জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা ও পুঁজিবাজারের স্থিতিশীল উন্নয়নে শক্তিশালী বীমা খাত সময়ের দাবি

অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক: বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্র সবার আর্থিক নিরাপত্তা এবং দেশের পুঁজি বাজারের স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য বীমা খাতকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বীমা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা তুলনামূলকভাবে কম, আবার অনেক সাধারণ মানুষ জানেই না বীমা কীভাবে তাদের জীবনে সুরক্ষা দেয়। অন্যদিকে পুঁজিবাজারেও দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীল তহবিলের ঘাটতি রয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রকে একই নীতিতে একত্রিত করা গেলে অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ফিনান্সিয়াল ইকোসিস্টেম তৈরি হবে, যেখানে ধনী-দরিদ্র উভয়েই লাভবান হবে।

১. প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ এখনো ঝুঁকির মোকাবিলায় অনানুষ্ঠানিক উপায়কে বেছে নেয়। অসুস্থতা, মৃত্যু, ফসল নষ্ট, দুর্ঘটনা ইত্যাদিতে পরিবার দারিদ্র্যে পড়ে যায়। যদি জীবন বা স্বাস্থ্যবীমা শক্তিশালী হয়, তখন ঝুঁকি ভাগাভাগি হওয়ায় পরিবার স্বচ্ছলতা ধরে রাখতে পারে।

একই সময়ে, পুঁজি বাজারে বড় করপোরেট ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণ এখনো হয়নি। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারী হিসেবে বীমা খাত যদি আরও শক্তিশালী হয়, তবে পুঁজি বাজারে স্থিতিশীল তহবিলের প্রবাহ বাড়বে।

এটি দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক

> জনগণ পাবে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক নিরাপত্তা

> পুঁজি বাজার পাবে নির্ভরযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী তহবিল

২. ধনী-দরিদ্র সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামো

ক. মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স এবং ইনক্লুসিভ বীমা

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় বাধা হল প্রিমিয়াম দিতে না পারা। খুব ছোট প্রিমিয়ামে (মাসে ২০-৫০ টাকা) বীমার সুযোগ দিলে তারা সহজেই যুক্ত হতে পারবে।

উদাহরণ

> গ্রামীণ কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভিক্ষাজীবী, রিকশাচালক

> স্বাস্থ্য, ফসল, অগ্নিকাণ্ড, জীবন বীমা কভারেজ

এটি যুক্ত করলে জনগণের সঞ্চয় অভ্যাস তৈরি হয় এবং ক্ষুদ্র বীমা কোম্পানির অর্থ দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যায়।

খ. মধ্যবিত্তের জন্য কর সুবিধা ও ডিজিটাল একসেস

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেগমেন্ট মধ্যবিত্ত। তাদের ঝুঁকি সচেতনতা বেশি, তবে কর সুবিধা না থাকায় বীমায় আগ্রহ কম।

প্রস্তাব

> জীবন বীমায় কর ছাড়
> স্বাস্থ্য বীমায় ভ্যাট অব্যাহতি
> স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ফি কাভার বীমা

মোবাইল অ্যাপ, বিকাশ-নগদ পেমেন্ট ইত্যাদি দিলে গ্রাহকের আওতা কয়েক গুণ বাড়বে।

গ. উচ্চ আয়ের মানুষকে উদ্ভাবনী প্রডাক্টের মাধ্যমে আকৃষ্ট করা

ধনী মানুষ বিনিয়োগ-কেন্দ্রিক পণ্য চান

> Investment-linked Insurance (Unit-linked policy)

> Retirement annuity

> Corporate medical plans

এগুলো সরাসরি পুঁজি বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, বড় আকারের অর্থ বাজারে প্রবাহিত হয়।

৩. পুঁজিবাজারে বীমা খাতের প্রাতিষ্ঠানিক অবদান বাড়ানো

ক. বীমার তহবিলকে দীর্ঘমেয়াদী সরকারি ও করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগ

বীমা কোম্পানির হাতে দীর্ঘমেয়াদী প্রিমিয়াম সঞ্চিত থাকে, যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ উৎস।

