স্ট্যাম্প সংকটে নতুন পলিসি ইস্যু বন্ধের শঙ্কা বীমা খাতে

আবদুর রহমান আবির: বীমা স্ট্যাম্প সংকটের কারণে নতুন পলিসি ইস্যু বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের লাইফ বীমা খাতে। কোম্পানিগুলো বলছে, প্রায় দু’মাস ধরে বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারছে না ট্রেজারি অফিস। কবে নাগাদ স্ট্যাম্প সরবরাহ শুরু হবে তাও জানাতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বীমা স্ট্যাম্প সংকটে এরইমধ্যে দু’একটি লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানের ছোট অংকের পলিসি দলিল ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও জানা গেছে। শীর্ষস্থানীয় একটি লাইফ বীমা কোম্পানির হাতে আর কোন বীমা স্ট্যাম্প নেই বলে জানিয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন গ্রাহকদের চাপ এবং ব্যবসা হারানোর শঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা।

ট্রেজারি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ছাপাখানা (টাকশাল) থেকে চাহিদা অনুযায়ী বীমা স্ট্যাম্প না পাওয়ায় কোম্পানিগুলোকে তারা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারছেন না। প্রায় দু’মাস ধরে ছাপাখানায় স্ট্যাম্প ছাপানোর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে খুব শিগগিরই ছাপাখানা থেকে প্রয়োজনীয় বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হবে বলে তাদের প্রত্যাশা।

এদিকে বীমা স্ট্যাম্প সংকট মোকাবেলায় ডিজিটাল বীমা স্ট্যাম্প চালুর দাবি উঠেছে দেশের লাইফ বীমা খাতে। দীর্ঘ দিন ধরেই বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে এমন দাবি জানিয়ে আসছে বীমা কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র টেকনিক্যাল কমিটি থেকে এই ডিজিটাল বীমা স্ট্যাম্প চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বীমা স্ট্যাম্প। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বীমা স্ট্যাম্প ছাড়া একটা পলিসি দলিলও ইস্যু করা সম্ভব নয়। বীমা স্ট্যাম্প ছাড়া পলিসি দলিলের আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এ কারণে বীমা স্ট্যাম্প প্রাপ্তি সহজলভ্য করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন একটি মোক্ষম উপায় হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

স্ট্যাম্প আইন অনুসারে, প্রতিটি লাইফ বীমা পলিসিতে নির্ধারিত হারে বীমা স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হয়। এক্ষেত্রে বীমাকৃত অর্থের পরিমাণ অনধিক এক লাখ টাকা হলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প শুল্কের পরিমাণ ১০০ টাকা। আবার বীমাকৃত টাকার পরিমাণ এক লাখ টাকার বেশি হলে প্রত্যেক পঞ্চাশ হাজার টাকা বা এর অংশের জন্য স্ট্যাম্প শুল্কের পরিমাণ ৫০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো সাধারণত প্রতি কোয়ার্টারের শুরুতে প্রয়োজনীয় বীমা স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে। কিছু বীমা কোম্পানি বছরে দু’বারও এই স্ট্যাম্প কিনে থাকে। গত জুলাই মাসের মাঝা-মাঝি কয়েকটি কোম্পানি ট্রেজারি অফিসে বীমা স্ট্যাম্পের চাহিদা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারেনি ট্রেজারি অফিস।

বীমা কোম্পানিগুলো বলছে, ট্রেজারি অফিসে দফায় দফায় খোঁজ নিয়েও মিলছে না আশার বাণী। সর্বশেষ চলতি সেপ্টেম্বর মাসের পনের তারিখের পর খোঁজ নিতে বলা হয়েছে কোম্পানিগুলোকে। কবে নাগাদ বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হতে পারে সে বিষয়টি জানা যাবে ওই পনের তারিখে। এদিকে বীমা স্ট্যাম্প না থাকায় বীমা কোম্পানিগুলোর নতুন পলিসি ইস্যু প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজীম উদ্দিন বলেন, প্রতিটি নতুন পলিসিতে সরকার নির্ধারিত হারে বীমা স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতি বছর আমাদের ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার বীমা স্ট্যাম্প প্রয়োজন হয়। এ জন্য প্রতি বছর কয়েক ধাপে আমরা বীমা স্ট্যাম্প কিনে থাকি। গত জুলাইয়ে আমরা ৬০ লাখ টাকার বীমা স্ট্যাম্প কেনার চাহিদা দিয়েছি ট্রেজারি অফিসকে। গত সপ্তাহে আরো ৫০ লাখ টাকার বীমা স্ট্যাম্প কেনার চাহিদা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সাধারণত ট্রেজারি অফিস থেকে বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। তবে এবার ট্রেজারি অফিসকে চাহিদা দেয়ার পর প্রায় দেড় মাস হয়ে যাচ্ছে তারা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারছে না। বলছে, সেপ্টেম্বরের মাঝা-মাঝি যোগাযোগ করতে। তবে ওই ১৫ তারিখে তারা বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এদিকে আমাদের হাতে থাকা বীমা স্ট্যাম্প প্রায় শেষ। আর কয়েকদিন গেলেই আমাদের নতুন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।

