নন-লাইফ বীমার অবৈধ কমিশন বন্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে

আবদুর রহমান আবির: বন্ধ হচ্ছে না নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর অবৈধ কমিশন। অবৈধ এ কমিশন বন্ধে ইতোমধ্যে কয়েক দফা কমিশন বন্ধ বা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। পরবর্তীতে ৬৪ নং সার্কুলার জারি করা হয়। কোম্পানিগুলোর মধ্যে জেন্টলম্যান’স এগ্রিমেন্ট হয়। একইসাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দফায় দফায় নিরীক্ষক নিয়োগ করে।

এরপরও বন্ধ হয়নি নন-লাইফ বীমার অবৈধ কমিশন। কখনো ডামি বা ভূয়া কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে; কখনো ট্যারিফ রেট লংঘন করে; আবার কখনো অভিনব কোন কৌশলে ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন দিয়ে যাচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলো। ফলে নন-লাইফ খাতে কমিশন হার আবারো ৬০ শতাংশও ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

নন-লাইফ বীমা খাতের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে কি ধরণের পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে সে বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর মালিক, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও বীমা বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। আলাপকালে তারা যেসব পদক্ষেপের কথা বলেন তার মধ্যে রয়েছে-

নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে নন-ট্যারিফ মার্কেটে আনতে হবে; ব্যাংকাস্যুরেন্স মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে বীমা কোম্পানির এজেন্টশিপ প্রদান করতে হবে; বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ইন্টিগ্রেটেড সফটওয়্যার চালু করতে হবে; দেশব্যাপী নন-লাইফ বীমা কোম্পানির এজেন্ট নিয়োগ দিতে হবে; অবৈধ কমিশনের ঝুঁকির বিষয়ে বীমা গ্রাহকদের সচেতন করতে হবে; সর্বোপরি নিজেদের ঠিক হতে হবে আইন পরিপালনে।

এ বিষয়ে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শফিক শামীম বলেন, নন-লাইফ বীমা খাতের অবৈধ কমিশন বন্ধে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে কোন পদক্ষেপ-ই এই অবৈধ কমিশন বন্ধ করতে পারেনি; হয়তো সাময়িকভাবে কিছুটা কমেছে।

এক্ষেত্রে আমার অভিমত- বীমা গ্রাহকরা সচেতন না হলে অবৈধ কমিশন বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য অবৈধ কমিশনের ঝুঁকির বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করতে হবে। একইসঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রয়োজনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতে হবে। এক্ষেত্রে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’র মতো বড় বড় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

শফিক শামীম আরো বলেন, ইউএমপি চালু হওয়ায় কিছুটা অনিয়ম কমেছে, তবে প্রত্যাশিত নয়। এক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেটেড সফটওয়্যারের সুবিধাগুলোও ইউএমপি’তে সংযুক্ত করতে পারলে আরো ভালো হবে। এ ছাড়াও ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে নন-লাইফ বীমা খাতের অবৈধ কমিশন অনেকটাই কমে আসবে। কারণ, তখন কমিশন নেবে এক পক্ষ; ব্যাংক। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির ভালোর জন্য ব্যাংকও চিন্তা করবে।

কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান তারেক বলেন, নন-লাইফ খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধে অনেক পদক্ষেপ-ই নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো- সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাথে কোম্পানিগুলোর চুক্তি অনুসারে প্রতি ত্রৈমাসিকে পুনর্বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হবে। কোনভাবেই বকেয়া বা সমন্বয় করা যাবে না।

একইভাবে বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলোর পুনর্বীমা দাবির অনুমোদন এবং বীমা দাবির প্রাপ্য টাকাও প্রতি ত্রৈমাসিকে পরিশোধ করবে সাধারণ বীমা করপোরেশন। এক্ষেত্রে নিয়মিত পুনর্বীমা প্রিমিয়াম পরিশোধ করলে কোম্পানিগুলো অবৈধ কমিশন বা ভিন্ন খাতে ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত টাকা পাবে না, ফলে এমনিতেই কমে আসবে অবৈধ কমিশন বা অবৈধ খরচ। 

এ ছাড়াও অবৈধ কমিশন বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর পথ হবে নিজেদের ঠিক করা। অর্থাৎ বীমা কোম্পানিগুলো একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবৈধ কমিশন না দেয়ার ঘোষণা করবে এবং সেটা নিজেদের মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে। নিজেরা ঠিক না হলে কোনভাবেই অবৈধ কমিশন বন্ধ করা সম্ভব হবে না, বলেন হাসান তারেক।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনালস সোসাইটি (বিআইপিএস)’র সাধারণ সম্পাদক এ কে এম এহসানুল হক এফসিআইআই বলেন, নন-লাইফ বীমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অবৈধ কমিশন। যা দীর্ঘ দিন ধরে এ খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। এর ফলে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো দাবি পরিশোধের বেলায় গরিমসি ও ছলচাতুরির মাধ্যমে গ্রাহকদের হয়রানি করে আসছে।

এই অবৈধ কমিশন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমেই আমাদের বীমা কোম্পানিগুলোকে নন-ট্যারিফ মার্কেটে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ব্যাংকাস্যুরেন্সের আওতায় এনে বীমা কোম্পানির এজেন্টশিপ প্রদান করতে হবে। এ ছাড়াও বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ইন্টিগ্রেটেড সফটওয়্যার চালুর মাধ্যমেও এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে।

বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, নন-লাইফ বীমা খাতের অবৈধ কমিশন বন্ধে প্রথমে আমাদের নিজেদের ঠিক হতে হবে; নিজেদের বিবেককে ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে পুরোপুরিভাবে আইন মেনে চলতে হবে।

দ্বিতীয়ত আইডিআরএ’র কাজ হবে- নন-লাইফ খাতের জন্য যে নতুন এজেন্ট নীতিমালা করা হয়েছে সেটার বিধি-প্রবিধি করে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে নতুন করে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে খুব শিগগিরই এটি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাহলে এই অবৈধ কমিশন বন্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস, বলেন শেখ কবির হোসেন।