নিম্নবিত্তকে স্বাবলম্বী করার মাধ্যম হতে পারে ক্ষুদ্রবীমা: একেএম শরীফুল ইসলাম
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে বিশেষ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বীমা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। বিশেষ আয়োজনের এ পর্বে ক্ষুদ্রবীমার ওপর অভিমত দিয়েছেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরীফুল ইসলাম। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পাঠকদের জন্য অভিমতটি তুলে ধরা হলো:
একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, দারিদ্র বিমোচণে বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রবীমা এখন ব্যাপক আলোচিত বিষয়। নিম্নবিত্তের জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বী করার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে ক্ষুদ্রবীমা। ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সঞ্চয়, আর্থিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবাসহ ঋণদানের মতো কর্মসূচি নেয়া যায়। তবে ক্ষুদ্রবীমার আওতায় এ ধরণের ব্যাপক কর্মসূচি নিতে গেলে প্রয়োজন আইনের সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ণ ও সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী বলেন, ব্যবহারিক দৃষ্টিকোন থেকে বীমাকে ম্যাক্রো (সামষ্টিক) এবং মাইক্রো (ক্ষুদ্র) এই দু'ভাবে আলোচনা করা হয়। যে ধরণের বীমা পলিসির প্রিমিয়াম হার কম এবং স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠির ক্রয় সীমার মধ্যে- ক্ষুদ্রবীমা বলতে আমরা সাধারণত এগুলোকেই বুঝে থাকি।
অর্থাৎ যে পদ্ধতির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় সেটাই ক্ষুদ্রবীমা। স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠির কথা চিন্তা করে ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, প্রান্তিক কৃষক, পোশাক শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশাভুক্ত নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠিকে ক্ষুদ্রবীমার আওতায় আনা যায়। তাদের মাসিক আয় নূন্যতম ১০ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। এ কারণে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বিশেষ কিছু সুবিধাদি দেয়া যেতে পারে। এরমধ্যে রয়েছে- মেয়াদান্তে লাভসহ জমাকৃত টাকা দ্রুত প্রদান, গ্রাহকের অকাল মৃত্যুতে দাবির টাকা দ্রুত পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া, দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্য বীমার পাশাপাশি শষ্য বীমার সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।
একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার আওতা অনেক বড় হওয়া সত্বেও সম্প্রতি বহুবিধ কারণে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক কমে যাচ্ছে। এরমধ্যে ৩টি কারণ বিশেষভাবে দায়ী। প্রথম: ক্ষুদ্রবীমায় দক্ষ বীমাকর্মীর অভাব রয়েছে। যার কারণে বীমার সুফল সম্পর্কে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির নিকট সঠিক ধারণা পৌছায় না। অনেক বীমা কর্মী ক্ষুদ্রবীমাকে গ্রাহকের কাছে সমিতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। দেশের বিভিন্ন মাল্টিপারপাস কোম্পানি গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে উঠে যাওয়ায় এর বিরুপ প্রভাব ক্ষুদ্রবীমার উপরও পড়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক কমে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়: ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের। গ্রামে ব্যাংকের শাখা কম থাকায় গ্রাহক প্রিমিয়ামের টাকা সরাসরি ব্যাংকে জমা দিতে পারে না। আবার অনেক সময় নিম্ন আয়ের গ্রাহকরা স্বল্প শিক্ষার কারণেও ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিতে আগ্রহী হন না। এ কারণে সঠিক সময়ে প্রিমিয়াম জমা না হওয়ায় পরবর্তীতে বীমা দাবী পরিশোধে জটিলতা দেখা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে বীমা সম্পর্কে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয়।
তৃতীয়ত: অনেক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রাহকের নিকট থেকে প্রিমিয়ামের টাকা গ্রহণ করে তাদেরকে রসিদ প্রদান করেন না। এর কারণে গ্রাহকের প্রিমিয়াম তার হিসাবে জমা না হওয়ায় মেয়াদ শেষে গ্রাহককে হয়রানির শিকার হতে হয়। একটি পরিবার বা এলাকায় একজন গ্রাহক প্রতারিত হলে অন্যদের মধ্যেও বীমা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করেন সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী। এরমধ্যে রয়েছে- প্রিমিয়ামের টাকা যাতে গ্রাহক সরাসরি ব্যাংকে জমা দিতে পারেন সে ব্যবস্থা গ্রহণ। গ্রাহক সমাবেশের মাধ্যমে বীমা সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান। কর্মকর্তা ও কর্মীদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান। শিক্ষিত কর্মী বাহিনী গড়ে তোলা।
কর্মকর্তা ও কর্মীদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বীমা পলিসির সকল তথ্য মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে গ্রাহককে জানানো। এসবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি ও মৃত্যু দাবি প্রদানে কালক্ষেপণ না করা এবং প্রিমিয়াম আদায় রসিদের সকল পাতার যথাযথ ও সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করা।
দাবি পরিশোধের সময় কোম্পানিগুলো মুনাফা দিতে পারছে না। এর জন্য কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেন একেএম শরীফুল ইসলাম। সেগুলো হলো- অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আইডিআরএ'র নির্দেশনা না মানা। সঠিক বিনিয়োগের অভাব। কর্মকর্তা ও কর্মীদের দুর্নীতি। দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন না করা এবং নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার কম হওয়া।
তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয় হ্রাসে প্রয়োজন সকল পর্যায়ে দুর্নীতি রোধ ও ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা। লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা। দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা নিয়োগ করা। কোম্পানির সকল কার্যক্রম আধুনিকায়ন করা। কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা এবং ১ম বর্ষ ব্যবসা বৃদ্ধি ও নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে মনযোগী হওয়া।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মোট ব্যবসার প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষুদ্রবীমা এবং এর নবায়ন আদায় হারও সন্তোষজনক বলে জানান একেএম শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিতে একটি প্রশিক্ষণ বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগ থেকে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রকল্প পরিচালকরা যখন বিভিন্ন অফিস ট্যুরে গমন করেন তখন কর্মীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কাজ করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ক্ষুদ্রবীমা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণের বিষয়ে একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছর ক্ষুদ্রবীমা সংক্রান্ত সেমিনার হয়ে থাকে। সেখানে আমি গিয়েছি এবং বিভিন্ন দেশের জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে ক্ষুদ্রবীমার বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। আমাদের দেশের কিছু বিষয় তাদের নিকট প্রশংসিত হয়েছে। তাদের নিকট থেকেও আমরা বেশ কিছু আইডিয়া পেয়েছি।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ক্ষুদ্রবীমার উপর মেক্সিকোতে একটি সম্মেলন হয়েছে। ওই সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করেছি। সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মত বিনিময় হয়েছে। এসময় জানতে পেরেছি যে, তারা ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে ব্যাপক আকারে কাজ করছেন। শস্য বীমা এবং বিশেষ করে স্বাস্থ্য বীমার ওপর বেশ জোরেশোরে তাদের কাজ চলছে।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্রবীমার উন্নয়নে আমার এবং আমাদের কোম্পানির বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম পরিকল্পনা এই খাতে শিক্ষিত এবং সৎ কর্মীদের নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া। এছাড়াও কল সেন্টারের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা। নতুন স্কীম প্রণয়ন। দ্রুত দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া। ব্যয় সংকোচন করা। ১ম বর্ষ ব্যবসা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং নবায়ন আদায়ে অধিকতর মনযোগ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।