বীমা পেশায় কাজের প্রতি বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতাই বয়ে আনে সাফল্য

এস এম নুরুজ্জামান: জীবন বদলের চাবিকাঠি অটোসাজেশন বইয়ের শেষ অটোসাজেশন জীবনে আমি হবো লাখো মানুষের ভরসাস্থল। মরণেও তারা হৃদয়ের অশ্রুতে শেষ বিদায় জানাবে আমাকে। তারপরও প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে বেঁচে থাকব আমি, তাদের আনন্দে বেদনায় সংকটে সম্ভাবনায় প্রেরণার উৎসরূপে। রক্ত-মাংসের মানুষ তো অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু এই মানুষদের কাজগুলোই তাদেরকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের হৃদয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়।

যেমন ধরুন, এই বাতিগুলো। যদি নিভিয়ে দেই, সবাই বলে উঠবেন যে, একটা অন্তত জ্বালান, কিছু তো দেখতে পাই না। আবার ধরুন, দুধের যে শিশুটি রাতে কান্না করে ওঠে মা-বাবা বাতি জ্বালিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। অন্ধকার ঘরে আলো দেখে শিশুও আস্তে আস্তে শান্ত হয়। এই যে অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার সুযোগ করে দিতে যে মানুষটি রাতদিন কাজ করেছেন, তিনি স্যার টমাস আলভা এডিসন। তিনি চলে গেছেন, তার কাজ আমাদের উপকারে আসছে। এই কাজের মাধ্যমেই তিনি বেঁচে আছেন।

আসলে কাজ মানুষকে মরণের পরেও বাঁচিয়ে রাখে, আবার বেঁচে থাকতেও কাজ যত বেশি করা যায় তত সুস্থ থাকা যায়। এটি কথার কথা নয়। কয়েকটি গবেষণার কথা বলি।

গবেষণা-১: ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অবসর গ্রহণের পর এক বছরের কর্মসম্পৃক্ততা অকালমৃত্যুর হার কমাতে পারে শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত।

গবেষণা-২: ৬৫ বছর বয়সে অবসরে গেছেন এমন ১ হাজার ১ জন সুইডিশ নাগরিককে দুবছর পর্যবেক্ষণ করার পরে দেখা যায় যে, এদের মধ্যে যারা সপ্তাহে অন্তত একদিন সেবামূলক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন, অন্যদের তুলনায় তাদের বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমেছে প্রায় আড়াই গুণ। বীমা পেশায় যারা কাজ করেন তাদেরটি সেবামূলক|

গবেষণা-৩: যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিদ প্রফেসর জেসন অং। তার নেতৃত্বে একটি গবেষণা চলে এমন কয়েকজনের ওপর যাদের গড় বয়স ৭৯ বছর। স্লিপ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত সেই গবেষণায় বলা হয়, এদের মধ্যে যারা কর্মব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন, তারা অনিদ্রা ও ঘুম-সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগেছেন কম।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই উপকারগুলো যেকোনো বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। যেমন- কাজে ব্যস্ত থাকলে যে কয়েকটি উপকার হতে পারে আমি তার কয়েকটি বলছি-

১. যতক্ষণ কাজ ততক্ষণই শান্তি।

২. যে যত বেশি কাজ করে সে তত বেশি হতাশামুক্ত, দুঃখ যন্ত্রণাহীন।

৩. প্রতিটি কাজই কমবেশি সাফল্য নিয়ে আসে। সাফল্য মানেই আনন্দ। তাই কাজ মানেও আনন্দ।

৪. কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে বাস্তববাদী। বুদ্ধিমত্তা হয়ে ওঠে সুতীক্ষ্ণ। স্মৃতিশক্তি থাকে অটুট।

৫. যাদের সামনে দিনের কাজের তালিকা স্পষ্ট তারা ভোরে ভোরে ঘুম থেকে জাগতে পারেন। আবার ব্যস্ত দিন কাটিয়ে রাতে তাদের ঘুমও ভালো হয়।

৬. ব্যস্ত মানুষের কদর বেশি। অলসদেরকে নিয়েই যত দুর্গতি। এ কথাটির প্রমাণ আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি আমাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। দেখবেন, যে কর্মচারী কাজে যত পারদর্শী তার সিনিয়র তাকেই তত বেশি পছন্দ করেন। তার বেতন-বোনাস বেশি দেন। আর কাজে ফাঁকিবাজদের কীভাবে মাইনে কাটা যায় বা আরো ভালো লোক পাওয়া যায় সে খোঁজ চলতে থাকে।

