বীমা অফিসে বসে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু
এ কে এম মনিরুল হক: ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে দেশের সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেন এবং ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। এভাবে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নানা রকম হয়রানি করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। অন্যদিকে ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান শুরু করে দেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। আইয়ুব খান সেই মামলা প্রত্যাহার করে মুক্তি দিলেও তার উপর নানা শর্তারোপ ছিল। তার রাজনীতি যেমন নিষিদ্ধ ছিল তেমনি আবার যাতায়াতও ছিল নিয়ন্ত্রিত। ঢাকার বাইরে যেতে গেলে পুলিশের অনুমতি লাগতো।
শেখ মুজিব বিশ্ব মানবতার প্রতীক, মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী ও নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অবিনাশী আলোকবর্তিকা। তার কথার মতো তাকে দাবায়ে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাবছিলেন কীভাবে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন ঠিক সেই সময়ে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে বঙ্গবন্ধুকে চাকরির প্রস্তাব দেয়া হয়। মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তিনি ভাবলেন এর চাইতে ভালো সুযোগ আর হতে পারে না। কারণ এই চাকরির সুবাদে সারাদেশে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। জনগণকে একত্রিত করতে পারবেন। তাই তিনি ২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে শাখা প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরি তার জন্য শাপেবর হয়েছিল।
তিনি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দায়িত্ব নেয়ার পর সেখানে তিনি তাজউদ্দিন আহমেদকে চাকরি দেন। কারণ তিনি তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। শুধু তাই নয় তিনি আমাদের সাবেক মেয়র হানিফকেও পিএ হিসেবে নিয়োগ দেন। যাতে তার রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ণ করতে পারেন।
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যদিও নিষেধাজ্ঞা ছিল কিন্তু তিনি বসে থাকেননি। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেয়ার ফলে একটা সুযোগ হয়েছে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় জেলায় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাজে তিনি যেতেন। পুলিশ পারমিশন নিয়ে যেতে হতো, কিন্তু যাওয়ার সুযোগটা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে তিনি যে কাজগুলো করেছেন সেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দর্শন ছিল পূর্ণ স্বাধীনতামুখী। বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করবেন, মুক্ত করবেন এই চিন্তা-চেতনা তার সব সময় ছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দদের নিয়ে গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামের একটি গোপন সংগঠন। সারা বাংলায় প্রতিটি থানায় এবং মহকুমায় গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম হবে বা আগামীতে যদি যুদ্ধ হয় তার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেয়া।
আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে বসে অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। দিনের পর দিন বসে বসে তিনি এই ৬ দফা প্রণয়ন করেন, যা টাইপ করেছিলেন তারই বিশ্বস্ত পিএস মোহাম্মদ হানিফ। এই ৬ দফা আসলে আমাদের বাঙালির মুক্তির সনদ, আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। সেই ভিত্তিটাই তিনি সেখানে বসেই তৈরি করেন।
তাই আমি মনে করি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীমা শিল্পকে ঘোষণা করা উচিত। এই শিল্পই জাতির পিতাকে রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছিল, চাকরির অন্তরালে তিনি সারাদেশে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছিলেন এবং জনগণকে একত্রিত করেছিলেন। সর্বোপরি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সুন্দর একটা পরিবেশ পেয়েছিলেন বলেই তার পক্ষে বোধ হয় ছয় দফা প্রণয়ন করা সহজ হয়েছিল। তাই দেশের স্বাধীনতার মূল্যায়নে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বীমা শিল্প। তাই জাতির কাছে আমাদের আহবান থাকবে বীমা শিল্পকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঘোষনা করার জন্য।
লেখক: চেয়ারম্যান, নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।