প্রস্তাব

> অবকাঠামো প্রকল্পে বন্ড
> করপোরেট বন্ড মার্কেট সক্রিয়করণ
> গ্রোথ ফান্ডে ইনভেস্টমেন্ট

এতে সরকার বিদেশি ঋণের ওপর কম নির্ভরশীল হবে।

খ. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানি বাড়ানো

স্বচ্ছতা ও করপোরেট গভার্নেন্স উন্নত হয়

> আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
> শেয়ারহোল্ডারের জবাবদিহি
> বিনিয়োগকারীর আস্থা বৃদ্ধি

এতে সাধারণ মানুষও বীমা শেয়ার কিনে পরোক্ষভাবে বাজারে যুক্ত হতে পারে।

৪. সরকারের কৌশলগত ভূমিকা

ক. আইন-নীতির সংস্কার

বর্তমান বীমা আইন আরও আধুনিক করা জরুরি

> পলিসি সেবায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
> দাবি নিষ্পত্তি দ্রুত বাধ্যতামূলক
> ডিজিটাল KYC
> রি-ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ

গ্রাহক সুরক্ষা বাড়লে আস্থা বাড়ে।

খ. জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি

সরকার ধাপে ধাপে সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন করতে পারে

> দরিদ্রের জন্য প্রিমিয়াম ভর্তুকি
> কর্মজীবীদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবীমা
> শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বীমা

এতে স্বাস্থ্য ব্যয় কমবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।

গ. আর্থিক সাক্ষরতা বাড়ানো

স্কুল-কলেজে ফিনান্স শেখানো হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হবে। মিডিয়া-ক্যাম্পেইন দরকার ‘বীমা সুরক্ষা, পুঁজিবাজার সমৃদ্ধি’।

৫. প্রযুক্তি ও ইন্সুরটেক ব্যবহারে বিপ্লব

> AI-ভিত্তিক প্রিমিয়াম ক্যালকুলেশন
> ব্লকচেইনে পলিসি ও দাবি ব্যবস্থাপনা
> মোবাইল অ্যাপে সাইন-আপ, প্রিমিয়াম পরিশোধ
> ডাটা-ড্রিভেন রিস্ক প্রোফাইল

গ্রাহকের ঝামেলা কম হলে অংশগ্রহণ বাড়ে। ডিজিটাল সিস্টেমে দুর্নীতিও কমে।

৬. আস্থা প্রতিষ্ঠা: মূল চাবিকাঠি

বাংলাদেশের জনগণের সবচেয়ে বড় আপত্তি হচ্ছে দাবি নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। এটি পরিবর্তন করা না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।

সমাধান

> নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক
> ডেডলাইন ভাঙলে জরিমানা
> ক্লেইম স্ট্যাটাস মোবাইলে দেখার সুবিধা
> বীমা ওম্বাডসম্যান অফিস শক্তিশালী

আস্থা ফিরে এলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বীমা গ্রহণ করবে।

৭. সম্ভাব্য সুফল (ধনী-দরিদ্র সবার জন্য)

জনগণের লাভ পুঁজি বাজারের লাভ দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, মৃত্যুতে পরিবার রক্ষা দীর্ঘমেয়াদী তহবিল বৃদ্ধি। দরিদ্রের সঞ্চয় তৈরি মার্কেটে স্থিতিশীলতা বেকারত্ব, বার্ধক্যে নিরাপত্তা বিদেশি বিনিয়োগকারীর আস্থা উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিতে সাহস বাড়ে। করপোরেট বন্ড বাজার বৃদ্ধি। এই দুই খাত একে অপরকে শক্তিশালী করবে। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি আরো মজবুত হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্র সকল শ্রেণিকে বীমার আওতায় এনে এবং সেই বীমার তহবিলকে সুশাসন ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় পুঁজি বাজারে যুক্ত করলে জাতীয় অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে। জনগণের জীবন হবে নিরাপদ, ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিতে পারবে, আর রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে নিজের মূলধন দিয়ে। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নীতি সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা অর্জন অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।