তাই এতসব কথার পরে একটি সাধুবাদ জানাতে চাই, হে কর্মী তোমাকে অভিনন্দন! তুমি ব্যস্ত বলেই তুমি সুস্থ, তুমি কর্মী বলেই এত সুখ ও আনন্দ তোমার। এখন শুধু কাজ করো, শ্রম দাও আনন্দে|

১. কাজ করার জন্যে কারণ খুঁজুন, কাজ না করার জন্যে বাহানা বা অজুহাত নয়:

দুই ভাই বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরছে। পরদিন ক্লাস শুরু। পথে শুরু হলো ঝড়। থামার কোনো নাম নেই। তারা যাচ্ছে কোনোরকম। বড় ভাই বলল, চলো বাসায় ফিরে যাই। এই ঝড়ের মাঝে আজ না যাই। ছোট ভাই বলল, ভাই, মনে করো আমরা ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি, তখনো যদি এরকম ঝড় হতো, আমরা কি হোস্টেলে ফিরে যেতাম নাকি বাসায় ফেরার জন্যেই সবরকম চেষ্টা করতাম। বড় ভাই বুঝলেন, কথায় যুক্তি আছে। ছুটি শুরু হলে বাসায় ফেরার জন্যেই তাগিদ থাকতে হবে আবার ছুটি শেষ হলে হোস্টেলে ফেরার জন্যেই তাগিদ থাকতে হবে। বড় ভাই বলল, ঠিক আছে চলো, সামনেই এগিয়ে যাই। 

২. শুধু কাজ করলে হবে না, কায়দামতো কাজ করতে হবে। কাজের প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল আছে কিনা তা দেখতে হবে:

এক বরযাত্রীর দল বড় একটি নৌকা ভাড়া করল। সারারাত বাইলে সারা সপ্তাহের সমান মজুরিই দেয়া হবে বলে তাদেরকে বলা হলো। মাঝিরাও খুশি হয়ে রাজি হলো। নৌকায় উঠে বরযাত্রীরা সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেল। মাঝিদেরও যেহেতু রাতে নৌকা বাওয়ার অভ্যাস ছিল না, তারা ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখেই দাঁড় টানতে লাগল। পরদিন অন্ধকার থাকতেই যখন বরযাত্রীদের ঘুম ভেঙেছে, তারা দেখল রাতে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, এখনো সেখানেই পড়ে আছে। কী ব্যাপার মাঝিরা? সারারাত তো এক গজও এগোয়নি। মাঝিরা বলল, আমরা যে সারারাত দাঁড় টেনেছি, আপনারা বিশ্বাস করছেন না? বরযাত্রীরা তাদেরকে ভালো করে চারদিকে তাকাতে বলল। মাঝিরা চোখ কচলে দেখল, আসলে নোঙরই তোলা হয় নি। তাই নৌকা যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে ছিল। খামোখা তারা সারারাত নৌকা বাইল।    

৩. কাজের তালিকা দেখে ওমা! কত কাজ করেছি!-এই চিন্তা নয়, বরং শুকরিয়া আদায় করা যে এতগুলো কাজ করতে পেরেছি:

মিনা-রাজুর সেই কার্টুনের কথা মনে আছে আমাদের। যেখানে রাজুর কাজ মিনা এবং মিনার একদিনের সব কাজ করেছিল রাজু। দিনশেষে যখন মিনার খাবারের থালা রাজুর সামনে দেয়া হলো, যেখানে ডিম ভুনা নেই, তখন কী মন মেজাজ নিয়ে রাজু তার সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিয়েছিল। সে বলছিল, আমি কত কাজ করছি সারাদিনে। চুলা জ্বালাইছি, ভাত রানছি, গরু চড়াইছি, পানি আনছি, উঠান ঝাড়ু দিছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আঙুলে গুনে গুনে কাজের তালিকা যত বাড়াচ্ছি, তত তার ক্লান্তি যেন বাড়ছিল। অথচ এরচেয়েও বেশি কাজ করে মিনা এবং প্রতিদিন করে। তারপরও তার ক্লান্তি নেই। কারণ, মিনা করে আনন্দ নিয়ে। এই কাজগুলো করে মায়ের সাহায্য হলে তবেই সে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পাবে। আর রাজু মনে করে এসব মাইয়্যা মানুষের কাজ। তাই তার কাছে এসব কাজ বাড়তি ঝামেলা! সেজন্যেই তার এত বিরক্তি।

