ২১০ টাকা।
জামাল রাশেদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কেনা হয় ১ কোটি টাকায়। শতাংশ প্রতি জমির দাম পরে ১০ লাখ টাকা। সাব কবলা রেজিস্ট্রি করা হয় ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।
সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এম তাজুল ইসলামের কাছ থেকে ১২ শতাংশ জমি কিনে নেয় ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকায়। শতাংশ জমির দাম ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ জমির সাব-কবলা রেজিস্ট্রি করা হয় ২০১৬ সালে ১৪ আগস্ট।
উপরে উল্লেখিত ৬২৮ শতাংশ জমি ক্রয়ে খরচ হয় ৭৭ কোটি ২৯ লাখ ১ হাজার টাকা। সাড়ে ১১ শতাংশ হারে রেজিস্ট্রেশন খরচ আসে ৮ কোটি ৮৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৫ টাকা। সে হিসেবে রেজিস্ট্রেশন খরচসহ জমি ক্রয়ে মোট খরচ হয় ৮৬ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমির দাম পড়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৩০৯ টাকা।
অথচ মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়িতে সেই ৬২৮ শতাংশ জমি ক্রয়ে খরচ দেখানো হয়েছে ১৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমির দাম দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। গোড়ান চাটবাড়িতে জমি ক্রয়ে ব্যয়ের এ হিসাব দেখানো হয় ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নামে কেনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমি ও ফ্লাট ক্রয়ের ব্যয় সংক্রান্ত এক নথিতে। এ নথিতে স্বাক্ষর করেন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফের এসইভিপি ও প্রজেক্ট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার আমির এম ইব্রাহীম পিইএনজি।
জমির মূল্য বাড়াতে ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড রিয়েল এস্টেট সাব কমিটির সভার কার্যবিবরনী জালিয়াতি
জমি ক্রয়ে প্রকৃত ব্যয় গোপন করে ক্রয় ব্যয় বেশি দেখিয়ে তা ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বোর্ড সভা ও সাব কমিটির সভায় অনুমোদন দেখাতে দফায় দফায় জালিয়াতি করে পরিবর্তন করা হয় কার্যবিবরনী।
মিরপুরের গোড়ান চটবাড়িতে জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয় ১৮ জুন ২০১৩ সালে ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড রিয়েল এ্যস্টেট ডেভলপমেন্ট সাব কমিটির ২৩২তম সভায়। এ সভায় জমির পরিমাণ বলা হয় ২৫ বিঘা। জমির দাম উল্লেখ করা হয় প্রতি কাঠা ১৮ লাখ টাকা। এই হিসেবে মোট জমির দাম ৯০ কোটি টাকা। ওই সভার কার্যবিবরনীর অন্য কোনো এজেন্ডাতেও মিরপুরের জমি কেনার বিষয়ে অন্য কোনো আলোচনা নেই।
পরে ২৩২ সভার একটি সার সংক্ষেপ কার্যবিরনী তৈরি করা হয়। যার সাথে মূল কার্যবিবরনীর তথ্যের কোনো মিল নেই। এই সারসংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে প্রতি ডেসিমেল/শতক জমির মূল্য উল্লেখ করা হয় ৩০ লাখ টাকা। মোট জমির পরিমাণ ৭৬৩ ডেসিমেল (৪৬২ কাঠা বা ২৩.৩ বিঘা)। এর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটির অংশ ৩৮১ ডেসিমেল (২৩১.৩১২ কাঠা বা ১১.৫৬৫ বিঘা)। এই সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে ফারইস্ট ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের পক্ষে স্বাক্ষর করেন কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ।
সার সংক্ষেপ এই কার্যবিবরনীতে প্রজেক্ট খরচ শিরোনামে খরচের নতুন একটি হিসাব তুলে ধরা হয়। এতে হিসেব দেয়া হয়, মূল প্রজেক্ট খরচ ১১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর সাথে অন্যান্য খরচ হিসেবে যোগ করা হয়- প্রকৃত সরকারি রেজিস্ট্রেশন খরচ, বিবিধ খরচ, দলিল মূল্যের উপর ১১.৫০ শতাংশ হারে রেজিস্ট্রেশন খরচ।
সারসংক্ষেপ ওই কার্যবিবরনী আরো উল্লেখ করা হয়, জমি কেনা হবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে। জমির মূল্য ফারইস্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে সরাসরি জমির মালিককে পরিশোধ করা হবে।
সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে ডিড ভ্যালুর শিরোনামে একটি ব্যাখা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ডিড ভ্যালু বলতে বুঝাবে সরকারিভাবে নির্ধারিত মৌজা ভিত্তিক জমির মূল্য। এর সাথে সাব কবলা রেজিস্টেন খরচ ১১.৫০ শতাংশ হারে যোগ করা হবে।
বিবিধ ভূমি উন্নয়ন খরচ শিরোনামে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় সারসংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে। এতে বলা হয়, প্রজেক্ট খরচ থেকে ডিড ভ্যালু বাদ দিলে যা থাকবে তাই জমির উন্নয়ন খরচ।
সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথাও তুলে ধরা হয়।
উল্লেখ্য সার -সংক্ষেপ কার্যবিবরনীতে উল্লেখিত এসবের কোনো তথ্যেই ছিলনা ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড রিয়েল এ্যস্টেট ডেভলপমেন্ট সাব কমিটির ২৩২তম সভার মূল কার্যবিবরনীতে।
পরে ২৩২ তম সভার কার্যবিবরনী জালিয়াতি করে আবারো পরিবর্তন করা হয়। ২য় দফায় তা পরিবর্তন করে তা অনুমোদন দেখানো হয় ২৬৮তম ইনভেস্টমেন্ট ও রিয়েল এস্টেট সাব কমিটির সভায়। এতে নতুন করে যোগ করা হয়, জমি ক্রয়ে অতিরিক্ত খরচের প্রাইম ইসলামী লাইফের অংশ ৭১ কোটি টাকা ফারইস্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
একই বোর্ড সভার দুই কার্যবিরনী?
জমি ক্রয়ের মূল্য বাড়াতে বোর্ড সভার কার্যবিবরনীতেও জালিয়াতি করে পরিবর্তন করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ১ জুলাই ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ১৬৯তম বোর্ড সভার ১২ নং এজন্ডায় ফারইস্ট এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি: গঠন ও নিবন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে এই সোসাইটির জন্য ঢাকার মিরপুরে জমি কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার জন্য বোর্ড ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। এছাড়া মিরপুরের জমি কেনার বিষয়ে আর কোনো তথ্য নেই ১৬৯তম সভার কার্যবিবরনীর কোনো এজেন্ডায় বা আলোচনায়। ১৪ নং বিবিধ আলোচনায় ১ ও ২ নামে উপধারার পর সভা সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে স্বাক্ষর করেন বোর্ডের সভাপতি নজরুল ইসলাম।
অথচ ১৬৯ নং সভার সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনীর ১৪ নং বিবিধ আলোচনায় নতুন করে ৩ নং আলোচ্যসূচি যোগ করে তৈরী করা হয় আরও একটি কার্যবিবরণী।
এতে জালিয়াতি করে তৈরি করা ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড রিয়েল এস্টেট সাব-কমিটির ২৩২ নং সভার সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনীর বিস্তারিত তুলে ধরে তা অনুমোদন দেখানো হয়। ১৬৯তম সভার মূল কার্যবিবরনীতে জমির মূল্য খরচের হিসাবের কোনো তথ্য ছিল না।
জালিয়াতি করে তৈরি করা সেই রিয়েল এস্টেট সাব-কমিটির ২৩২ নং সভার সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনী ও ১৬৯ নং বোর্ড সভার সার-সংক্ষেপ কার্যবিবরনী আবার অনুমোদন দেখানো হয় ২১১ নং বোর্ড সভায়। ২১১ নং সভার এই সার-সংক্ষেপ কার্যবিরনীতেও চেয়ারম্যানের পক্ষে স্বাক্ষর করেন হেমায়েত উল্লাহ।
১০৪ কাঠা জমি কেনা হয় বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের আগেই
২ কোম্পানির ২ সোসাইটির নামে জমি কেনা হয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বোর্ড সভার অনুমোদনের আগেই। ১৬৯তম সভায় ফারইস্ট ইসলামী কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি: গঠন করে প্রতিষ্ঠানটির নামে মিরপুরে জমি ক্রয়ের জন্য ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৩ সালের ১ জুলাই। অথচ এম তাজুল ইসলামের কাছ থেকে কেনা ১৬৫ শতাংশ জমি কেনা হয় ২৭ জুন ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ৭৪৮৮ নং দলিলে কেনা হয় ৭৪.৫৮ শতাংশ ও ৭৪৮৯ নং দলিলে কেনা হয় ৯০.৪২ শতাংশ জমি। দুটো দলিলেই আম-মোক্তার এম তাজুল ইসলাম।
আইডিআরএ’র অনুমোদনের ৩৮ দিন আগেই জমি কেনে ফারইস্ট
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির কাছ থেকে ৩৮১ শতাংশ জমি ক্রয়ের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে আবেদন করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। আইডিআরএ জমি ক্রয়ের অনুমোদন দেয় ২৩ জুন ২০১৬। অথচ ফারইস্ট জমি ক্রয় করে অনুমোদনের ৩৮ দিন আগে ১৫ মে ২০১৬ সালে। অপরদিকে আইডিআরএ’র অনুমোদন পত্রে শর্ত দেয়া হয় জমি ক্রয়ে নগদে কোনো লেনদেন করা যাবে না। অথচ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ সবগুলো জমি নগদ টাকা লেনদেন করে।
