পদ্মাসেতু: যোগাযোগ, উন্নয়ন ও অর্থনীতির সেতু

এ কে এম মনিরুল হক: বাংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বল মতিমালায় আরেকটি জ্বলজ্বলে মুক্তার সংযোজন ‘পদ্মা সেতু’। ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহুল কাঙ্খিত, বহুল আলোচিত, বহুল আলোড়িত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। স্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই, তা আজ বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাঙ্গালী বীরের জাতি। আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না। আর পারেও নাই। নয় মাস যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। তেমনি বঙ্গবন্ধু কন্যাও আরেকবার প্রমাণ করলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সিদ্ধান্ত বিশ্বকে এই বার্তা দিয়েছে যে কোনো অন্যায়ের কাছে বাংলাদেশ কখনো মাথা নত করবে না।

ব্রাজিলের আমাজন নদীর পর প্রমত্তা পদ্মা বিশ্বে খরস্রোতা নদীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। পদ্মার বুকে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে আমাদের অহংকার, আমাদের মর্যাদা আর স্বপ্নের সেতু।

সত্তরের দশকে এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্রসীমার নীচে, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই দেশ আজ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। তাই পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের অনন্য গৌরব, মর্যাদা আর অহংকারের প্রতীক ।

পদ্মা সেতু অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে। দেশের জিডিপি বছরে ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় জিডিপি ২.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহের সুযোগ তৈরি ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে এ সেতু। সেতুটির কারণে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা চট্টগ্রাম বন্দরের মতো যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুবিধা হবে।

পদ্মা সেতুর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ব্যাপক। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সেতুটি নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে, দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে।

এডিবির সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে যে ২৪ হাজার যানবাহন চলবে, তার মধ্যে বাস চলবে আট হাজার ২৩৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। সমীক্ষায় আরও প্রাক্কলন করা হয়েছে, ২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫। ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮০৭টি।

পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষা মতে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ১.২% জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়াবে তিন দশমিক পাঁচ শতাংশে। পদ্মা সেতুর ফলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরায় পুরনো-নতুন রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের দেশপ্রেমী, তার দৃঢ় মনোবল আর আত্মবিশ্বাসের ফলে আমাদের উপহার দিতে পেরেছেন এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। উদ্বোধনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় গোটা দেশবাসী। তাই হৃদয় গভীর থেকে উৎসারিত হচ্ছে- সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী, অবাক তাকিয়ে রয়:, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।

লেখক: চেয়ারম্যান, নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।