আসলে কাজের কোনো ছেলে নেই, মেয়ে নেই। ধরুন, আমরা অনেক অফিসে দেখি পুরুষ পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে. টেবিল মুছে দিচ্ছে। তাহলে সেই অফিসের কর্মকর্তার বাসায় যদি কোনোদিন গৃহকর্মী না আসেন, তাহলে তিনি যেন ধরেই নেন যে তার মা-কে বা স্ত্রী থাকলে তাকে বা বোনকে বা মেয়েকেই ঘর ঝাড়ুর কাজটি করতে হবে। আসলে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অধিকাংশ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এরকম ভেবেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে সচেতন। তারা ঘর ঝাড়ুর কাজটি করতে না পারলেও সবজি কেটে দেন বা থালাবাসন ধুয়ে দেন। আমরা এরকম বাবাদেরকে, এরকম ভাইদেরকে, এরকম স্বামীদেরকে, এরকম ছেলেদেরকে অভিনন্দন জানাই। এটাই নবীজীর (স) শিক্ষা। পরিবারের কাছে ভালো হওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন। এভাবে সহযোগিতার মাধ্যমেও আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে-কেউ পরিবারের কাছে ভালো হওয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারি।

একটা ছোট্ট গল্প, গল্পটি দুই গোত্র নিয়ে। এক গোত্র বাস করে পাহাড়ের এই পাড়ে। আরেক গোত্র ওই পাড়ে। একবার তাদের মাঝে কোনো একটি কারণে বিবাদ হলো। এক গোত্র আরেক গোত্রের একটি শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে গেল। গুপ্ত খবরে জানা গেল তারা শিশুটিকে পাহাড়ের চূড়ায় বেঁধে রেখেছে। পাহারায় আছে একজন। সে আবার একটু আলসে প্রকৃতির। বসে থাকতে থাকতেই যেকোনো সময় ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে আসে তার চোখ। যে গোত্রের শিশুটি অপহৃত হয়েছে, সেই গোত্রের কয়েকজন ঠিক করল উদ্ধার অভিযানে বেরুবে। ভোরবেলা শুরু হলো অভিযান। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ের মাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে। একে তো খাঁড়া পাহাড়, তার ওপর পা পিছলাচ্ছে। তারা বেশ কিছুদূর গিয়ে ভাবল আজ না, কাল আবার চেষ্টা করব। ওদিকে সেই শিশুটির পাহারাদার বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ছাউনিতে গিয়ে বসেছিল। হালকা ঠান্ডা বাতাসে সে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। এদিকে এই গোত্রের লোকেরা ফিরে আসার জন্যে ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল শিশুটিকে পিঠে নিয়ে তার মা নামছে। সবাই তো অবাক! তুমি তো আমাদের পেছনে ছিলে! কীভাবে আমাদের আগে আগে উঠে গেলে! আবার শিশুটিকেও সাথে করে নিয়ে এলে। মহিলা বললেন, কারণ এই শিশুটির মা আমি! ও আমার সন্তান। তোমাদের সন্তান হলে তোমরাও আমার আগে উঠে গিয়ে তাকে আনতে পারতে।

আমার সন্তান-এর মতো কাজগুলোকেও যখন আমরা আমাদের ভাবতে পারব, তখন আর কোনো অসুবিধা হবে না। কাজগুলো জমে থাকবে না, কাজ করতে গিয়ে কোনো হেলাফেলা হবে না, গড়িমসি আসবে না, ক্লান্তি কাবু করবে না। বরং কাজ আমাদের জীবনে বাড়িয়ে দেবে আনন্দ। বীমা পেশাতেও কাজের প্রতি বা কোম্পানির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। আন্তরিকতা, ভালোবেসে ও আনন্দের সঙ্গে কাজ করলে সাফল্য আসবেই।

আসলে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সেরকমই রাখেন, যেভাবে সে থাকতে চায়। আরাম চাইলে তার জন্যে স্থায়ী বিছানা ঠিকানা করে দেন। আর কেউ কাজ চাইলে তাকে আরো কাজের সুযোগ করে দেন, সামর্থ্য দিয়ে দেন। কারণ, মানুষ যা নিয়ত করে তার নিয়তি সে অনুসারেই হয়। যে কাজ দেখলে বিরক্ত হয়, কাজ তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই কাজের সুযোগ পেলে সবসময় আমরা বলতে চাই, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। মহান রাব্বুল আলামিনকে ধন্যবাদ। আমি কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। আমার জীবনে আরো আনন্দ যোগ হওয়ার সুযোগ বেড়েছে। কাজের প্রতি এই আনন্দময় মানসিকতাই আমাদের কাজগুলোকে সুন্দর করবে। আমরা শ্রমানন্দে থাকতে পারব আরো বেশি পরিমাণে। সবার জীবন কর্মময় হোক। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা যেন, সৎকর্মশীল, সমর্পিত ও সঙ্ঘবদ্ধ থেকেই আমরা তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারি।

লেখক: মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।

E-mail: zaman15april@gmail.com