হোমল্যান্ড লাইফে অনিয়ম আত্মসাৎ ১০৪ কোটি টাকা

তাফহিমুল ইসলাম সুজন: শ্বশুরের কাছ থেকে জমি কিনে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ১৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন জামাই ফারইস্টের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। অভিনব কৌশলে কোম্পানির টাকা নিজেদের পকেটে ভরার এই ‘জামাই-শ্বশুর কান্ড’ ছিল দেশের বীমাখাতে আলোচিত ঘটনা। জমির দাম অস্বাভাবিক বাড়তি দেখানোর দায়ে সম্প্রতি কারগারে যেতে হয় নজরুল ইসলামসহ ফারইস্টের তিন পরিচালককে।

এবার একই তরিকায় হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে জমি কেনার নামে কোম্পানি থেকে ১৩ কোটি হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ মিলেছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ, পরবর্তী চেয়ারম্যান আব্দুর শুক্কুর ও ফয়জুল হকের সময়কালের পরিচালনা পর্ষদে জমি ক্রয়সহ মোট ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মের এই ঘটনা ঘটে ।

জমি ক্রয়ের নামে কোম্পানির টাকা হাতিয়ে নেয়ার এই ঘটনায় হোমল্যান্ড লাইফের দায়েরকৃত মামলায় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের ছেলে আরাফাত কাজী আহমদকে ১ বছরের জেল দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ওয়ালিউল ইসলাম। ২০১০ সালের ১০ মার্চ আদালতের এই রায়ে ৬ মাস কারাবাসের পর জামিন নিয়ে পলাতক আছেন আরাফাত কাজী আহমদ।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়,  হোমল্যান্ড লাইফ বীমা খাতে ব্যবসা শুরু করে ১৯৯৬ সালে।  এ সময়ে কোম্পানির বেশিরভাগ পরিচালক ছিলেন সিলেটের। তারা সবাই লন্ডন প্রবাসী।  কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর পর থেকে সিলেটের লন্ডন প্রবাসী পরিচালকরা ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কোনো বোর্ড সভা আয়োজন না করে সিলেটে বোর্ড সভা করতে শুরু করে।  এ সময়ে জমি ক্রয়, শেয়ার কেনা-বেচার নামে কোম্পানি থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ আছে, কোম্পানির টাকা হাতিয়ে নিতেই হোমল্যান্ড লাইফের ঢাকার প্রধান কার্যলয়ে বোর্ড সভার আয়োজন করতো না। সিলেটের জল্লার পাড়ে বির্তকৃত জমি ক্রয়, সিলেটের টুকের বাজারে অস্থিত্বহীন জমি ক্রয় ও মাটি ভরাট, জমি ক্রয় বাবদ ব্রোকারেজকে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় সিলেটে অনুষ্ঠিত  সেসব বোর্ড সভাগুলোতে।

সুত্র আরো জানায়, হোম্যল্যান্ড লাইফের পরিচালক আব্দুস শুক্কুর কোম্পানির চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি কোম্পানি থেকে বিলাসবহুল জিপ গাড়ি উপহার নেন। পরবর্তীতে বিশেষ নিরীক্ষায় গাড়ি উপহার নেয়ার বিষয়টি ধরা পড়লে চেয়ারম্যানের আব্দুস শুক্কুরের ছেলে কোম্পানির উদ্যোক্তা শামীম আহমেদ গাড়িটি হোমল্যান্ড লাইফকে ফেরত দেন।

শর্ত মেনেও টাকা ফেরত দেয়নি পরিচালক ফয়জুল হক

অভিযোগ রয়েছে ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক ফয়জুল হক।  এ ঘটনায় হোমল্যান্ডের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকতা শারাফাত উল্লাহ ঢালী মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে। পরবতীতে টাকা ফেরত দেয়ার শর্তে সে মামলা তুলে নেয় হোমল্যান্ড। কিন্তু একটি টাকাও ফেরত দেননি হোমল্যান্ডের বর্তমান পরিচালক ফয়জুল হক। ২০০৯ সালে ফয়জুল হক পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকা কালে কমিশন ও সার্ভিসিং সেন্টারের নামে ৬৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে। মোট প্রিমিয়াম আয়ের ওপর অবৈধভাবে জাকির হোসেন নামে এক কর্মকর্তাকে ১ শতাংশ হারে কমিশন দেয়ার নামে এ টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ মিলেছে ।

যেভাবে ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ

হোমল্যান্ড লাইফের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত ১৩১ তম বোর্ড সভায় কোম্পানির আত্মসাতকৃত ১০৪ কোটি টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। হোমল্যান্ডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন সম্প্রতি মাগুরার গ্রাহকের মামলায় জেল ফেরত লন্ডন প্রবাসী ৭ পরিচালকসহ ১৪ পরিচালক। বোর্ড সভায় উপস্থিত পরিচালকরা হলেন- মো. জামাল মিয়া, সালেহ হোসেন, মো. আবদুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, মো. কামাল মিয়া, মো. জামাল উদ্দিন, মো. আব্দুল হাই, মো. আব্দুল আহাদ, হোসনে আরা নাজ, মোহাম্মদ শামীম আহমদ, স্বতন্ত্র পরিচালক শওকতুর রহমান, মো. আখতার হোসেন ও ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরী।

সভায় ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তি ও ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। একইসাথে আত্মসাতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হোমল্যান্ড লাইফের দায়েরকৃত মামলাগুলোর হালনাগাদ তথ্য বোর্ড সভায় তুলে ধরা হয়।মতিঝিলের এল্লাল চেম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে দুপুর ১ টায় অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় তারা উপস্থিত ছিলেন।