বীমা স্ট্যাম্প সংকটের বিষয়ে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জালালুল আজিম বলেন, প্রতি বছর প্রায় দুই থেকে তিন কোটি টাকার বীমা স্ট্যাম্প প্রয়োজন হয়। কয়েক ধাপে আমরা এগুলো সংগ্রহ করি। আমাদের হাতে অন্তত এক মাসের স্ট্যাম্প সংগ্রহে থাকতেই নতুন করে চাহিদা দেয়া হয় ট্রেজারি অফিসে। কিন্তু সেখানে নাকি এখন স্ট্যাম্পের ক্রাইসিস চলছে; সব প্রিন্ট নাকি শেষ।

তিনি বলেন, মাসখানিক আগে আমাদের কোম্পানি থেকে ট্রেজারি অফিসে টাকা জমা দেয়া হয়েছে বীমা স্ট্যাম্প কেনার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোন স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারেনি। আমাদের কোম্পানি থেকে বারবার ট্রেজারি অফিসে খোঁজ নিয়েও কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি। এদিকে আমাদের সংগৃহীত বীমা স্ট্যাম্প প্রায় শেষ। আর কয়েক দিন গেলেই ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে।

চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক বলেন, আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকায় বীমা স্ট্যাম্প ছাড়া লাইফ বীমার কোন পলিসি ইস্যু করা যায় না। এ কারণে বীমা স্ট্যাম্প’কে লাইফ বীমা কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারের রাজস্ব আদায়ের একটি মাধ্যম এটি।

তিনি বলেন, প্রতি কোয়ার্টারে আমাদের ১০/১২ লাখ টাকার বীমা স্ট্যাম্প লাগে। স্ট্যাম্প শেষ হওয়ার এক মাস আগেই আমরা সাধারণত তা সংগ্রহ করি। চলতি সপ্তাহেই আমাদের বীমা স্ট্যাম্প কেনার জন্য ট্রেজারি অফিসকে চাহিদা দিয়ে আসার কথা রয়েছে। সেখান থেকে ঘুরে আসলেই বর্তমান পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)’র ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ও জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, বীমা স্ট্যাম্প সংকট আগেও হয়েছে। স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে গিয়ে বিশেষ করে ছোট অংকের স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সময় হয়রানিতেও পড়তে হয়। এ কারণে বেশ আগে থেকেই ডিজিটাল বীমা স্ট্যাম্প চালুর দাবি উঠেছে।

তিনি বলেন, লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বীমা স্ট্যাম্প। এই স্ট্যাম্প ছাড়া বীমা পলিসি দলিলের আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এ কারণে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র পক্ষ থেকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র কাছে ডিজিটাল বীমা স্ট্যাম্প চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবার।

ঢাকা জেলার সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (ট্রেজারী শাখা) সায়েম ইমরান বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদার প্রেক্ষিতে আমরা বীমা স্ট্যাম্প সরবরাহ করে থাকি। তবে এগুলো ছাপানো হয় গাজীপুরের টাকশালে। সেখান থেকে আমাদের কাছে সরবরাহ করা হয়। তারপরও কেবল কোম্পানিগুলোকে আমরা স্ট্যাম্প সরবরাহ করতে পারি। এক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় ধাপের কাছ করি।

সায়েম ইমরান বলেন, বর্তমানে কোন স্ট্যাম্প ছাপানো হচ্ছে না; প্রায় দু’মাস ধরে বন্ধ রয়েছে ছাপাখানা। সেখানে রিপেয়ারিংয়ের কাজ চলছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ কারণে আমাদের কাছেও এখন কোন বীমা স্ট্যাম্প নেই। অন্যান্য স্ট্যাম্পও ঘাটতি রয়েছে। আমাদের কাছে সর্বশেষ তথ্য হলো- আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ জানা যাবে কবে থেকে বীমা স্ট্যাম্প ছাপানোর কার্যক্রম শুরু হবে।

তিনি আরো বলেন, যখন বীমা স্ট্যাম্প ছাপানো শুরু হবে তখন প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করে সবার চাহিদা পূরণ করা হবে বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে। আসলে আমাদেরকে সেখান থেকে যা জানানো হয়, তাই বলতে পারি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে টাকশাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে, বলেন সায়েম ইমরান।