ফারইস্টের আর্থিক প্রতিবেদনেও গোঁজামিলের হিসাব
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ১৮ নং এ্যাডভান্স ফর কনস্ট্রাকশন ল্যান্ড এন্ড ল্যান্ড ডেভলোপমেন্ট শিরোনামে ব্যয় দেখানো হয় ২৩৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। অথচ ২০১৭ সালের আর্থিক বিবরণীতে ২০১৬ সালের সেই হিসাব দ্বিগুণ পরিবর্তন করে দেখানো হয় ৫৭৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি পুরনো আর্থিক প্রতিবেদন পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইনে অর্থ হিসাব পরিবর্তন চরম জালিয়াতি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানেই শেষ নয়, মিরপুর গোড়ান চাটবাড়িতে জমি ক্রয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে ঋণ দেয়া ও জমি ক্রয় ও উন্নয়নের খরচ সংক্রান্ত ব্যয়ের তথ্য গোঁজামিল দিয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে আর্থিক প্রতিবেদনে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ২০১৩ সালে ৪৩ কোটি ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪০ টাকা, ২০১৪ সালে ৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৪ টাকা ও ২০১৫ সালে ১৬৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হজার ৭৮ টাকা ঋণ দেয়ার তথ্য প্রদর্শন করা হয়। অথচ ১৬৯ নং সভার তথ্য অনুসারে এই সোসাইটির নামে ঋণ অনুমোদন করা হয় ৫০ কোটি টাকা।
অপর দিকে ২০১৫ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ১৮ নং নোটের প্রদর্শিত ফারইস্ট এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামের অগ্রিম ১৬৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮ টাকা ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রদর্শন করেনি।
২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ১৮ নং নোটে ২০১৫ সালে হিসাবে নতুন শিরোনাম যোগ করা হয়। এ্যাডভান্স ফর কনস্ট্রাকশন, ল্যান্ড এ্যান্ড ল্যান্ড ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামে নতুন এই শিরোনামে দেখানো হয় ১৭৭ কোটি ৬২ লাখ ৫২ হাজার ৩শ ১৫। আর ২০১৬ সালের হিসাবে তা দেখানো হয় ২৩৭ কোটি ২০ লাখ ১৩ হাজার ৭শ ৪৪ টাকা।
আবার ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে ঋণ দেয়া হয়েছে এমন কোনো তথ্য প্রদর্শন করেনি। অথচ ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ২০১৬ সালে হিসাবে প্রদর্শন করা হয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ১০৮ কোটি ৬ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫ টাকা ও প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ৭১ কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৩২ টাকা ঋণ দিয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ।
আইডিআরএ তদন্ত দলের কাছে হেমায়েত উল্লাহর স্ববিরোধী জবানবন্দি
মিরপুরের গোড়ানে জমি ক্রয়ের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে গঠিত আইডিআরএ’র তদন্ত দলের কাছে স্ববিরোধী জবানবন্দি দেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ। তারা একবার বলেন জমি ক্রয় ও জমির উন্নয়ন দৃশ্যমান তাই জমি ক্রয়ে আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি সঠিক নয়। আবার হেমায়েত উল্লাহ বলেন, এ জমিতে প্রাইম প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেসন্স নামে কোম্পানির নামে আড়াই বিঘা জমি লিজ নেয়া হয়। পরবর্তীতে টাকা দিতে না পারলে ম্যানেজমেন্টের চাপে জমি ফেরত দেন। এ জমিতে সাবেক পরিচালক এম এ খালেক গরুর খামার করেন। জমির চারপাশে দেয়াল দেয়া ও মাটি ভরাট করার জন্য ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে নগদে প্রচুর টাকা খরচ হয়। এর ৫০% ব্যয় প্রাইম ইসলামী লাইফের দেয়ার কথা সেই হিসেবে প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা জমি রেজিস্ট্রি দিয়ে পরিশোধ করে। এম এ খালেকের একক সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানির যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা পুরনের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নামে লিখে দেন।