বোর্ড সভার বিবরণ অনুযায়ী, আত্মসাতকৃত ১০৪ কোটি টাকার মধ্যে সিলেটের টুকের বাজার নামক স্থানে ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালে নাম সর্বস্ব (অস্তিত্ব বিহীন) ১ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমি ক্রয় করে। এই জমিতে মাটি ভরাট ও কাঁটা তারের বেড়া দেয়ার নামে ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৬০ টাকা আত্মসাৎ করেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দীন আহমেদ, পরিচালক আব্দুর শুক্কুর, ফারুক আহমেদ, নজরুল ইসলাম ও নাফিছা সালমা। একই সময়ে জমি কেনার কমিশন বাবদ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন সাবেক চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দীন আহমেদ।

এছাড়াও সিলেটের জল্লার পাড়ে আরও একটি জমি ক্রয় বাবদ ২০০৪ সালে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে আত্মসাৎ করে হোমল্যান্ড লাইফের তৎকালীন পরিচালকরা। এই জমিটি কোম্পানির কাছে বিক্রির নামে হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম আহমেদের ছেলে কাজী আরাফাত কোম্পানি থেকে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অগ্রীম নিয়ে আত্মসাৎ করেন। ২০০৫ সালে আরো ২ কোটি ১০ লাখ টাকা অগ্রীম নেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম।

জানা যায়, ২০১২ সালে কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মুনিম শিপু জল্লার পাড়ের জমি বুঝিয়ে দেয়ার নামে ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত দালালদের কমিশন পরিশোধের নামেও ২০০৩-২০০৪ সালে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

এছাড়া ২০০৯ সালে অডিট ফার্ম একনবীনের করা বিশেষ নিরিক্ষায় হোমল্যান্ড লাইফের ১৬ কোটি টাকা অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। কোম্পানির পল্লী পারিবারিক বীমায় ঋণ প্রদানের নামে আত্মসাৎ করা হয় ৪৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। সার্ভিস সেন্টারের নানান খাতের ব্যয় দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয় ৬৩ কোটি টাকা। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে কোম্পানির লোকসান করা হয় ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। এছাড়া আরো ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে মামলা চলমান রয়েছে।

বোর্ড সভা সূত্রে জানা যায়, ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন বর্তমানেও হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। বেহাত হয়ে যাওয়া কোম্পানির এসব টাকা উদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে লন্ডন প্রবাসী পরিচালকদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহকের করা মামলায় জেল ফেরত লন্ডন প্রবাসী ৭ পরিচালক জামিন নিয়ে হোমল্যান্ড লাইফের প্রধান কার্যালয়ে এসে জোরপূর্বক বোর্ড সভা করেন। নোটিশবিহীন সেই সভায় তারা বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাসকে পদত্যাগ করার চাপ সৃষ্টি করেন। একইসঙ্গে চেয়ারম্যানকে পরিচালক পদ থেকেও অপসারণের অপচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে লন্ডন প্রবাসী পরিচালকদের বিরুদ্ধে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের  হাজার হাজার গ্রাহকের স্বার্থ ।

১৩১ তম বোর্ড সভার বিবরণে বলা হয়, ২০০৮ সাল পর্যন্ত একচুরিয়াল ভ্যালুয়েশন রিপোর্ট অনুসারে কোম্পানির আর্থিক ঘাটতি ছিল ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যা ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে ছিল ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এই সময় কোম্পানির সারপ্লাস আনতে সময় লেগেছে ২০১২ সাল পর্যন্ত। ২০১২ সালে ৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা সারপ্লাস হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ১৮ কোটি টাকা করে ৩৬ কোটি টাকা সারপ্লাস হয়। কোম্পানির দায়ের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ বেশি হলে তাকে সারপ্লাস বলা হয়।

কোম্পানির সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা

২০২০ সালে কোম্পানির মোট বিনিয়োগ ছিল ১১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা যা ২০২১ সালে ৯ কোটি ৪৩ লাখ কমে দাঁড়ায় ১০৪ কোটি ৭ লাখ টাকা।

একই ভাবে লাইফ ফান্ড কমেছে কোম্পানিটির। ২০২০ সালে লাইফ ফান্ড ছিল ২৬০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০২১ সালে ১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা কমে দাঁড়ায় ২৪৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

কোম্পানির ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ আর এই টাকা উদ্ধারে ১৩১তম বোর্ড সভায় উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিচালক মো. আবদুর রবের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলা কি ভাই, আমি তো এগুলা জানিনা। আমি তো মিটিং এ ছিলাম না। আপনি বোর্ড মিটিং এ ছিলেন না? না। প্রয়োজনে আপনি এই বিষয়ে অন্য পরিচালক বা ভাইস চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করেন। ওকে’ বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

হোমল্যান্ডে লাইফের আরেক পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আহমেদের সাথে মোবাইল ফোনে একই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই বিষয়টা আমার জানা নেই। আমাদেরকে অনেক কিছুই জানানো হয় না। মিটিং এর পড়ে কি লেখা হয়, না হয়, তা তো আমরা জানিনা। অনেক সিদ্ধান্তই আমাদের জানানো হয় না বা অনেক এজেন্ডা আছে যা পাশ কাটিয়ে চলে যায় তা আমাদের জানতেও দেয় না। আমি শুধু জানি অর্থিক অনিয়মের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনজীবির সাথে পরামর্শ করা হয়।

আত্মসাৎ হওয়া টাকা উদ্ধারে উদ্যোগেই কি কোম্পানির চেয়ারম্যানকে বহিষ্কারের বা কোম্পানি দখলের চেষ্টা? তিনি বলেন, এই ধরনের কিছুই না।