তাই প্রশ্ন ওঠে জমি ক্রয়ে দুর্নীতি না হলে আর্থিক ক্ষতিটি কি করে হলো? জমি ক্রয়ের অনুমোদনে নগদে লেনদেন করা যাবে না শর্ত দেয়া হয়। এছাড়া ৫ হাজার টাকার ওপরে কোনো ধরণের লেনদেন নগদে করার সুযোগ নেই। অথচ নগদে লেনদেন করার বিষয়টি কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহী স্বীকার করেন। অর্থাৎ দুর্নীতি হয়েছে তা তারা স্বীকার করে নেন। যা বীমা আইনে বড় ধরণের অপরাধ।
অন্য দিকে আর্থিক কোনো দুর্নীতি হয়নি উল্লেখ করেও আর্থিক ক্ষতির দায় রহস্যজনকভাবে চাপানো হয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালক এম এ খালেকের উপর। যদিও জমি ক্রয়সহ সকল ধরণের লেনেদেনে হয়েছে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ স্বাক্ষরে।
১৪২ কোটি টাকা ’সামান্য কিছু বেশি’: আইডিআরএ’র তদন্ত কমিটি
২০১৯ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের বিভিন্ন তারিখে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়িতে জমি ক্রয়ের নামে ১০০ কোটি টাকা ও জমির উন্নয়নের নামে ১৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা কোম্পানির তহবিল থেকে নগদে তুলে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার অভিযোগ করেন মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
অভিযোগে বলা হয়, মিরপুরের গোড়ান চাটবাড়িতে জমির মূল্য বাড়িয়ে শত কোটি টাকা ও জমির উন্নয়ন দেখিয়ে ১৪২ কোটি ৩০ লাখ কোম্পানির তহবিল থেকে নগদে তুলে তা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ করা হয়েছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহর সহচরদের বিরুদ্ধে। এছাড়া নানাখাতে নানাভাবে এই চক্র প্রায় ৪শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা কোম্পানির তহবিল থেকে আত্মসাৎ করেছে।
এ অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ২৫ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন চিঠি পাঠায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে। এর এক মাস পর ২৫ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে।
এরও এক মাস পর ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে অভিযোগ তদন্তে ২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. শেখ মোহাম্মদ রেজাউল ইসলামকে। অপর সদস্য হলেন- পরিচালক (উপ সচিব) মোঃ শাহ আলম।
তদন্ত দল গত বছর ডিসেম্বরে প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়, “মিরপুর গোড়ান চাটবাড়ির জমি মূলত ফারইস্ট ইসলামী কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়ীজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে ক্রয় করা হয়। পরবর্তীতে তা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ও প্রাইম ইসলামী লাইফ কিনে নেয়। জমিটি ক্রয়ের পর জনাব এম এ খালেক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এর ব্যক্তিগত গরুর খামার , লেবার সেড, প্রিন্টিং প্রেস ইত্যাদি এবং জমিতে মাটি ভরাটের জন্য ১৪২.৩০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে এত খরচ অনেকটা বেশি মনে হয়েছে এবং জমির ক্রয়ের ব্যাপারে যদিও বোর্ডের অনুমোদন আছে তথাপিও জমির মূল্য বেশি মনে হয়েছে যা কাম্য নয়।”
কমিটি সুপারিশ করে, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ বিবেচনা করে সতর্কতার সাথে প্রচলিত বীমা আইন অনুযায়ি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডকে নির্দেশ প্রদান করা যেতে পারে।”
জীবন বীমা কোম্পানীর লাইফ ফান্ডের টাকা বীমা গ্রাহকের আমানত। তাই জমি কেনার নামে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা কোম্পানি থেকে সরিয়ে নেয়ায় বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকিতে ফারইষ্টের বীমা গ্রাহকরা। এত অনিয়ম জালিয়াতির পরও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ)’র রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।